কর্মকর্তাদের ‘নিয়ন্ত্রণে’ স্বাস্থ্য খাত, চিকিৎসক নেতাদের ক্ষোভ
১৯ অক্টোবর ২০২০ ০১:১৮ | আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০২০ ০১:৫৪
ঢাকা: দেশের স্বাস্থ্যখাতের বিভিন্ন পদে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদায়ন এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে চিকিৎসক কর্মকর্তাদের উপেক্ষা করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করেছেন চিকিৎসক নেতারা। এসব বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে সমস্যার সমাধান না হলে ভবিষ্যতে আন্দোলনে নামবেন বলেও হুমকি দেন চিকিৎসক নেতারা। উপস্থিত চিকিৎসকরা এতে সমর্থন জানান।
রোববার (১৮ অক্টোবর) রাজধানীর একটি হোটেলে সোসাইটি অব সার্জনস অব বাংলাদেশ আয়োজিত ‘বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কোভিড-১৯ মহামারিতে সার্জনদের ভূমিকা’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে চিকিৎসক নেতারা নিজেদের বক্তব্যে এই ক্ষোভ জানান।
কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শকে গুরুত্ব দিয়ে প্রতিরোধ পরিকল্পনা সাজালেও বাংলাদেশে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা তা করতে গিয়ে ‘বিজ্ঞানকেও নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাচ্ছেন’ বলে সভায় অভিযোগ করেন চিকিৎসক নেতা ডা. ইকবাল আর্সলান।
অধ্যাপক আর্সলান বলেন, “আমলারা ব্রিটিশ আমলের শাসন ব্যবস্থায় সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছেন। নিয়ন্ত্রণ করার মানসিকতা থেকেই এসব করা হচ্ছে। কোভিড মহামারির সময় আরেকটা সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছেন। এদেশের বিজ্ঞানীরা যে পরামর্শ দিচ্ছেন, সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে তাদের (প্রশাসন ক্যাডার) নিজেদের মনগড়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের চেষ্টা করছেন”।
তিনি বলেন, “কোভিড মোকাবিলায় সারা বিশ্বের সরকার চিকিৎসকদের সঙ্গে পরামর্শ করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশ প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা ‘বিজ্ঞানকেও নিয়ন্ত্রণ করার’ চেষ্টা করছেন। রাজনৈতিক নেতারা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে নীতি নির্ধারণ করবেন। প্রশাসনের কর্মকর্তারা তা বাস্তবায়ন করবেন”।
তিনি আরও বলেন, “অতিমারিকে উপলক্ষ করে দেশটাকে দখল করার একটা পাঁয়তারা তারা করছেন। এটা আমরা মেনে নিচ্ছি না। এর আগে যখন এ ধরনের কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছিল আমরা তাদের হুঁশিয়ার করেছিলাম। কিন্তু হুঁশিয়ারিটা… আসলে তাদের কানে মনে হয় পানি যাচ্ছে না। যদি কানে পানি দিতে হয় তাহলে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন অতীতে যেভাবে সব আন্দোলন পরিচালনা করেছে, ভবিষ্যতেও করবে”।
অনুষ্ঠানে স্বাচিপের সাধারণ সম্পাদক ডা. এম এ আজিজ অনুষ্ঠানে বলেন, “প্রশাসন ক্যাডারে অতিরিক্ত সচিবের পদ ১১৩টি। কিন্তু অতিরিক্ত সচিব করা হয়েছে ৬১০ জনকে। এদের পদায়নের জন্যই বিভিন্ন জায়গায় নতুন নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়েছে”।
তিনি বলেন, “স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিভিন্ন বিভাগে চিকিৎসক কর্মকর্তারা কাজ করছেন। কিন্তু অ্যাডমিনের লোকজন ঢোকানো হচ্ছে। নার্সিং,পরিবার পরিকল্পনায় তাদের লোকজন বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুনতে পাচ্ছি ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনেও অ্যাডমিনের লোক দেওয়ার পাঁয়তারা চলছে যেখানে টেকনিক্যাল জনবল লাগে। তারা আমাদের কাজের পরিবেশ তৈরি করে দেবেন, তা না করে খবরদারি করছেন”।
বাংলাদেশের চিকিৎসকদের পিঠে আরেকবার ছুরি বসানোর চেষ্টা করা হচ্ছে উল্লেখ করে বিএমএট’র সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেন, “স্বাস্থ্যমন্ত্রী আপনি জানেন কি না আমি জানি না, নতুন ডিজি হয়ত তার কাজকর্ম এখনও বুঝে উঠতে পারেননি। আজ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনেক কাজে চিকিৎসক কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে আমলাতান্ত্রিক করা হচ্ছে”।
এ সময় অনুষ্ঠানে আসা চিকিৎসকরাও টেবিল চাপড়ে, হাততালি দিয়ে চিকিৎসক নেতাদের এসব কথায় সমর্থন জানান।
অনুষ্ঠানে বিএমএ মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, “বিএমএ এবং স্বাচিপের উদ্যোগে সোমবার বিএমএ ভবনে দেশের জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকদের সভা ডাকা হয়েছে। আগামী সপ্তাহে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনসহ অন্যান্য পেশাজীবী সংগঠনের সঙ্গে মতবিনিময়, প্রতি সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন জেলার পেশাজীবী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক হবে। তারপর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে”।
কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের পরিচালক স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের অধীনস্থ একটি পদ হলেও তিনি স্বাস্থ্যের মহাপরিচালককে পাত্তাই দেন না বলে অভিযোগ করেন ডা. বিএমএ মহাসচিব। তিনি বলেন, “সিএমএসডির পরিচালক পদে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়ার সময় চিকিৎসকরা প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু সে সময় তাদের কথা শোনা হয়নি। তিনি অ্যাডিশনাল সেক্রেটারি না সেক্রেটারি আমাদের বিবেচ্য বিষয় নয়। তিনি একজন পরিচালক হিসেবে যোগ দিয়েছেন, সুতরাং মহাপরিচালকের সভায় তাকে আসতে হবে। যদি না পোষায় তাহলে চলে যান, কে আসতে বলেছে এখানে? দিস ইস মাই হোম”।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের দিকে ইঙ্গিত করে বিএমএ মহাসচিব বলেন, “ডিজি মহোদয়, আপনি একজন চিকিৎসক। সবাই বলে আপনি ভালো মানুষ। আমরাও বলি আপনি ভালো মানুষ। আপনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভক্ত, রবীন্দ্রসঙ্গীত বলে আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি। তাহলে আপনার পাশে পাক সার জমিন সাদ বাদ কীভাবে ঘোরাফেরা করে? আপনি যতই ভালো মানুষ হোন না কেন, দয়া করে একটু ডান-বাম তাকান। আপনি তাকে ডেকে স্বাস্থ্য অধিদফতরে ঢুকিয়েছেন”।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম তার বক্তব্যে বলেন, “প্রশাসন ক্যাডার চিকিৎসকদের জায়গা দখল করে নিচ্ছে,সেটা চিকিৎসকদেরই ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করতে হবে”।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক পদে আসার জন্য কোনো তদবির করেননি উল্লেখ করে ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম আরও বলেন, “এই পদে (মহাপরিচালক) কোনো রকমের তদবির করে আসিনি। এই পদে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে নির্বাচন করে আমাকে বসিয়েছেন। আমি এখানে থাকতে আসিনি। আমাকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, যে নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর মাধ্যমে, আমি সেটাই করছি এবং সেটা করেই আমি আমার নির্দিষ্ট সময়ে চলে যাব। কাজেই থাকা না থাকার বিষয়টিই নেই”।
অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপন চিকিৎসকদের আশ্বস্ত করে বলেন, “এ বিষয়ে আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই সেটা হলো, আমার হাত দিয়ে এমন কোনো কাজ হবে না, যেটা স্বাস্থ্য সেবার বা ডাক্তারদের স্বার্থ হানি হবে। আপনারা আমার পূর্ণ সহযোগিতা পাবেন”।