‘আসনভিত্তিক থোক বরাদ্দ, জনগণের অর্থে এমপিদের সম্পদ গড়ার সুযোগ’
১২ আগস্ট ২০২০ ১৫:৩৪ | আপডেট: ১২ আগস্ট ২০২০ ১৭:১৩
ঢাকা: সরাসরি উন্নয়নের নামে সংসদীয় আসনভিত্তিক থোক বরাদ্দ জনগণের অর্থে সংসদ সদস্যদের (এমপি) সম্পদশালী করার অবারিত সুযোগ বলে মনে করছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এ বরাদ্দ বন্ধ অথবা চালু রাখতে হলে জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণের মতো নীতিমালা তৈরির আহ্বান জানিয়ে টিআইবি।
বুধবার (১২ আগস্ট) দুপুরে টিআইবির কার্যালয় থেকে আয়োজিত এক ওয়েবিনারে ‘সংসদীয় আসনভিত্তিক থোক বরাদ্দ: অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। অনুষ্ঠানে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এসব কথা বলেন।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সংসদ সদস্যদের প্রধান তিনটি কাজ- আইন প্রণয়ন করা, নিজ এলাকার জনগণের প্রতিনিধিত্ব করা এবং সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। কিন্তু এ কাজের বাইরে সংসদ সদস্যদের থোক বরাদ্দ দিয়ে জনগণের জন্য কাঙিক্ষত উন্নয়ন করতে যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে সেটি কোনভাবেই স্বচ্ছতার সঙ্গে হচ্ছে না। যা সংবিধান পরিপন্থী বলে মনে করি।’
তিনি বলেন, ‘সংসদীয় আসনভিত্তিক থোক বরাদ্দ বাস্তবায়নে কোনো নীতিগত কাঠামো নেই। এ প্রকল্পের আইনগত ভিত্তি অত্যন্ত দুর্বল। এমনকি নেই বললেই চলে। ফলে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, সমন্বয়হীনতা এবং দুর্নীতির ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্বচ্ছতার মাপকাঠিতেও ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। থোক বরাদ্দ থেকে পরিচালিত প্রকল্পের কোনো তথ্য জনগণের জন্য প্রকাশিত হয় না। কোথাও কোথাও বিলবোর্ড আকারে যা থাকছে সেটি আসলে তথ্য বলতে যা বুঝায় তার কিছুই থাকে না। আবার জবাবদিহিতা বলতে কোনো সুযোগই নেই। প্রকল্প বাস্তবায়ণ সংক্রান্ত কোনো পরীক্ষণ বা মূল্যায়ণের কোনো ব্যবস্থাও নেই। বরাদ্দকৃত অর্থটি যেহেতু সরাসরি জনগণের জন্য, তাই এতে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ থাকার কথা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে দলীয়করণ এবং রাজনৈতিক প্রভাব ও ব্যক্তি স্বার্থদ্বন্দ্বের কারণে জনগণের অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ থাকে না। আর এসবের কারণেই দুর্নীতির একটা অবারিত সুযোগ সৃষ্টি হয় বলে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘টিআইবির গবেষণায় সবচেয়ে বেশি যেটি উঠে এসেছে তা হল- এ অর্থের মাধ্যমে সংসদ সদস্যরা স্থানীয় রাজনৈতিতে তাদের অবস্থার সম্প্রসারণ করছে। সেই সঙ্গে জনগণের অর্থে নিজেদেরকে সম্পদশালী করার অবারিত একটি সুযোগ হিসেবে পেয়েছে এ প্রকল্প। তাই এটি নিয়ন্ত্রণ করা খুব প্রয়োজন। আমরা গবেষণা প্রতিবেদনটি অতি দ্রুত চেষ্টা করবে অংশীজন ও সংসদ সদস্যদের কাছে পাঠাবো। যাতে করে এ ধরণের সমস্যা সমাধানে কার্যকরী প্রদক্ষেপ করতে পারে সরকার।’
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘একজন সংসদ সদস্য আইন প্রণয়ন বা সংস্কার, জনপ্রনিধিত্ব করা এবং সরকারকে জনগণের কাছে জবাবদিহি করার মত মৌলিক এ তিনটি বিষয় ছাড়া আর কোনো কিছুতে জড়িত থাকা সাংবিধানিক চর্চার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কিন্তু শেষের যে ভূমিকাটি সেটি পালনে সাংঘর্ষিক হয়ে যায় যদি কোনো সংসদ সদস্য এককভাবে কিংবা সামষ্টিকভাবে কোনো উন্নয়ণ কাজ বাস্তবায়ণের দায়িত্বটা নিয়ে নেন। তাহলে সাংসদ কিভাবে সরকারকে জনগণের কাছে জবাবদিহিতার আওতায় আনবেন। এ কারণে টিআইবি মনে করছে, এ চর্চাটি অব্যাহত না থাকুক। কিন্তু যেহেতু এটি সংস্কৃতির চর্চা হিসেবে দাঁড়িয়েছে তাই এটি যদি অব্যাহত রাখতে চান সাংসদরা তবে গত ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা নিরপেক্ষভাবো বিশ্লেষণ করে একটি শক্তিশালী নীতিকাঠামো তৈরি করে অগ্রসর হতে হবে।’
টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম অফিসার জুলিয়েট রোজেটি বলেন, ‘গবেষণায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ণ (আইআরআইডিপি) শীর্ষক প্রকল্পের আওতাধীন স্কিমগুলো পর্যবেক্ষণের জন্য বাংলাদেশের ৩০০টি সংসদীয় আসন থেকে পদ্ধতিগত দৈবচয়নের ভিত্তিতে মোট ৫০টি আসন নির্বাচন করা হয়েছে। প্রতিটি আসনের একাধিক উপজেলা থেকে একটি উপজেলাকে দৈবচয়নের মাধ্যমে নির্বাচন করা হয়েছে। নির্বাচিত প্রতিটি উপজেলায় উক্ত প্রকল্পের আওতাধীন বাস্তবায়িত স্কিমের তালিকা থেকে আইআরআইডিপি-১ এর
১০টি করে মোট ৫০০টি এবং ও আইআরআইডিপি-২ এর ৩টি করে মোট ১৫০টি স্কিম পদ্ধতিগত দৈবচয়নের ভিত্তিতে নির্বাচন এবং এই ৬৫০টি স্কিমের ওপর তথ্য সংগ্রহের পরিকল্পনা করা হয়। তবে আইআরআইডিপি-১-এর ৩১টি স্কিম নথিতে যে উপজেলার আওতায় রয়েছে মাঠ পর্যায়ে সেগুলো অন্য উপজেলার আওতাভুক্ত থাকায় এবং প্রাকতিক প্রতিকূলতার জন্য ৫টি স্কিম পর্যবেক্ষণ করা যায় নি। অন্যদিকে নমুনায়িত এলাকায় কাজ সম্পন্ন হওয়ার প্রেক্ষিতে আইআরআইডিপি-২ এ অতিরিক্ত ১৪টি স্কিম অর্থাৎ চড়ান্তভাবে মোট ৬২৮টি (আইআরআইডিপি-১ এ ৪৬৪টি ও আইআরআইডিপি-২ এ ১৬৪টি) স্কিম পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে।‘
তিনি বলেন, ‘আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ণে ক্ষমতাসীন দলের ব্যক্তি বিশেষের তহবিলে সর্বনিম্ম ৪৭ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত কমিশন বাণিজ্য হয়। অর্থাৎ কোনো ঠিকাদার এসব প্রকল্পের কাজ পেতে হলে বা করতে হলে এ পরিমাণ টাকা কমিশন হিসাবে দিতে হয়। আবার ৬২৮টি স্কিমের মধ্যে ৩৩ শতাংশ কাজই ভালো হয়নি। কিন্তু অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে। এমনকি কোনো রকমের কাজ না করেও এক বছর পর চার শতাংশ ঠিকাদার তাদের জামানত বুঝে পেয়েছে। এমন একাধিক অনিয়ম প্রকাশিত গবেষণায় তথ্যচিত্রসহকারে উপস্থাপন করেন টিআইবির এ কর্মকর্তা।’