Wednesday 08 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

করোনা চিকিৎসায় কতটা প্রস্তুত বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল?


১৩ এপ্রিল ২০২০ ২৩:২৭ | আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০২০ ১০:৫৯

ঢাকা: বৈশ্বিক মহামারিতে পরিণত হওয়া করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশে এ পর্যন্ত আটটি হাসপাতাল নির্ধারণ করা হয়েছে। এর সবগুলোতে এখনও পুরোদমে কাজ শুরু হয়নি। ফলে করোনা আক্রান্ত বেশিরভাগ রোগীই চিকিৎসা নিচ্ছেন বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী সরকারি হাসপাতালে। এর আগে ফেব্রুয়ারি মাসে হাসপাতালটি তাদের প্রস্তুতির কথা জানিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা হলো— প্রায় দুই মাস পেরিয়ে গেলেও হাসপাতালটি করোনাভাইরাস চিকিৎসার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত নয় বলে জানিয়েছে হাসপাতালটির বিভিন্ন সূত্র।

বিজ্ঞাপন

হাসপাতালে পর্যাপ্ত লোকবলের অভাব, আইসিইউতে দক্ষ জনবল সংকট, চিকিৎসকদের হাসপাতাল থেকে আনা-নেওয়ার পরিবহন সংকটের সঙ্গে নার্সদের খাবার ব্যবস্থা না থাকার অভিযোগও রয়েছে। এর আগে ৫ এপ্রিল সারাবাংলা ডটনেটে ‘কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল: নেই পর্যাপ্ত আইসিইউ, খাবার আসে বাইরে থেকে’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনেক তথ্যের সঙ্গেই বাস্তবতার মিল নেই।

ওই সময় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সবকিছু ঠিকঠাক থাকার কথা জানালেও বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, ৭ এপ্রিল হাসপাতালে এবিজি ও এক্সরে মেশিন বসানো হয়। সেইসঙ্গে সম্প্রতি জোগাড় করা হয়েছে সিটি স্ক্যান মেশিন। এদিকে চিকিৎসকদের জন্য এখন বাইরে থেকে খাবার না এলেও হাসপাতালের অন্যান্য স্টাফদের খাওয়া-দাওয়ায় নিয়ে সমস্যা রয়েই গেছে।

হাসপাতালের বিভিন্ন সূত্রে কথা বলে জানা যায়, স্বাস্থ্য অধিদফতর ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের আগের বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তব চিত্রের পার্থক্যের বিষয়টি। নার্সদের যেখানে থাকার জায়গা করে দেওয়া হয়েছে, সেখানে তাদের খাওয়া দেওয়া হচ্ছে না— এমন অভিযোগও পাওয়া গেছে।

সম্প্রতি এই হাসপাতালটি আলোচনায় আসে ছয় জন চিকিৎসককে সাময়িক বরখাস্ত করার খবরে। এই ছয় চিকিৎসকের মধ্যে একজনের সঙ্গে কথা হয় সারাবাংলার এই প্রতিনিধির। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘আমি ২০ মার্চ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করি। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক স্যারের চিঠিতে দেখলাম, আমাকে ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে অনুপস্থিত দেখানো হচ্ছে। আর আমি ২০ মার্চ ডিউটি করে ইস্তফা দিই তত্ত্বাবধায়ক বরাবর। কারণ আমার বাচ্চা ছোট। আর বাসায় গেলেই কোয়ারেনটাইন পর্ব সঠিকভাবে পালন করা হয় না। তাই আমি ইস্তফা দিয়েছি।’

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলায় প্রতিবেদন প্রকাশের পরে বর্তমান অবস্থা কী?— এমন প্রশ্নের জবাবে হাসপাতাল সূত্র বলছে, চিকিৎসকদের খাওয়া-দাওয়ার বিষয়টি সমাধান হয়ে গেছে। এখন থেকে নার্সদের আলাদা থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। এখানে এবিজি মেশিন ও এক্সরে মেশিন চলে এসেছে। এছাড়া আনা হয়েছে সিটি স্ক্যান মেশিনও, যদিও এখনও সেটি ইনস্টল হয়নি। এই মেশিন সেটআপের ক্ষেত্রে একটি রেডিয়েশনের বিষয় থাকে। তাই আজকালের মধ্যে মেশিনটি ইনস্টল হবে— এমনটা বলা যায় না।

সূত্র আরও বলছে, সব মিলিয়ে সাতজন চিকিৎসক আইসিইউতে কাজ করে আসছিলেন। তাদের মধ্যে দু’জন কনসালট্যান্ট। ফলে এই দু’জনকে অন্যান্য বিষয়েও দেখতে হয়। সে হিসাবে মূলত পাঁচ জনই আইসিইউতে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তবে সোমবার (১৩ এপ্রিল) সেখানে নতুন কয়েকজনকে পদায়ন করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

সূত্র আরও জানিয়েছে, রোগী ভর্তির উপযোগী আইসিইউ এই মুহূর্তে ১০টি রয়েছে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে। এর বাইরে অন্যগুলোতে ভেন্টিলেটর ও সংশ্লিষ্ট সবকিছু চলে এলেও সেখানে চিকিৎসা দিতে কিছুটা সময় লাগবে। এছাড়া চিকিৎসকদের গাড়ি এখনো বাইরে থেকেই ব্যবহার করতে হচ্ছে বলে জানা গেছে।

সূত্র বলছে, নার্স-ওয়ার্ড বয়, আয়া এমন সাপোর্টিং স্টাফদের সংকট আছে। তবে আগামীকাল বা পরশু থেকে হয়তো এখানে পিএবিএক্স সেবাও চালু হয়ে যাবে। এতদিন এখানে ফোনেই কাজ হতো। সেক্ষেত্রে হয়তো খুব দ্রুতই রোগীরা যোগাযোগ করতে পারবেন জানায় হাসপাতালের আরেকটি সূত্র।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জনবল সংকটের সমাধান হিসেবে প্রতিটি ফ্লোরে যদি দুই থেকে তিন জন চিকিৎসক এবং দু’জন নার্স ও দু’জন ওয়ার্ড বয় বা আয়া নিয়ে একটা টিম করে যদি স্টেশনে ভাগ করে দেওয়া হয়, তবে রোগীদের জন্য সুবিধা হবে। সেক্ষেত্রে রোগীদের কাছেও চিকিৎসকরা খুব দ্রুত পৌঁছুতে পারবেন। এখন চিকিৎসকরা সেবা দিলেও রোগীরা সন্তুষ্ট হতে পারছেন না।

এদিকে হাসপাতালের আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, ১২ এপ্রিল স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়েছিলেন হাসপাতালের সংশ্লিষ্টরা। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদও সেই ভিডিও কনফারেন্সে উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. শিহাব উদ্দিন এ কনফারেন্সের কথা স্বীকার করেছেন।

জানা গেছে, কনফারেন্সে চিকিৎসকদের এন-৯৫ মাস্কের সংকটের কথা মন্ত্রীকে জানানো হয়েছে। সেক্ষেত্রে ডিজি আশ্বাস দিয়েছেন সমস্যা সমাধান করার। কনফারেন্সে সাময়িক বরখাস্ত হওয়া চিকিৎসকদের বিষয়েও আলোচনা হয়েছে।

এর আগে ৫ এপ্রিল বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. শিহাব উদ্দিনের কাছে জনবল সংকটের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সারাবাংলাকে বলেছিলেন, ‘কোনো জনবল সংকট নেই। আমি যা বলছি, তা ঠিকই বলছি। এই কথা আমাকে শোনাচ্ছেন কেন? সবাই এখানে ডিউটি করছে। বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন সেকশনে ডিউটি ভাগ করা আছে।’

চিকিৎসকদের খাবারের বিষয়টিও সরকারিভাবেই ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলে দাবি করেছিলেন ডা. শিহাব। তিনি বলেছিলেন, ‘ফেসবুকে কত লোকে কত কথা লিখে। সেগুলো কি আমি থামাতে পারি? আমি হাসপাতালের ম্যানেজমেন্ট নিয়ে ব্যস্ত আছি। এসব নিয়ে মাথা ঘামাই না। যে যা ইচ্ছা বলুক।’

হাসপাতালের ছয় চিকিৎসককে সাময়িক বরখাস্তের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে এই সহকারী পরিচালক সারাবাংলাকে বলেন, ‘আসলে সবার যার যার একটা ব্যাখ্যা থাকতেই পারে। সত্যির আশ্রয় নিয়ে হোক আর মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে হোক, সেটা করবেই। আমাদের কাজ কী এখন? হাসপাতালে অন্য কোনো রোগী নেই। তাই আমাদের কাজ শুধুমাত্র কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া। এখন কেউ কেউ যদি ভয় পায় এবং সেটাই বলতে থাকেন, তাতে অন্যদের নিরুৎসাহিত করার সম্ভাবনা থাকে। যারা কাজের ক্ষেত্রে অনিয়মিত ছিলেন, তাদের বিষয়ে আমি সবসময়েই স্বাস্থ্য অধিদফতরে জানিয়েছি। চার জন তো আসেনই না এক/দেড় মাস ধরে। তার মধ্যে একজন রিজাইন লেটারও দিয়েছে আমার কাছে, যেটি সঠিক না। এটা সচিব মহোদয় বরাবর লেখা দরকার ছিল। আর দুয়েকজন যারা আসেন, তারা রোগী দেখতে সাহস পান না।’

হাসপাতালের পরীক্ষার যন্ত্রপাতির সংকটের বিষয়টি এর আগে অস্বীকার করলেও বেশ কয়েকটি যন্ত্রপাতি মাত্র দুয়েকদিন হলো হাসপাতালে এসেছে— এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ডা. শিহাব বলেন, আসলে এগুলো যোগ হয়েছিল আরও আগেই। ইন্টারনেটের মাধ্যমে ইনস্টল করতে হয়। তাই কিছুটা সময় লেগেছে।

আইসিইউ’র জনবল বিষয়ে তিনি বলেন, আইসিইউতে বর্তমানে যে রোগী আছে, তার জন্য যে জনবল ঠিক আছে। তাছাড়া আমাদের ২৬টি আইসিইউ’র জন্য এখনো লোক নিয়োগ হচ্ছে। আজকেও দু’জনের নিয়োগ হয়েছে। অন্যান্য জায়গা থেকে লোক দেওয়া হচ্ছে। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। আমরা যারা কাজ করতে আগ্রহী, তাদের নাম লিস্ট করে পাঠাব। যে আগ্রহী না, তাকে তো অর্ডার দিয়েও লাভ হয় না।

ডা. শিহাব জানান, বর্তমানে বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী সরকারি হাসপাতালে ৭৩ জন চিকিৎসক কাজ করছেন। আর ৭০ জন নার্স এখানে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া অন্যান্য স্টাফ রয়েছেন ৬৫ জন। আরও ৩০ জনের মতো নার্সিং স্টাফ খুব দ্রুতই যোগদান করবে বলে জানান তিনি।

চিকিৎসকদের পিপিই ও এন-৯৫ মাস্কের কোনো সংকট আছে কি না— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মাস্ক যাদের প্রয়োজন, তাদের জন্য অবশ্যই আছে। পিপিই’রও কোনো সংকট নেই। প্রতিদিনই ৫০ পিস করে পাচ্ছি। সবই মানসম্পন্ন।’

হাসপাতালের সহকারী পরিচালকের বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তব চিত্রের মিল না থাকায় হাসপাতালটি আদতে কোভিড-১৯ রোগের চিকিৎসায় কতটুকু প্রস্তুত, সে প্রশ্ন তোলেন সংশ্লিষ্টরা। তবে এ বিষয়ে জানতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।

করোনাভাইরাসের চিকিৎসা কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল কোভিড-১৯ চিকিৎসা জনবল সংকট টপ নিউজ বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল যন্ত্রপাতি সংকট