নীতিমালা কঠোরতায় গণস্বাস্থ্যের কিটের খবর মিলছে না আরও ২ মাসেও
২২ জুলাই ২০২০ ১১:০৮
ঢাকা: অ্যান্টিবডি ও অ্যান্টিজেন কিট উৎপাদন, আমদানি, বিপণন ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ঔষধ প্রশাসন সম্প্রতি যে নীতিমালা তৈরি করেছে, সেটির আলোকে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র উদ্ভাবিত ‘জিআর কোভিড-১৯ ডট ব্লট’ কিটের মানোন্নয়ন কঠিন হয়ে পড়েছে। সপ্তাহ খানেক আগে প্রণীত নীতিমালা অনুসরণ করে কিটের ইন্টারনাল ও এক্সটার্নাল ভ্যালিডেশন শেষ করতে আরও অন্তত দুই মাস সময় লাগবে গণস্বাস্থ্যের। তাতে ইতিবাচক ফল মিললেও আগামী সেপ্টেম্বরের আগে গণস্বাস্থ্য কিটের রেজিস্ট্রেশনের বিষয়টি চূড়ান্ত হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই।
অবশ্য এতেও দমে যাচ্ছেন না গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা। প্রণীত নীতিমালা অনুসরণ করে অ্যান্টিবডি ও অ্যান্টিজেন কিটের মানোন্নয়নে কাজ করচ্ছেন তারা। গবেষক দলের প্রধান ড. বিজন কুমার শীলের নেতৃত্বে দিন রাত চলছে গবেষণা। আর সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দাফতরিক যোগাযোগ রক্ষা করছেন ‘জিআর কোভিড-১৯ ডট ব্লট’ প্রকল্পের কো-অর্ডিনেটর ডা. মুহিব উল্লাহ খোন্দকার।
অ্যান্টিবডি কিট
সংবেদনশীলতা (সেনসিটিভিটি) ও নির্দিষ্টকরণের (স্পেসিফিসিটি) ন্যূনতম সীমা গ্রহণযোগ্য মাত্রায় (যথাক্রমে ৯০ ও ৯৫ শতাংশ) না হওয়ায় অ্যান্টিবডি কিটের রেজিস্টেশন আবেদন নামঞ্জুর করে ঔষধ প্রশাসন। গত ২৫ জুন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে জানিয়ে দেওয়া হয়, অ্যান্টিবডি টেস্ট কিটের জন্য মার্কিন কেন্দ্রীয় ওষুধ সংস্থা ফেডারেল ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) নির্ধারিত নীতিমালা অনুসরণ করে কিটের মানোন্নয়ন করতে পারলে পুনঃআবেদনের সুযোগ নিতে করতে পারবে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। এ ব্যাপারে ঔষধ প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতাও করা হবে।
ঔষধ প্রশাসনের দেওয়া শর্ত অনুযায়ী এফডিএ’র নীতিমালা অনুসরণ করে অ্যান্টিবডি কিটের মানোন্নয়ন করে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। এর পর গত ৫ জুলাই প্রয়োজনীয় নথিসহ ঔষধ প্রশাসনের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন ‘জিআর কোভিড-১৯ ডট ব্লট’ প্রকল্পের তিন বিজ্ঞানী ড. বিজন কুমার শীল, ডা. মুহিব উল্লাহ খোন্দকার ও ড. নিহাদ আদনান।
ওই বৈঠকে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা ঔষুধ প্রশাসনকে জানান, ইন্টারনাল ভ্যালিডেশনের মাধ্যমে তারা নিশ্চিত হয়েছেন তাদের অ্যান্টিবডি কিটের সেনসিটিভিটি এখন ৯৭ শতাংশ। অতএব ইন্টারনাল ভ্যালিডেশনের ভিত্তিতে যেন অ্যান্টিবডি কিটের অস্থায়ী অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু ঔষধ প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়, এক্সটার্নাল ভ্যালিডেশন করাতেই হবে। এ জন্য আন্তর্জাতিক উদরময় রিসার্স ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশকে (আইসিডিডিআর,বি) ডেডিকেটেড করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, অ্যান্টিবডি কিটের ভ্যালিডেশনের জন্য যে কারিগরি ব্যবস্থাপনা থাকা দরকার, সেটি এই মুহূর্তে আইসিডিডিআর,বি’র নেই। সবকিছু ঠিক করে ভ্যালিডেশনের কাজ শুরু করতে আরও অন্তত দুই মাস সময় লাগবে তাদের। এমন বাস্তবতায় ঔষধ প্রশাসনকে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানায় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। তখন ঔষুধ প্রশাসনের পক্ষ থেকে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে বলা হয় অ্যান্টিবডি কিটের ‘প্যানেল টেস্ট’ করিয়ে আনতে।
জানা গেছে, এই প্যানেল টেস্ট করার জন্য যে মেশিন দরকার, সেটা বাংলাদেশে নেই। আমেরিকাসহ উন্নত দুই/তিনটি দেশে এই মেশিন আছে। এখন প্যানেল টেস্ট করতে হলে কিট নিয়ে আমেরিকা যেতে হবে। অথবা আমেরিকা থেকে মেশিন কিনে আনতে হবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ‘জিআর কোভিড-১৯ ডট ব্লট’ কিট প্রকল্পের কো-অর্ডিনেটর ডা. মুহিব উল্লাহ খোন্দকার সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা খবর নিয়েছি, পৃথিবীতে মাত্র দুই/তিনটি কোম্পানি এই মেশিন তৈরি করে। একটা মেশিনের দাম ১ লাখ ডলারে ওপরে। তাছাড়া চাইলেই এ মেশিন কেনা যায় না। এই ক্রাসিস মুহূর্তে মেশিনের ডিমান্ড আরও বেড়ে গেছে। মেশিন কিনতে চাইলে অন্তত দুই মাস আগে সিরিয়াল দিতে হবে। আমাদের হাতে এত সময় নেই, টাকাও নেই। এ ব্যাপারে আমরা ঔষধ প্রশাসনের কাছে সহযোগিতা চেয়েছি। দেখা যাক তারা কী করে।’
‘তাছাড়া অ্যান্টিবডি কিটের প্যানেল টেস্টের জন্য যে কিট প্রয়োজন, তার একটার দাম ১৫ হাজার টাকা করে। সব মিলে পুরো বিষয়টি আমাদের জন্য কঠিন হয়ে গেছে,’— বলেন ডা. মুহিব উল্লাহ খোন্দকার।
অ্যান্টিজেন কিট
গত ১২ জুলাই অ্যান্টিজেন কিটের জন্য যে নীতিমালা তৈরি করেছে ঔষধ প্রশাসন, সেটার আলোকে ‘জিআর কোভিড-১৯ ডট ব্লট’ অ্যান্টিজেন কিটের রেজিস্ট্রেশন পাওয়াও কঠিন হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা।
সূত্রমতে, নীতিমালায় বলা হয়েছে— অ্যান্টিজেন কিটের নূন্যতম সংবেদনশীলতা (সেনসিটিভিটি) হতে হবে ৮০ শতাংশ। মার্কিন কেন্দ্রীয় ওষুধ সংস্থা ফেডারেল ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফডিএ) নীতিমালাতেও একই সেনসটিভিটিকে মানদণ্ড ধরা হয়েছে। তবে এই মান স্পর্শ করার জন্য যে কারিগরি অবকাঠামো দরকার, তার ধারের কাছেও নেই বাংলাদেশ। সুতরাং এই নীতিমালা অনুসরণ করে কিট তৈরি বাংলাদেশে রীতিমতো অসম্ভব।
জানা গেছে, এই নীতিমালার আলোকে অ্যান্টিজেন কিটের ভ্যালিডেশনের জন্য ফরম পূরণ করতেই দুই/তিন সপ্তাহ লেগে যাবে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিজ্ঞানীদের। যিনি এই নীতিমালা তৈরি করেছেন, তিনিও ঠিকমতো বিষয়টি বুঝেছেন কি না— তা নিয়েও সন্দেহ পোষণ করছেন সংশ্লিষ্টরা। ধারণা করা হচ্ছে, এফডিএ’র নীতিমালাটিই অপরিবর্তিত অবস্থায় ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্টদের হাতে। আর সেটিই এখন অনুসরণ করতে হবে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিজ্ঞানীদের।
এ প্রসঙ্গে ডা. মুহিব উল্লাহ খোন্দকার সারাবাংলাকে বলেন, ‘অ্যান্টিজেন কিটের ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশ ভারত সংবেদনশীলতা (সেনসিটিভিটি) নির্ধারণ করেছে ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ। আর বাংলাদেশে ঔষধ প্রশাসন আমাদের জন্য সেনসিটিভিটি নির্ধারণ করেছে ৮০ শতাংশ। এই নীতিমালা আমাদের কাজকে অনেক কঠিন করে দিয়েছে। তারপরও ঔষধ প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি এই জন্য যে, অন্তত একটা নীতিমালা তারা প্রণয়ন করতে পেরেছে।’
এদিকে অ্যান্টিজেন কিট তৈরির ক্ষেত্রে সেনসিটিভিটি ৮০ শতাংশ নির্ধারণ করে দিলেও বিদেশ থেকে আমদানির ক্ষেত্রে সেনসিটিভিটি মাত্রা নির্ধারণ করা হয়নি। বরং ঔষধ প্রশসানের নীতিমালায় বলা হয়েছে, যেসব দেশ থেকে অ্যান্টিজেন কিট আমদানি করা হবে, সেসব দেশের জন্য নির্ধারিত মাত্রা বাংলাদেশের জন্য গ্রহণযোগ্য মাত্রা বলে বিবেচিত হবে। ঔষুধ প্রশাসনের এই নীতিমালায় কিট উৎপাদনের চেয়ে আমদানিতে বেশি উৎসাহ দেওয়া হয়েছে— এমনটিই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ প্রসঙ্গে ডা. মুহিব উল্লাহ খোন্দকার বলেন, ‘দেশের বাইরে থেকে আনা ফিনিশড প্রোডাক্টের কোনো সেনিসিটিভিটি মাত্রা নির্ধারণ করা হয়নি। কিন্তু লোকাল প্রডাক্টের সেনসিটিভিটি মাত্রা অস্বাভাবিক পর্যায়ে ধরা হয়েছে। বিষয়টি খুবই পরিষ্কার যে, আমদানিতেই তাদের আগ্রহ বেশি।’
২ মাস অ্যান্টিজেন কিট অ্যান্টিবডি কিট ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর কঠোরতা গণস্বাস্থ্যের কিট নীতিমালা