বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি কার্যক্রমে সুশাসনের ঘাটতি রয়েছে: টিআইবি
২২ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৭:৩১ | আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২১:৪৮
ঢাকা: বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি কার্যক্রমে সুশাসনের ঘাটতি রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনেক তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়িত না হওয়ায় তদন্ত কার্যক্রম মূল্যহীন হয়ে পড়ে। অনেকসময় ‘আর্থিক খাতের স্বার্থ বিপন্ন হতে পারে’— এই ‘অজুহাতে’ সংঘটিত অনিয়মের বিষয়গুলো প্রতিবেদনে উল্লেখ না করে অভিযুক্ত ব্যাংকগুলোকে কেবল মৌখিকভাবে সতর্ক করা হয়।
‘ব্যাংকিং খাত তদারকি ও খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ: বাংলাদেশ ব্যাংকের সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব কথা তুলে ধরেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। মঙ্গলবার (২২ সেপ্টেম্বর) সংস্থাটি এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। গবেষণায় তথ্য সংগ্রহের সময়কাল ছিল ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত। গবেষণায় ২০১০ সাল থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত সময়ে সংঘটিত বিভিন্ন কার্যক্রম বিবেচনা করা হয়েছে।
ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন মোহামম্মদ রফিকুল হাসান। সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি‘র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ও পরিচালক জনসংযোগ শেখ মঞ্জুর ই আলম যুক্ত ছিলেন।
আরও পড়ুন- ‘খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ’
টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়, অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ব্যাংকের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের দুয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কয়েকটি শিল্পগোষ্ঠীর যোগসাজশের মাধ্যমে পরিদর্শন প্রতিবেদনের উল্লিখিত অনিয়ম চূড়ান্ত প্রতিবেদন থেকে বাদ দেওয়া হয়ে থাকে। আবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়া বিভিন্ন ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনগুলো পরবর্তী সময়ে আর ব্যবহার করা হয় না। সেগুলো ‘ব্ল্যাক হোলে’ হারিয়ে যায়। আবার তদারকি কাজে নিযুক্ত কর্মকর্তাদের একাংশ আর্থিক বা অন্যান্য সুবিধার বিনিময়ে প্রকৃত তথ্য গোপন করে দুর্বল তদন্ত প্রতিবেদন প্রণয়ন করে থাকে।
টিআইবি‘র প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সরকারের সুদৃষ্টিতে থেকে চাকরির মেয়াদ শেষে অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পর্যায়ে নিয়োগের আশায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একাংশ প্রভাবশালীদের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরূদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকেন। এছাড়া পদোন্নতির জন্য একজন কর্মকর্তাকে কাজের মূল্যায়নে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছ থেকে উচ্চ নম্বর পেতে হয়। ফলে তার সুনজরে থাকার জন্য অনৈতিক আরোপিত সিদ্ধান্ত/নির্দেশনা মেনে নিতে বাধ্য হন অনেকে। শুধু তাই নয়, বাণিজ্যিক ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে হৃদ্যতা বা স্বজনপ্রীতির কারণেও অনেক ক্ষেত্রে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণে বিরত থাকার অভিযোগ রয়েছে। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনেকে অবসরের পরপরই যে প্রতিষ্ঠানগুলোর তদারকি করতেন, সেখানে উচ্চ পদে যোগ দিয়ে থাকেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেক কর্মকর্তাদের এমন অনৈতিক কাজের কারণে অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয় না।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক অধ্যাদেশ, ১৯৭২-এর মাধ্যমে সংসদীয় কমিটির কাছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যক্রম সম্পর্কে জবাবদিহিতার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে প্রতিবেদন পাঠানোর বাধ্যবাধকতা বাংলাদেশ ব্যাংকের থাকলেও, মন্ত্রী-সাংসদসহ বিপুলসংখ্যক রাজনৈতিক ব্যক্তি ব্যাংকিং খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার ফলে এই জবাবদিহি কাঠামো ততটা কার্যকর হয়ে উঠতে পারেনি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সব ধরনের তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে তা ‘আর্থিক খাতের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে— নির্বিচারে এই অজুহাত দেখানো হয়। ফলে ঋণ খেলাপি ও ব্যাংকের অবস্থা সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ বার্ষিক সাধারণ সভার মাধ্যমে নির্বাচনের কথা থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা পূর্বনির্ধারিত থাকে। একক পরিবারের পরিচালক সীমা লঙ্ঘন করে একাধিক ব্যাংকে একই পরিবারের চারের অধিক পরিচালক নিয়োগ করা হয়। পরিচালক থেকে ব্যাংক বা ব্যবস্থাপনায় পেশাগতভাবে ১০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকা বাধ্যতামূলক হলেও অনেক ব্যাংকে ব্যক্তি সম্পর্কের ভিত্তিতে অনভিজ্ঞ পরিচালক নিয়োগ করা হয়। এছাড়া আইন লঙ্ঘন করে বিভিন্ন ব্যাংকে একাধিক ঋণ খেলাপি পরিচালক বিদ্যমান থাকার নজির থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো পদক্ষেপ নেয় না।
টিআইবির‘র প্রতিবেদনে বলা হয়, দুই বছর আগেও পরিদর্শন বিভাগের কর্মকর্তাদের সরাসরি যেকোনো ব্যাংক পরিদর্শনের ক্ষমতা থাকলেও বর্তমানে ডেপুটি গভর্নরের অনুমতি ছাড়া পরিদর্শন করা যায় না। আগে পরিদর্শন দলের পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ থাকলেও এখন ডেপুটি গভর্নরের অনুমোদনসাপেক্ষে ব্যবস্থা নিতে হয়।এছাড়াও দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের সংখ্যা এবং ব্যাংকগুলোর শাখার সংখ্যা বাড়লেও সার্বিকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন সংখ্যা কমার প্রবণতা লক্ষ করা যায়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে বাংলাদেশ ব্যংকের অফসাইট ও অনসাইট তদারকি, প্রতিবেদন তৈরি ও চূড়ান্তকরণ এবং প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রিতা লক্ষ করা যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের একক বৃহত্তম ঋণ সীমা লঙ্ঘনের ঘটনা ২০০৭ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে সংঘটিত হলেও ২০১৬-১৭ সালে এই বিষয়টি ধরা পড়ে। এই ঘটনায় ব্যাংকের শাখার ব্যবস্থাপক প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত থাকলেও পরে পদোন্নতি পেয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হন। ২০২০ সালে এসে ওই জালিয়াতিতে তার জড়িত থাকার বিষয়টি উদঘটিত হয় এবং তার অপসারণের সুপারিশ করা হয়।
এছাড়াও ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সুস্থ ও নিরাপদ ব্যাংকিং ব্যবস্থা পরিচালনায় এ খাত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠন করাসহ ১০ দফা সুপারিশ করা হয়েছে টিআইবি‘র প্রতিবেদনে। সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে— ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ ও ব্যাপক অনিয়মে জর্জরিত ব্যাংকিং খাত সংস্কারের জন্য খাত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন করতে হবে; ‘ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১’-এর ৪৬ ও ৪৭ ধারা সংশোধন করে বাংলাদেশ ব্যাংককে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির পূর্ণ ক্ষমতা দিতে হবে; বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সদস্য, গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ ও অপসারণ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট লিখিত নীতিমালা করতে হবে, যেখানে নিয়োগ অনুসন্ধান কমিটির গঠন, দায়িত্ব-কর্তব্য এবং নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকবে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে তিন জন সরকারি কর্মকর্তার জায়গায় বেসরকারি প্রতিনিধির (সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ যেমন আর্থিক খাত ও সুশাসন বিষয়ক) সংখ্যা বাড়ানোর সুপারিশ করেছে টিআইবি।
খেলাপি ঋণ টপ নিউজ টিআইবি তদন্ত প্রতিবেদন তদারকি বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকিং খাত সুপারিশ সুশাসন