যখন থাকে না আর কোনো অধিকার বিষয় ও বৈভবে…
৯ নভেম্বর ২০২০ ২২:৪১ | আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০২০ ০৯:১৪
চট্টগ্রাম ব্যুরো: বাড়ি চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলায়। আশির দশকে ভাগ্য অন্বেষণে গিয়েছিলেন কুয়েতে। দেশটিতে যুদ্ধ শুরু হলে নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় ফিরে আসেন প্রবাসী জীবনের সঞ্চয় নিয়ে। ভালোবেসে বিয়ে করলে সে বিয়ে মেনে নিতে পারেনি পরিবার। স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা সংসার পাতেন চট্টগ্রাম নগরীর কাজীর দেউড়িতে। দুই ছেলে ও এক মেয়ের জন্ম হয় এর মধ্যে। একসময় বেশ জায়গা-জমিও কিনে ফেলেন— সবই স্ত্রীর নামে। সেই স্ত্রী তার নামে নারী নির্যাতনের মামলা করলে সেই মামলায় ছয় মাস কারাবরণও করেন।
যে স্ত্রীকে ভালোবেসে পরিবার ছেড়েছেন, সব সহায়-সম্পদও গড়েছেন যে স্ত্রীর নামে, সেই স্ত্রীর এই মামলা মেনে নিতে পারেননি। কারাগার থেকে মুক্তি পেলেও অভিমানে আর স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে যোগাযোগও করেননি। একসময়ের ধনাঢ্য ব্যক্তিটি কপর্দকশূন্য হয়ে ঘুরতে থাকেন মাজারে মাজারে। সংসারত্যাগী মানুষটি শেষ ক’দিনের জন্য ঠাঁই নেন চট্টগ্রাম নগরীর আমানত শাহ মাজারে। শেষ পর্যন্ত সেই মাজারেই প্রয়াণ হয় তার। পরিবার-পরিজন থেকে অনেক দূরে একাকী অবস্থায় পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পাড়ি জমান না ফেরার দেশে।
একসময় যার সব ছিল দুনিয়ার বুকে, প্রয়াণের পর সেই ব্যক্তিটির লাশই উদ্ধার হয়েছে বেওয়ারিশ হিসেবে! মাথার কাছে পড়ে ছিল একটি গামছা। তাতে দাফনের জন্য জমা হয়েছিল ১০ টাকা, ২০ টাকা, ৫০ টাকার কয়েকটি নোট!
চট্টগ্রাম নগরীর আমানত শাহ মাজার এলাকা থেকে ৫৪ বছর বয়সী এক বৃদ্ধের লাশ উদ্ধারের পর তার পরিচয় খুঁজতে গিয়ে তার জীবনের এমনই মর্মন্তুদ কাহিনী বেরিয়ে এসেছে।
মঙ্গলবার (৯ নভেম্বর) দুপুর ১২টার দিকে আমানত শাহ মাজার কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে খবর পেয়ে কোতোয়ালি থানা পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠায়। লাশের পরিচয় নির্ধারণে কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। সেই সূত্রে সন্ধান মেলে তার দুই ভাইয়ের।
ওসি মহসীন সারাবাংলাকে বলেন, ‘মৃত ব্যক্তির নাম আবু জাফর। বাবার নাম মৃত আবুল কাশেম। এনআইডি অনুযায়ী জন্ম ১৯৬৬ সালের ১১ মার্চ। তার বড় ভাই সেকান্দর হোসেন থাকেন নগরীর আলকরণে। নিউমার্কেটে একটি জুতার দোকানে চাকরি করেন। ছোট ভাই নুরুল আলম থাকেন ইপিজেড থানার ফ্রিপোর্ট এলাকায়। ফেসবুকে ছবি দেখে সেকান্দর হোসেন পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। দুই ভাই এসে লাশ শনাক্ত করেন। এরপর তারা যে কাহিনী জানিয়েছেন, তাতে আমরাও নিজেদের আবেগ সামলাতে পারিনি। সেকান্দরের কাছ থেকে আমরা জানতে পেরেছি, আবু জাফরের দুই ছেলে ও এক মেয়ে তাদের মায়ের সঙ্গে নোয়াখালীতে থাকেন। বড় ছেলের মোবাইল নম্বর আমরা সংগ্রহ করে তার বাবার মৃত্যুর খবর জানিয়েছিলাম। কিন্তু এরপর থেকে তিনি মোবাইল বন্ধ করে রেখেছেন।’
নগরীর জেলরোডে আমানত শাহ মাজার এলাকা থেকে আবু জাফরের লাশ উদ্ধার করেন কোতোয়ালি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) বাবলু পাল। ভাই সেকান্দর হোসেনের বরাত দিয়ে বাবলু পাল সারাবাংলাকে জানান, তিন ভাইয়ের মধ্যে আবু জাফরই ছিলেন শিক্ষিত। আশির দশকে তিনি কুয়েতে যান। সাতবছর থাকার পর ১৯৯০ সালে সেখানে যুদ্ধ শুরু হলে তিনি দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু দেশে আসার পর বাবা-ভাইদের সঙ্গে তার দূরত্ব তৈরি হয়। তিনি ঢাকায় গিয়ে এক মেয়েকে বিয়ে করে আনেন। বাবা মানতে না পেরে তাকে ঘর থেকে বের করে দেন।
কুয়েত থেকে আয় করা টাকায় স্ত্রীর নামে নগরীর কাজীর দেউড়ির দুই নম্বর গলিতে ভবনসহ জায়গা কেনেন আবু জাফর। বছর দশেক আগে স্ত্রী রোজী আক্তার তার নামে আদালতে নারী নির্যাতনের মামলা করেন। ওই মামলায় কোতোয়ালি থানা পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠায়। প্রায় ছয় মাস জেল খেটে বেরিয়ে তিনি আর ঘরে ফিরে যাননি। স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। মাজারে-মাজারে ঘুরতে থাকেন। বছরখানেক পর স্ত্রী রোজী ভবন বিক্রি করে বাবার বাড়ি নোয়াখালীতে চলে যান সন্তানদের নিয়ে।
এসআই বাবলু পাল সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভাইদের বক্তব্য অনুযায়ী, আবু জাফর প্রচণ্ড অভিমানী ছিলেন। স্ত্রীর জন্য বাবা-মা, ভাইদের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেন। স্ত্রীর নামে জায়গা-বিল্ডিং কেনেন। যে স্ত্রীকে ভালোবেসে তিনি এত কিছু করেছেন, তার দেওয়া মামলায় জেলে যাওয়াটা মানতে পারেননি তিনি। অভিমানে স্ত্রী-সন্তানদের কাছ থেকেও মুখ ফিরিয়ে নেন। মাজার হয়ে যায় তার ঠিকানা। আমানত শাহ মাজারের লোকজন জানিয়েছেন, দেড় মাস আগে থেকে তারা আবু জাফরকে ওই মাজারে দেখতে থাকেন। তিনি কথাবার্তা খুবই কম বলতেন। মানুষের কাছ থেকে সাহায্য-সহযোগিতা নিতেন, তবে ভিক্ষা করতেন না।’
‘সকালে আমানত শাহ’র মাজারের নিয়মিত ভিক্ষুকরা আবু জাফরকে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। তখন তারাই মাথার কাছে একটি গামছা পেতে দেন। নিয়মিত ওই মাজার জিয়ারত করতে শত শত মানুষ যান। মৃত মানুষটির দাফনের জন্য কেউ ১০ টাকা, কেউ ২০ টাকা, কেউ তার চেয়েও বেশি গামছার ওপর রেখে যান। আমরা খবর পেয়ে লাশ উদ্ধারের সময় লুঙ্গির ভাঁজের মধ্যে একজন ডাক্তারের একটি প্রেসক্রিপশন এবং একটি এনআইডি কার্ড পেয়েছি,’— বলেন এসআই বাবলু।
মৃত আবু জাফরের ছোট ভাই নুরুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের বাড়ি কর্ণফুলী উপজেলার চরলক্ষ্যা এলাকায়। কুয়েত থেকে আসার পর আমার ভাই বাবার অমতে বিয়ে করেছিলেন। তখন আমার বাবা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। প্রায় ৩০ বছর ধরে তার সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তিনিও কোনোদিন আর বাড়ি যাননি। আজ (সোমবার) দুপুরে আমার ছেলে ফেসবুকে ছবি দেখে আমাকে দেখান। আমি চিনতে পারি। আমার বড় ভাইও খবর পান। তখন আমরা দু’জন হাসপাতালে আসি।’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘যা-ই হোক ভাই তো, রক্তের সম্পর্ক। আমাদের সঙ্গে তো কোনো শত্রুতা ছিল না। শুধু মান-অভিমান ছিল। ছবি দেখে আমর মন মানেনি, আমি চলে এসেছি। পুলিশ চেয়েছিল আনজুমানে মফিদুল ইসলামকে দিয়ে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করতে। আমি বলেছি, চৈতন্যগলি কবরস্থানে দাফন করতে। তারা বলছে চৈতন্যগলিতে দাফন করতে হলে কাফনের কাপড় এবং কবরের জন্য টাকা লাগবে। আমি গরীব মানুষ। ভাইয়ের জন্য সেই টাকা আমরা দিচ্ছি। চৈতন্যগলিতেই দাফন হচ্ছে।’
পুলিশের সূত্রে পাওয়া মৃত আবু জাফরের ছেলের মোবাইল নম্বরে ফোন করা হলেও সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে।