ঘরবন্দি চট্টগ্রামবাসীর নিরানন্দ ঈদ
২৫ মে ২০২০ ১৬:৩৪ | আপডেট: ২৫ মে ২০২০ ১৬:৪১
চট্টগ্রাম ব্যুরো: নামাজ শেষে কোলাকুলি নেই। হাসিঠাট্টা, হৈ-চৈ, কুশল বিনিময়ও নেই। বরং যে মানুষটির পাশে বসে আজ ঈদের নামাজ আদায় করেছেন, সেই মানুষটির সঙ্গে আবার দেখা হবে কি না, চোখেমুখে এমন আতঙ্কের ছাপ। অদৃশ্য করোনাভাইরাসের ভয় সবার মধ্যে দৃশ্যমান। নগরের পথেঘাটে বাজছে না উচ্চস্বরে গান, নতুন পোশাক পরে শিশু-কিশোরদের কোলাহলও নেই রাস্তায়। বরং ব্যক্তিগত গাড়িতে উচ্চবিত্ত মানুষ দেখলেই ছুটে আসছে ক্ষুধার্ত মুখ, গাড়ি ঘিরে ধরে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন তারা।
এমন নিরানন্দ ঈদ আর কখনো দেখেনি চট্টগ্রামবাসী। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে সৃষ্ট লকডাউন পরিস্থিতিতে ঘরবন্দি অধিকাংশ মানুষ। বেশিরভাগ মানুষই বাসায় ঈদের নামাজ আদায় করেছেন। হাতেগোনা মানুষ বিভিন্ন প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে রাস্তায় বেরোলেও আনন্দের তাগিদ নেই তাদের মধ্যেও। নিতান্ত আড়ম্বর ছাড়াই ঈদের দিনটি পার করছেন বন্দরনগরীর মানুষ।
৭৩ বছর বয়সী মুক্তিযোদ্ধা ও খ্যাতিমান লেখক সিরু বাঙালি স্ত্রী, ছেলে-ছেলের বৌ, নাতি-নাতনিদের নিয়ে বাসায় নামাজ আদায় করেন। তিনি নিজেই ইমামতি করেন। তার মতে, গত ১০০ বছরে এই অঞ্চলের মানুষের জীবনে এমন ঈদ আর কখনো আসেনি। এমন ভিন্নরূপের মহামারি তিনি নিজের জীবনেও কখনো দেখেননি।
সিরু বাঙালি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা গুটিবসন্ত, হাম, কলেরা, যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া, পোলিওর মতো মহামারির কথা শুনেছি। বসন্তের প্রার্দুভাবে নাকি লাখে লাখে মানুষ মারা যেত, সেই বইয়ে পড়েছি, দেখিনি। ম্যালেরিয়া-কলেরা, পোলিও দেখেছি, কিন্তু এমন রুদ্ররূপ কখনো দেখিনি। এটা এমন এক দুর্যোগ, সারা পৃথিবীর মানুষকেই নাজেহাল করে দিয়েছে। আমি আড়াই মাস ধরে ঘরবন্দি। আমার কাছে ঈদের দিনটাও গত আড়াই মাসের প্রতিদিনের মতো।’
মুক্তিযুদ্ধের সময় ঈদুল ফিতরের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালের ১৭ নভেম্বর ঈদ হয়েছিল। আমরা তখন যুদ্ধের ময়দানে। সীমান্তে বেশ কয়েকটি অপারেশন হয়েছে অক্টোবর-নভেম্বরে, যেখানে আমি অংশ নিয়েছি ও নেতৃত্ব দিয়েছি। সেই বছর কখন যে রোজা এসেছে এবং কখন ঈদ চলে গেছে, আমরা কেউই জানতাম না। দেশ স্বাধীনের পর জানতে পেরেছি, ১৭ নভেম্বর ঈদ হয়ে গেছে। তখন একেকটি অপারেশন সাকসেসফুল হচ্ছিল আর সেটাই আমাদের কাছে ঈদের আনন্দের মতো ছিল।’
প্রতিবছর নগরীর জমিয়াতুল ফালাহ মসজিদ ময়দানে সিটি করপোরেশনের ব্যবস্থাপনায় ঈদের জামাতের আয়োজন করা হয়। এবার ময়দানের বদলে মসজিদের ভেতরে নামাজ হয়েছে। প্রতিবছর জমিয়াতুল ফালাহ ময়দানে ঈদ জামাতে সামনের সারিতে থাকতেন চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। এবার তিনি নামাজ আদায় করেছেন এম এ আজিজ স্টেডিয়াম মসজিদে।
মেয়র বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সামাজিক দূরত্ব মেনে ঘরে ঘরে ঈদ পালনের আহ্বান জানিয়েছেন। আমিও প্রধানমন্ত্রীর একজন কর্মী হিসেবে সর্বতোভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিজেও নামাজ আদায় করেছি, জনগণকেও সেই অনুরোধ করেছি। জমিয়াতুল ফালাহ মসজিদ আমি এবার এড়িয়ে গেছি, কারণ সেখানে গেলে লোকজন-নেতাকর্মীরা আবেগপ্রবণ হয়ে অনেকে কোলাকুলি করতে আসবেন, অনেকে করদর্মন করবেন, চাইলেও এড়ানো যাবে না। সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘন হবে। এমনকি আমি বিনয়ের সঙ্গে আমার বাসায়ও যাতে কেউ না আসেন, সবাই যাতে নিজ নিজ বাসায় ঈদ পালন করেন, সেই আহ্বানও জানিয়েছি। প্রতিবছর আমার বাসায় হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয়, এবার কেউ আসতে পারছে না, এটা আমার জন্য কষ্টের। কিন্তু এটুকু স্যাক্রিফাইস আমাদের করতে হচ্ছে নিজেকে এবং মানুষকে সুস্থ রাখার জন্যে।’
এমন নিরানন্দ ঈদ আর জীবনে কখনও এসেছে কি না জানতে চাইলে ৬২ বছর বয়সী নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, ‘আমার বয়স তো দূরের কথা, আমার মায়ের বয়স ৯০ বছরের বেশি। আমার মা বলছেন, উনিও জীবনে কখনও এভাবে ঈদ করেননি। একসময় আমার রাজনৈতিক কিংবা প্রশাসনিক কোনো পদপদবি ছিল না। জীবনে অনেক প্রতিকূল সময় পার করেছি। কিন্তু সবসময় চেষ্টা করেছি, ঈদের দিনটা যাতে আনন্দে কাটাতে পারি। সবসময় মানুষকে সঙ্গে নিয়েই আমি ঈদ করেছি। শুধু এবার ব্যতিক্রম হচ্ছে।’
প্রায় ৬০ বছর বয়সী চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা এম রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি নামাজ আদায় করেছেন নগরীর চান্দগাঁওয়ে তাদের নিজস্ব বহদ্দারবাড়ি জামে মসজিদে।
রেজাউল করিম চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময়ও এমন নিরানন্দ ঈদ ছিল। কারণ শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধরত দেশে ঈদের আনন্দ হয় না। কিন্তু তখন অন্তত কোলাকুলি করা গেছে। এবার তো সেটাও হয়নি। ঈদ মানে মানুষে মানুষে সম্মিলন। সেই ঈদ যে মানুষকে নিজেদের মধ্যে দূরত্ব রেখে পালন করতে হবে, এটা আমরা কখনও ভাবিনি। ঈদের নামাজে আল্লাহর কাছে পরিত্রাণের ফরিয়াদ করেছি। আল্লাহর রহমত এবং আমাদের সচেতনতা, এর মাধ্যমেই হয়তো আমরা একদিন এই দুর্যোগ থেকে মুক্তি পাব।’
চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম বক্কর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিজের বাসায় নামাজ পড়েছেন। এবারের ঈদের অনুভূতি বলতে গিয়ে আবেপ্রবণ হয়ে পড়েন এই বিএনপি নেতা। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রতিবছর ঈদের দিন, পরদিন অন্তত দুই থেকে তিন হাজার মানুষ আমার বাসায় আসে। আমিও বিভিন্ন নেতাদের বাসায় যায়, কুশল বিনিময় করি। এবার কিছুই করতে পারছি না। আত্মীয়স্বজন, নেতাকর্মীদের খুব মিস করছি। জীবন থেকে একটি মিলনমেলা হারিয়ে গেল।’
ঈদের দিনেও ফাঁকা চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন সড়ক। মাঝে মাঝে কিছু প্রাইভেটকার-মাইক্রোবাস ছুটে যাচ্ছে শুধু। নগরীর কাজীর দেউড়ি এলাকায় দেখা গেছে, রাস্তার পাশে দাঁড়ানো একটি প্রাইভেটকারকে ঘিরে ধরেছে ১০-১২ জন গরীব-ভাসমান নারী-পুরুষ। কোথাও কোথাও ভাসমান মানুষের জটলা দেখা গেছে সাহায্যের আশায়।
শহরের বাইরে গ্রামগঞ্জের চিত্রও প্রায় একই বলে খবর পাওয়া গেছে। গ্রামেও মসজিদে-মসজিদে নামাজ হয়েছে। সামাজিক দূরত্ব, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয় গ্রামে কিছুটা উপেক্ষিত। তবে আনন্দ আয়োজন নেই গ্রামেও।
চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আরিফ উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা গ্রামে মসজিদে নামাজ পড়েছি। প্রত্যেক মুসল্লির মধ্যে তিন ফুট দূরত্ব রাখা হয়েছে। এক জামাতের পর আরেক জামাত শুরুর আগে মসজিদ ধুয়ে আবার পরিষ্কার করা হয়েছে। তবে ঈদের আনন্দ বলতে যেটা বোঝায় সেটা নেই। কারও সঙ্গে কোলাকুলি করতে পারিনি। আত্মীয়স্বজনের বাড়িতেও কেউ যাচ্ছে না।’