লন্ডনপ্রবাসীর দাপট: ৮ পুলিশসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা
১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১২:৩১ | আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৩:৫৪
চট্টগ্রাম ব্যুরো: ইয়াবা ও অস্ত্র দিয়ে ফাঁসিয়ে গ্রেফতারের পর শিক্ষানবিস আইনজীবীকে ‘ক্রসফায়ারে’ হত্যাচেষ্টার অভিযোগে ৮ পুলিশ সদস্যসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম আদালতে একটি মামলা দায়ের হয়েছে। বিরোধের জেরে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক সঞ্জয় দাশ পুলিশ সদস্যদের মাধ্যমে ওই ব্যক্তিকে ফাঁসিয়ে দেন বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে।
মামলায় পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের তৎকালীন উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) এস এম মনিরুজ্জামানকে সরাসরি আসামি করা না হলেও তার মাধ্যমে আসামিরা এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
সোমবার (১৪ সেপ্টেম্বর) চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম আবু সালেম মো. নোমানের আদালতে মামলাটি দায়ের করেছেন ঘটনার শিকার সমর কৃষ্ণ চৌধুরী। ৬৫ বছর বয়সী এই ব্যক্তি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার সারোয়াতলী ইউনিয়নের দক্ষিণ সারোয়াতলী গ্রামের মৃত মনোরঞ্জন কৃষ্ণ চৌধুরীর ছেলে।
আদালত মামলা আমলে নিয়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন বাদীর আইনজীবী জুয়েল দাশ।
মামলায় অভিযুক্তরা হলেন বোয়ালখালী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিমাংশু কুমার দাশ, পরিদর্শক (তদন্ত) মাহবুব আলম আখন্দ, উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. আতিক উল্লাহ, আরিফুর রহমান, আবু বক্কর সিদ্দিকী, রিপন চাকমা ও দেলোয়ার হোসেন, সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) আলাউদ্দিন, লণ্ডনপ্রবাসী সঞ্জয় দাশ, দক্ষিণ সারোয়াতলী গ্রামের সজল দাশ গুপ্ত এবং সারোয়াতলী ইউনিয়ন পরিষদে গ্রাম পুলিশ হিসেবে দায়িত্বরত দিদারুল আলম।
অভিযুক্ত আট পুলিশের সবাই ঘটনার সময় বোয়ালখালী থানায় কর্মরত ছিলেন। ঘটনার পর হিমাংশু, আতিক উল্লাহ, আরিফুরকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। বাকি পুলিশ সদস্যদের বদলি করা হয়। অভিযুক্ত সঞ্জয় দাশ দক্ষিণ সারোয়াতলী গ্রামের অসিত দাশের ছেলে। সজল দাশ গুপ্ত একই গ্রামের মৃত সমর দাশ গুপ্তের ছেলে এবং সঞ্জয়ের বাড়ির কেয়ারটেকার হিসেবে মামলার আরজিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া সজল দাশ গুপ্ত বোয়ালখালী থানা পুলিশের সোর্স হিসেবে এলাকায় পরিচিত। দিদারুল আলমকেও ঘটনার পর চাকরিচ্যুত করা হয়।
২০১৮ সালের ২৭ মে সন্ধ্যায় আদালত থেকে নামার পথে চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালী থানার লালদিঘীর পাড় এলাকা থেকে সাদা পোশাকে একদল পুলিশ সমর কৃষ্ণ চৌধুরীকে মাইক্রোবাসে তুলে নেয়। পরে তাকে ইয়াবা ও অস্ত্রসহ গ্রেফতারের কথা জানিয়ে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠায় জেলার বোয়ালখালী থানা পুলিশ। পকেটে কলম নিয়ে আইনজীবীর বেশে থাকা সমরের ছবি গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সারাদেশে তোলপাড় ওঠে। গণমাধ্যমে একের পর এক সংবাদ পরিবেশিত হতে থাকে, টেলিভিশনের টকশোতেও গুরুত্ব পায় ঘটনাটি। এতে চাপের মুখে পড়ে পুলিশ। একপর্যায়ে তৎকালীন ডিআইজি এস-এম-মনিরুজ্জামানের সঙ্গে ঘটনার নেপথ্য ইন্ধনদাতা লণ্ডনপ্রবাসী সঞ্জয় দাশের ঘনিষ্ঠতার তথ্য উঠে আসে গণমাধ্যমে। বদলি করা হয় ডিআইজিকে। তদন্তের মাধ্যমে বোয়ালখালী থানার অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের সাময়িক বরখাস্ত ও বদলি করা হয়। ওই বছরের ১২ জুলাই জামিনে মুক্তি পান সমর কৃষ্ণ চৌধুরী।
মামলার আরজিতে বলা হয়েছে, লণ্ডনপ্রবাসী সঞ্জয় দাশের সঙ্গে তার একই গ্রামের মৃত চিত্তরঞ্জন দাশের ছেলে স্বপন দাশের পরিবারের সঙ্গে জমিজমা নিয়ে বিরোধ চলছিল। সমর কৃষ্ণ শিক্ষানবিস আইনজীবী হিসেবে তাদের আইনি সহায়তা দিচ্ছিলেন। এতে সঞ্জয় ও সজল বাদি সমরের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ষড়যন্ত্রের জাল বুনেন। ধনাঢ্য সঞ্জয়ের সঙ্গে তৎকালীন ডিআইজি এস-এম-মনিরুজজামানের সান্নিধ্য থাকায় ডিআইজির মাধ্যমে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যরা বাদীর ক্ষতি করেন।
বাদী সমর কৃষ্ণ চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘২০১৮ সালের ২৭ মে আমি পেশাগত কাজ সেরে আদালত থেকে নামছিলাম। আমার সঙ্গে তিনজন আইনজীবী ছিলেন। তাদের সামনেই আমাকে জোরপূর্বক সাদা পোশাকে একদল লোক মাইক্রোবাসে তুলে নেয়। তখন আইনজীবীরা তাদের পরিচয় জানতে চাইলে কয়েকজন পুলিশের আইডি কার্ড দেখান। তাদের সঙ্গে লণ্ডনপ্রবাসী সঞ্জয় দাশ এবং তাদের কেয়ারটেকার সজল দাশ গুপ্ত ঘটনাস্থলে ছিল। তারাই আমাকে দেখিয়ে দেয়। পুলিশ আমাকে নিয়ে বোয়ালখালী থানায় যায়। সেখানে হাজতে রেখে আমাকে নির্যাতন করে। রাতে অস্ত্র উদ্ধারের নামে আমাকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে নদীর ধারে একটি নির্জন এলাকায় নিয়ে পুলিশ আমাকে ক্রসফায়ারে হত্যার চেষ্টা করে। কিন্তু একটি ফোনকল আসায় তারা আবার আমাকে থানায় ফিরিয়ে নেয়। পরদিন আমার হেফাজত থেকে ইয়াবা ও অস্ত্র উদ্ধারের মিথ্যা অভিযোগ এনে আমাকে আদালতে চালান দেয়।’
সমর কৃষ্ণ জানান, গ্রেফতারের আগে বোয়ালখালী থানা পুলিশ তার বিরুদ্ধে মাদক আইনে আরও দু’টি মিথ্যা মামলা করে। মোট চারটি মামলা তদন্ত করে পিবিআই অভিযোগের সত্যতা না পেয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। আদালত এ সব মামলা থেকে তাকে অব্যাহতি দেন।
‘সঞ্জয় দাশ কিংবা সজল দাশ গুপ্তের সঙ্গে আমার কোনো বিরোধ ছিল না। আমি স্বপন দাশকে আইনি সহায়তা দিয়েছিলাম। আমি একজন শিক্ষানবিস আইনজীবী। বিচারপ্রার্থী মানুষকে আইনি সহায়তা দেওয়া আমার পেশা। এছাড়া স্বপন দাশের পরিবারের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে। শুধুমাত্র আইনি সহায়তা দেওয়ায় সঞ্জয় ও সজল মিলে টাকা ও ক্ষমতা ব্যবহার করে পুলিশকে দিয়ে আমাকে হয়রানি করেছে। মিথ্যা অভিযোগে আমাকে দেড়মাস জেল খাটতে হয়েছে’ বলেন সমর।
আইনজীবী জুয়েল দাশ সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, মামলার আরজিতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ১২০ (খ), ১৬১, ১৬৬, ২২০, ৩০৭, ৩২৩, ৩৬৪, ৩৭৯, ৩৮৫, ৩৮৬, ৩৮৭, ১৪৯, ৫০৬ ও ২১১ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।