করোনার ভুয়া সার্টিফিকেট আঘাত হেনেছে দেশের ভাবমূর্তিতে
১০ জুলাই ২০২০ ২০:২৩
ঢাকা: নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড ১৯) আতঙ্কে পুরো বিশ্ব জর্জরিত। করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে মানুষের জীবনের হিসাব। ঠিক নেই অর্থনীতির চাকাও। আমাদের দেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয় মার্চে। সেইসময় স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি মাথায় রেখে সব ধরনের পাবলিক পরিবহন চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। এমনকি বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো এদেশেও বিমান চলাচল বন্ধ ছিল। বেশ কিছুদিন বন্ধ থাকার পর বিমান আবারও চালু করে দেওয়া হয়। আর ঠিক তখনই বিশ্বের কাছে ধরা পড়েছে এ ব দেশের অভ্যন্তরীণ অনিয়ম। বাংলাদেশ থেকে যারা বিদেশে গেছেন তাদের নকল করোনাভাইরাস সার্টিফিকেট বিশ্ববাসীকে এদেশ সম্পর্কে যেন এক অন্যরকম বার্তা দিয়েছে। বর্হিবিশ্ব এখন নড়েচড়ে বসেছে, আর বাংলাদেশের ওপর রেখেছে বাড়তি নজর।
ইতালি সরকার এরইমধ্যে বাংলাদেশি নাগরিকদের ইতালি প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। ৫ অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশের কোন নাগরিক ইতালিতে প্রবেশ করতে পারবে না। এমনকি কোনো বিদেশি নাগরিকও যদি বাংলাদেশ থেকে ইতালি যেতে চান তিনিও ইতালিতে প্রবেশ করতে পারবেন না। যা এদেশের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারাবিশ্ব যখন করোনার মহামারীকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখছে সেখানে আমরা গাফিলতি করেছি। কেননা আমাদের দেশে করোনার সার্টিফিকেট জাল হয়েছে, টাকার বিনিময়ে বিক্রি হয়েছে। আবার করোনার টেস্ট না করে নেগেটিভ বা পজেটিভ রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। কয়েকটি দেশে ভুয়া রিপোর্ট নিয়ে যাওয়ায় আটকও হয়েছে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি। শুধু তাই নয়, ৮ জুলাই ইতালির গণমাধ্যমে করোনার ভুয়া সার্টিফিকেট বিক্রির জন্য দেশটির গণমাধ্যমে এসেছে বাংলাদেশের নাম। এ সব কারণে বাংলাদেশের সুনাম অনেকটাই ব্যাহত হয়েছে বলে দাবি বিশেষজ্ঞদের।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে আমরা দেখেছি, বুধবার (৮ জুলাই) ইতালি ১২৫ বাংলাদেশিকে বিমানবন্দরে নামতে দেয়নি। এ ছাড়া মালয়েশিয়ায় করোনাভাইরাসের জাল নেগেটিভ রিপোর্ট বিক্রি করায় ৭ বাংলাদেশিকে আটক করেছে স্থানীয় পুলিশ। ঢাকা থেকে চীনের গুয়াংঝু শহরগামী একটি ফ্লাইটে ১৭ বাংলাদেশি যাত্রীর করোনা আক্রান্ত পাওয়ার তথ্য মিলেছে। এ ছাড়া ইতালিতে যাওয়া কয়েকটি ফ্লাইটে করোনা নেগেটিভ নিয়ে বাংলাদেশি নাগরিকরা গেলেও ইতালিতে টেস্ট করা হলে তাদের করোনা পজিটিভ এসেছে। যাদের প্রত্যেকেরই বাংলাদেশ থেকে নেওয়া করোনার নেগেটিভ সনদ ছিল। এ ছাড়া এপ্রিলে প্রবাসী বাংলাদেশীদের জাপানের একটি ফ্লাইটে চারজনের করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়। যার কারণে বাংলাদেশ থেকে বাণিজ্যিক ফ্লাইট পরিচালনার ক্ষেত্রে মে মাসে শর্ত আরোপ করে দেশটি। এ কারণে বাংলাদেশি কোনো নাগরিক এখন জাপানে যেতে পারছেন না। দক্ষিণ কোরিয়াগামী চার্টার্ড ফ্লাইটের ছয় বাংলাদেশি এবং একজন কোরীয় নাগরিকের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। ২১ জুন দক্ষিণ কোরিয়া বাংলাদেশিদের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করেছে।
করোনা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশিদের জন্য ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, বাহরাইন, ওমান, চীন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো।
বিমান বিশেষজ্ঞ আশীষ রায় চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ জন্য আমরা নিজেরাই দায়ী। পুরো বিশ্বের কাছে আমরা ছোট হয়ে গেলাম। আমাদের সুনাম ক্ষুণ্ন হলো। আমরা পরিচিতি পেলাম করোনার নকল সার্টিফিকেট হিসেবে। এই বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে না পারলে বহির্বিশ্বে আমরা বিমান চালাতে পারব না। আমাদের লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে যাবে। মূলত দেশের সুনাম নষ্ট হলো। সেই জন্য যারা এই করোনা সার্টিফিকেট জাল করেছে তাদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থান নিতে হবে। তা না হলে সামনে যে দেশগুলোতে বিমান চালু হবে তারাও নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দেবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকারিভাবে ২/৩টি প্রতিষ্ঠানকে ঘোষণা করতে হবে যারা প্রবাসীদের নিয়ে কাজ করবে। আমরা যদি নমনীয় থাকি তাহলে ইতালি যা করেছে সামনে তার চেয়েও খারাপ কিছু দেখতে হবে আমাদের।’
বিমান বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদ আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘কূটনৈতিকভাবে বিষয়টি সমাধান করতে হবে। বাংলাদেশে যেভাবে করোনার সংখ্যা বাড়ছে তাতে অন্যান্য দেশ বাংলাদেশের ওপর বাড়তি নজর রাখছে। যখন কোন বিমানবন্দর আমাদের নাগরিকদের করোনা পজেটিভ পাবে না তখন আমাদের দেশের ওপর তাদের বিশ্বাস তৈরি হবে। করোনার সার্টিফিকেট জাল, টেস্ট না করে রিপোর্ট— এসব কী ভাবা যায়? বিশ্বের কাছে আমাদের সুনাম আর থাকলো না। এরইমধ্যে কয়েকটি দেশে কিছু নাগরিক আটকও হয়েছেন। ৩ মাস যদি ইতালি বাংলাদেশ থেকে যাত্রী না নেয় তাহলে অনেক প্রবাসী চাকরি হারাবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, সরকার কঠোর না হলে বিমানখাত ধ্বংস হবে।’
বিদেশে নিষেধাজ্ঞার ব্যাপরে সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই। এটা আমাদের জন্য লজ্জার। ইতালি বাংলাদেশিদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। ইতালির এমন সিদ্ধান্তে আমাদের সম্মানহানি হলো এতে কোনো সন্দেহ নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের যারা নাগরিক আছেন তারাও দেশে এসে ঠিকমতো কোয়ারেনটাইন পালন করেননি। এই ব্যাপারটিকেও বাদ দেয়া যায় না। আমরা সিভিল এভিয়েশন দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছি। আর কিছু মানুষের জন্য আমাদের সম্মান ম্লান হয়ে যাচ্ছে। বিমানে দুই দফা স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। তবে সার্টিফিকেট জাল হলে আমাদের কিছু করার থাকে না। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের ভাবা দরকার।’
ইতালিতে নিষেধাজ্ঞা করোনা জাল সার্টিফিকেট জাল সার্টিফিকেট বর্হিবিশ্বে বাংলাদেশের সুনাম