তিন ধাপে মানবপাচার করতেন হাজী কামাল
১ জুন ২০২০ ২১:১৬
ঢাকা: গত ২৮ মে লিবিয়ার মিজদাহ শহরে নৃশংস হত্যাকাণ্ডে ২৬ বাংলাদেশি নিহতের ঘটনায় মানব পাচারকারী চক্রের মূল হোতা হাজী কামালকে রাজধানীর শাহজাদপুর থেকে গ্রেফতার করেছে র্যাব-৩। র্যাবকে হাজী কামাল জানিয়েছেন, তিনটি ধাপে পাচারকারী সিন্ডিকেট বাংলাদেশ থেকে লিবিয়ায় মানবপাচার করে থাকে।
সোমবার (১ জুন) দুপুরে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে র্যাব-৩। র্যাবের সিও লেফটেন্যান্ট কর্নেল রকিবুল হাসান এ সব তথ্য জানান।
সিও জানান, বিদেশ যেতে চান এমন লোকদের প্রথমে বাছাই করতেন পাচারকারী চক্রের সদস্যরা। দ্বিতীয় ধাপে তাদের বাংলাদেশ থেকে লিবিয়ায় পাঠানো হতো। এরপর লিবিয়া থেকে সমুদ্রপথে তাদের ইউরোপের দেশ ইতালিতে পাঠানোর চেষ্টা করতে। পুরো প্রক্রিয়াটি শেষ করতে পাচারকারী চক্রের একাধিক সদস্য ধাপে ধাপে কাজ করতেন।
আরও পড়ুন: লিবিয়ায় হত্যাকাণ্ড: পরিবারে শোকের ছায়া
পাচারকারী চক্রের সদস্যরা প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্বপ্ন আয়ের মানুষদের কম খরচে উন্নত দেশে পাঠানোর আশ্বাস দিয়ে আকৃষ্ট করতেন। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় অনেকেই তাদের প্রস্তাবে সাড়া দিতেন। বিদেশ গমনেচ্ছুকদের পাসপোর্ট তৈরি, ভিসা সংগ্রহ, টিকেট ক্রয় এ সব কাজ সিন্ডিকেটের সদস্যরা সম্পন্ন করতেন। পরবর্তী সময়ে তাদের এককালীন বা ধাপে ধাপে ইউরোপের দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হতো। লিবিয়া হয়ে ইউরোপে পাঠাতে একেকজনের কাছ থেকে ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা নেওয়া হতো। চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা নেওয়া হতো লিবিয়ায় যাওয়ার আগে। বাকি টাকা লিবিয়ায় পৌঁছানোর পর তাদের স্বজনদের কাছ থেকে নেওয়া হতো।
আরও পড়ুন: ১০ বছর ধরে মানব পাচার করত এই কামাল
বাংলাদেশ থেকে লিবিয়ায় পাঠানো
বাংলাদেশ থেকে লিবিয়ায় পাঠানোর ক্ষেত্রে এই চক্রের সদস্যরা বেশ কয়েকটি রুট ব্যবহার করে থাকেন। সেই রুটগুলো তার সুযোগ-সুবিধা অনুযায়ী পরির্বতন কিংবা নতুন রুট নির্ধারণ করে থাকেন। সম্প্রতি পাচারকারীরা যে রুটটি ব্যবহার করছিল তা হলো বাংলাদেশ-কলকাতা-মুম্বাই-দুবাই-মিশর-বেনগাজী-ত্রিপলী (লিবিয়া)। দুবাইয়ে পৌঁছানোর পর অভিবাসন প্রত্যাশীদের বিদেশি এজেন্টদের তত্ত্বাবধানে ৭/৮দিন রাখা হতো।
আরও পড়ুন: লিবিয়ায় নিহত ২৩, আহত ১২ জনের পরিচয় প্রকাশ
দুবাই থেকে বেনগাজীতে পাঠানোর জন্য বেনগাজী থেকে এজেন্টরা কথিত ‘মরাকাপা’ নামে একটি ডকুমেন্ট দুবাইয়ে পাঠাতো। এরপর সেই ডকুমেন্ট নিয়ে বিদেশি এজেন্ট অভিবাসন প্রত্যাশীদের মিশর ট্রানজিট নিয়ে লিবিয়ার বেনগাজীতে পাঠাতেন। বেনগাজী থেকে বাংলাদেশি এজেন্টদের সহযোগিতায় তাদের ত্রিপোলিতে পাঠানো হতো।
লিবিয়া থেকে ইউরোপ
ভিকটিমরা ত্রিপোলিতে পৌঁছানোর পর বাংলাদেশি এজেন্টরা তাদের গ্রহণ করতো। তাদেরকে ত্রিপোলিতে বেশ কয়েকদিন অবস্থান করতে হতো। অভিবাসন প্রত্যাশীরা ত্রিপোলিতে পৌঁছানোর পর দেশীয় প্রতিনিধির মাধ্যমে আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে বাকি অর্থ আদায় করা হতো। এরপর ভিকটিমদের ইউরোপে পাচারের উদ্দেশে ত্রিপোলি থেকে একটি সিন্ডিকেটের হাতে তুলে দেওয়া হতো। এরপর ওই সিন্ডিকেট ভিকটিমদের সমুদ্রপথ অতিক্রম করার জন্য নৌযান চালনা, সমুদ্রপথে দিক নির্ণয়সহ নানাবিধ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতো। এরপর একটি নির্দিষ্ট রাতে একসঙ্গে কয়েকটি নৌযান লিবিয়া হয়ে তিউনেশিয়া উপকূলীয় চ্যানেল হয়ে ইউরোপের পথে রওয়ানা হতো। এভাবে ঝুঁকিপূর্ণভাবে সাগরপথ পাড়ি দিতে গিয়ে ভূমধ্যসাগরে দুর্ঘটনার শিকার হন। অনেক সময় জীবন অবসানও ঘটে।
র্যাবের সিও বলেন, চক্রের মূল হোতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদেরও গ্রেফতার করা হবে।
যেভাবে খুন হন ২৬ বাংলাদেশি
লিবিয়ায় অপহরণকারীদের কবলে পড়ার পর ২৬ বাংলাদেশিকে খুন করা হয়। একজন মানবপাচারকারীকে হত্যার প্রতিশোধ নিতে ২৬ জন বাংলাদেশিসহ ৩০ জন অভিবাসন প্রত্যাশীকে হত্যা করেন অপহরণকারীরা। বাংলাদেশি বাদে চারজন সুদানের নাগরিকও ছিলেন নিহতের তালিকায়। তারা ১৫ দিন ধরে অপহরণকারীদের হাতে জিম্মি ছিলেন।
আরও পড়ুন: লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে এক পাচারকারীর স্বজনরা
লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলি থেকে ১৮০ কিলোমিটার দক্ষিণের শহর মিজদায় আটক করে রাখা হয়েছিল তাদের। সেখানেই ২৮ মে সকালে বন্দিরের ওপর গুলি চালায় অপহরণকারীরা।
করোনা পরিস্থিতির কারণে লিবিয়ার মিজদায় দাফন করা হয়েছে নিহত বাংলাদেশিদের।
যেভাবে অপহরণকারীদের কবলে পড়েন তারা
মূলত ইতালিতে অভিবাসনের উদ্দেশে ওই ৩৮ জন বাংলাদেশি লিবিয়ায় গিয়েছিলেন। ডিসেম্বর মাসে তারা ভারত ও দুবাই হয়ে বেনগাজি বিমানবন্দরে পৌঁছান। এরপর গত কয়েক মাস তাদেরকে লিবিয়ার ভেতরে গোপনে রাখা হয়েছিল। উপকূলীয় অঞ্চল যুওয়ারা হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অভিবাসীদের নিয়ে ইতালির দিকে যাত্রা করার পরিকল্পনা ছিল পাচারকারীদের। তার আগেই অপহরকারীদের কবলে পড়েন বাংলাদেশি ও সুদানের নাগরিকরা।