Wednesday 22 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে নতুন বন্ধুরাষ্ট্র খুঁজতে হবে


৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২৩:৫৭ | আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৮:৩৮

ঢাকা: আগামী কয়েক বছরের মধ্যে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান না হলে বাংলাদেশ অস্থিতিশীল হয়ে ওঠার শঙ্কা রয়েছে। অভ্যন্তরীণভাবে এরইমধ্যে কিছু সমস্যা তৈরি হয়েছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সহায়তা করতে পারে এমন নতুন নতুন বন্ধু রাষ্ট্রকে খুঁজে বের করতে হবে। সবমিলিয়ে দ্রুত সময়ে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে কূটনৈতিকভাবে আরও জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে বাংলাদেশকে। একইসঙ্গে পররাষ্ট্র নীতিতে সমুদ্র অর্থনীতি ও বঙ্গোপসাগরকে প্রাধান্য দিতে হবে। দরকষাকষির ক্ষেত্রে বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর প্রতি বিশ্বাস ও গ্রহণযোগ্যতাও ধরে রাখতে হবে। দেশের ইতিবাচক সব দিক নিয়ে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশকে আরও ব্র্যান্ডিং করতে হবে।

বিজ্ঞাপন

বুধবার (৯ সেপ্টেম্বর) সারাবাংলা ডটনেটের নিয়মিত আয়োজন সারাবাংলা ফোকাসে ‘সাম্প্রতিক সময়ে এশিয়ার দেশগুলোর কূটনৈতিক তৎপরতা এবং বাংলাদেশ’ শীর্ষক আলোচনায় বক্তারা এ সব কথা বলেন।

সারাবাংলা ডটনেটের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট এমএকে জিলানীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে যুক্ত ছিলেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ফেলো শহীদুল হক, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক লাইলুফার ইয়াসমিন। অনুষ্ঠানটি একযোগে সারাবাংলা ডটনেটের ফেসবুক পেইজ, ইউটিউব চ্যানেল ও বেসরকারি টেলিভিশন জিটিভিতে প্রচারিত হয়ে থাকে।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বলেন, ‘কূটনীতি কিন্তু ভূ রাজনীতি ও ভূ-অর্থনীতি নিয়ে চলে। ভূ রাজনীতি একটি চলমান প্রক্রিয়া। করোনার আগে ভূ রাজনীতি একটি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আসছিল এবং সেটা এশিয়া কেন্দ্রিক। করোনার কারণে তা আরও বেশি অগ্রগামী হয়েছে। নানা কারণে ভূ রাজনীতিতে পরিবর্তন আসছে। এর একটি কারণ হচ্ছে বৈশ্বিকভাবে নেতৃত্বে পরিবর্তন এসেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যেসব অনুমতি নিয়ে বিশ্ব রাজনীতি চলছিল, তার অনেকগুলো অনুমিতিই এখন ভেঙে পড়ছে। এটার সঙ্গে সমন্বয় করেই আমাদের কূটনীতি চালিয়ে যেতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের যদি বাংলাদেশ স্থান না দিতো, আমরা নিজেরাই কিন্তু রোহিঙ্গাদের স্টেবিলাইজিং করেছি। নতুবা পুরোটাই (পুরো অঞ্চল) অস্থিতিশীল হয়ে যেত। আমরা কিন্তু বে-তে (বঙ্গোপসাগর) এমন এক অবস্থানে আছি পুরো বে টাকেই স্থিতিশীল বা অস্থিতিশীল করার ক্ষমতাই বাংলাদেশের আছে। আমার মনে হয়, এ জায়গটা থেকে বে কে দেখতে হবে। আমরা তো সব সময় ডাঙ্গায় বাস করি, এ জন্য সমুদ্রের গুরুত্ব কম বুঝি। সমুদ্রকে আমরা আমাদের তৃতীয় প্রতিবেশী ঘোষণা করেছিলাম। কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে আমরা সমুদ্রের চেয়ে অন্য জমিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। সমুদ্রকে আমাদের আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ।’

বিজ্ঞাপন

তিনি আরও বলেন, ‘অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করলে তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও একাডেমিশিয়ানদের মধ্যে যে সক্ষমতা, যোগাযোগ বা ফাইট, সেই ফাইটটা আমাদের এখানে নেই। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা সরকারি কর্মকর্তা ও একাডেমিশিয়ানদের মধ্যে একটি গ্যাপটি রয়েছে। আমাদের মনে হয় এ গ্যাপটি পূরণ করা দরকার।’

শহীদুল হক বলেন, ‘আমরা কূটনীতিতে সব সময় ভালো মন্দ বা ক্রিটিক্যাল থিংকিং করি। ওই আলোচনার সময় কোনো রাখা ডাক থাকে না। ওই আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে। নিজেদের মধ্যে আলোচনা বন্ধ করে দিলে হবে না। আমরা ব্যালেন্সিং এর কথা বলি, কিন্তু ব্যালেন্স করবেন সেখানে আপনাকে প্লে করতে হবে। অর্থাৎ একটি ক্রেডিবল ব্যালেন্সিং করতে হবে। একই ইস্যুতে ভিন্ন কথা বলা যাবে না। তারপরে হচ্ছে নেতৃত্ব- আমাদের এখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তিনি একজন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক নেতা, যাকে সামনে রেখে বাংলাদেশ যে কোনো ক্ষেত্রে যে কোনো ফাইট নিতে পারে, যে কোনো ডিপ্লোমেসি করতে পারে। এখন কথা হচ্ছে ওই লিডারশিপকে আপনি কীভাবে প্রজেক্ট করবেন। আপনি উনাকে কোনো ক্ষেত্রে কিভাবে ব্যবহার করবেন সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। সবচাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বিশ্বাস ও গ্রহণযোগ্যতা।’

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘ভূ রাজনীতি সবসময় পরিবর্তন হতে থাকে। পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের অবস্থান সেটা আমাদের দেখতে হবে। আমার দৃষ্টিতে আমরা যাদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ মনে করতাম, যে দুটি দেশকে বন্ধু মনে করতাম- ভারত ও চীন অত্যন্ত বিপজ্জনক সময়ে (রোহিঙ্গা ইস্যু) যে কোনোভাবেই হোক আমরা তাদের পাশে পাশে পাইনি। তারা যে আমাদের অসুবিধা সৃষ্টির জন্যে আমাদের দিকে আসেনি তা নয়, তারা তাদের স্বার্থ নিকট ভবিষ্যতের সেটাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমরা অনেকটা অসুবিধায় পড়েছি। ঠিক দিশেহারা বলব না, তবে আমরা খুব অবাক হয়েছিলাম আমাদের দুর্বলতা দেখে। আমরা বড় কাউকে আমাদের পাশে পাচ্ছি না। অর্থনৈতিকভাবে আমরা ভালো আছি। আমাদের সঙ্গে ব্যবসা করতে সবারই সুবিধা। কনজিউম্যার বেইজড হওয়ায় সবাই এখানে কিন্তু ব্যবসা করতে চাইবেন। সে কারণে আমরা চীন ও ভারতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কটা আমাদের অন্যরকম। শুধু প্রতিবেশী দেশ হিসেবে দেখলে চলবে না। ভৌগোলিক অবস্থান, ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ- এসব কারণ ভারতের সঙ্গে আমাদের গভীর সম্পর্ক। বিভিন্ন সময়ে ভারতের সঙ্গে রাজনৈতিক টানাপোড়ন থাকলেও সম্পর্কের গভীরতা কিন্তু ছিলই। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক সব সময় ঘনিষ্ঠ থাকবে এবং কূটনৈতিক যারা আছেন তারা সেটা সব সময় বজায় রাখার চেষ্টা করবেন এবং এটা আমাদের করতেই হবে নিজেদের স্বার্থে। অন্যান্য অঞ্চলের মধ্যে এখন মাথা ব্যথা হয়ে দাঁড়াবে মধ্যপ্রাচ্য। সেটা আমাদের প্রবাসী শ্রমিকদের একটি বড় ক্ষেত্র। আমাদরে ঘাড়ে চেপে আছে বড় সংখ্যক উদ্বাস্তু, এটা আমাদরে অর্থনীতির জন্য একটা বোঝা বটেই। তাদের জীবন যাপন সহজ করার চেষ্টা করেছি। পাশাপাশি আমাদের মূল লক্ষ্য তাদেরকে (রোহিঙ্গা) ফেরত পাঠানো যেকরেই হোক। এক্ষেত্রে আমাদের বন্ধু খুজে বের করতে হবে যারা আমাদের সহায়তা করতে পারবে।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার যে সংস্কৃতি তা খুবই ক্লোজড। জ্ঞানের জগত ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার জগতের মধ্যে আমাদের এখানে একটি শক্ত দেওয়াল আছে। এই দেওয়াল ভাঙতে না পারলে এই সমস্যার সমাধান হবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘বঙ্গোপসাগর নিয়ে আমাদের যে গুরুত্ব তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করার কিছু নেই। বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী হওয়ার কারণে অন্যদের কাছে আমাদের কী গুরুত্ব আমি তা বলছিলাম।’

তৌহিদ হোসেন আরও বলেন, ‘আমরা গত তিন বছরে যে ধরনের সমস্যায় পড়েছি, রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমরা একটি বড় ধরনের সমস্যায় পড়েছি। আমরা এখানে একটি স্ট্যাবিলাইজিং ফ্যাক্টর হয়েছি। যদি তাদের ঢুকতে না দিতাম বা পার করে দেওয়ার চেষ্টা করতাম, এই অঞ্চলে একটি অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হতো। সেই হিসেবে বাংলাদেশের যে সিদ্ধান্ত ছিল তাদের আসতে দেওয়া এবং আশ্রয় দেওয়া সেটা একটি বড় ফ্যাক্টর হিসাবে কাজ করেছে। আমার ভয় যেটা আমরা কী এটা স্থিতিশীল করেছি, না অস্থিতিশীল করেছি? না অস্থিতিশীলতাকে পিছিয়ে দিয়েছি? আমার আশঙ্কা যদি এটা সমাধান না হয় সময়ে, সময় মানে বিশ বছর হলে চলবে না, ৩ বছর পার হয়ে গেছে, যদি আগামী কয়েক বছরের মধ্যে সমাধান না হয় নতুন করে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হবেই, সেটা ঠেকানোর কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ প্রত্যেকট ঘটনার একটি নিজস্বতা আছে। আর কিছু কিছু সমস্যা তো এরইমধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। যদি এমনটি হয় আমরা শুধুমাত্র অস্থিতিশীলতাকে একটু শুধু পিছিয়ে দিয়েছে সেটাকে আমরা লাভজনক হিসাবে ধরে নিতে পারি না।’

অধ্যাপক লাইলুফার ইয়াসমিন বলেন, ‘আমরা দেশটিকে কিন্তু উঠিয়ে নিয়ে আরেকটা জায়গায় যেতে পারি না। দেশটা যেভাবে বা যেই অবস্থায় সেখান থেকেই আমাদের শক্তি ও দুর্বলতা নির্ণয় করতে হবে। ৭০, ৮০ বা ৯০ এর দশকে বাংলাদেশকে যখন আয়তনে ছোট রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে, সেখান থেকে কিন্তু এখন পরিবর্তন হয়েছে। সেই পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়ে বাংলাদেশের জনসংখ্যার যে একটা স্ট্রেন্থ আছে এটা একটা বিশাল মার্কেট… বাংলাদেশের যে পলিটিক্যাল স্ট্যবিলিটি সেটা কিন্তু বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আকর্ষণ তৈরি করেছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমরা যে বিভিন্ন অবস্থান নিয়েছি সেগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রশংসিত হয়েছে। বঙ্গোপসাগর এখন আমাদের জন্য সম্ভাবনার জায়গা খুলে দিয়েছে। ২০১৫, ১৬ বা ১৭ সালের পরে বাংলাদেশে যেভাবে বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগ এসেছে, বিভিন্ন দেশ যেভাবে প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে, সেক্ষেতেই বোঝা যায় বাংলাদেশ কিন্তু আগের বাংলাদেশ নেই। রোহিঙ্গা ইস্যুাতে আমরা সমস্যায় পড়েছি কিন্তু আমাদের দেখতে হবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কিভাবে আমাদের সহায়তা করছে।’

তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা ইস্যুটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সবসময় আমাদের স্মরণ করিয়ে দিতে হবে। একটি জনগোষ্ঠী যারা পিছিয়ে আছে, নির্যাতিত হয়েছে, আমরা কিন্তু তাদের পাশে ছিলাম, তাদের পক্ষ কথা বলেছি, যখন তাদের পাশে কেউ ছিল না। এটি বাংলাদেশের বিশাল একটি শক্তি। জাপান কিন্তু বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করতে চাচ্ছে, এসব বিষয়ও আমাদের মাথায় রেখে ফরেন পলিসি নির্ধারণ করতে হবে। পাশাপাশি যখনই কোন রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের তুলে ধরতে চেয়েছে তখনই পলিসি মেকার ও একাডেমিশিয়ানদের মধ্যে সেতুবন্ধন হয়েছে, সেখানে মনে হয় আমরা একটু পিছিয়ে আছি। ভারতে যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নীতি তৈরিতে ভূমিকা রাখে সেটা এখনও আমরা বাংলাদেশে পুরোপুরি দেখিনি।’

তিনি বলেন, ‘বিশ্বে এখন রেসপনসিবল পাওয়ার বা দায়িত্ব নেওয়ার মতো শক্তি নেই। রাষ্ট্রগুলো এখন ইন্টারেস্ট বেইজড কোয়ালিশনের দিকে যাচ্ছে। আমাদের লক্ষ্য রাখতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে কোন কোন রাষ্ট্র আমাদের বেশি সহায়তা দিতে পারবে। সেক্ষেত্রে বঙ্গোপসাগরে আমাদের যে একসেস, সেটা আমাদরে এমনভাবেই শক্তিশালী করেছে, সেটা আমাদের মাথায় রেখে নীতিগুলো নিতে হবে। আমি শুধু গভীর সমুদ্র বন্দরের কথাই বলছিনা, বিভিন্ন করিডোরের সঙ্গে আমাদের যুক্ত হওয়ার কথা চিন্তা করতে হবে।’

টপ নিউজ দক্ষিণ এশিয়া রোহিঙ্গা সারাবাংলা ফোকাস

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর