চীনে নীলাকাশের দিন কি তবে শেষ?
১২ এপ্রিল ২০২০ ২১:৩২ | আপডেট: ১৭ মে ২০২০ ২০:৫৬
গত কয়েক সপ্তাহে চীনের বায়ুমান নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেছে বলে জানিয়েছে সেদেশের সরকারসহ একাধিক গবেষণা সংস্থা। বায়ু দূষণ কমে যাওয়ায় দেশটির রাজধানীসহ শিল্পসমৃদ্ধ শহরগুলোতে বহু বছর পর নীল আকাশের দেখা পান বাসিন্দারা। আর এ জন্য দায়ী বলে মনে করা হয় করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে দেশটিতে লকডাউন পরিস্থিতিকে। তবে বায়ুমানের এ উন্নতি ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। চীনের পরিস্থিতি যেমন স্বাভাবিক হচ্ছে, বায়ুমানও ফিরছে আগের অবস্থায়।
গত ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে করোনাভাইরাসে প্রথম আক্রান্ত শনাক্ত হওয়ার পর দ্রুতই দেশটির কলকারখানা বন্ধ ও ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। একইসঙ্গে সীমিত করে দেওয়া হয় অন্যান্য বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড। আর এতে বায়ু দূষণও কমে যায় অনেকটাই।
চীনের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, গত ২০ জানুয়ারি থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ক্ষতিকর অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণা পিএম২.৫ এর উপস্থিতি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৮.৪ শতাংশ কমে গেছে। উল্লেখ্য, পিএম২.৫-এর অর্থ— ২ দশমিক ৫ মাইক্রোমিটারের ছোট পদার্থ বাতাসে উড়ছে— যা শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় মানুষের শরীরে প্রবেশ করে ভয়ানক স্বাস্থ্য ঝুঁকির জন্য দায়ী।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘নাসা’— স্যাটেলাইট মানচিত্র বিশ্লেষণ করে জানিয়েছে উহানসহ গোটা চীনে বাতাসের মানের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষ করে উহান শহরসহ পূর্ব ও মধ্য চীনের বাতাসে ক্ষতিকর নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডের উপস্থিতি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় কমে গেছে স্থানভেদে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ। চীনের মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত উহান শহর করোনাভাইরাসের প্রথম কেন্দ্রস্থল। ভাইরাসটির বিস্তার ঠেকাতে এ শহরটিতে কড়া লকডাউন পালন করা হয়।
চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান শহরে বেশিরভাগ স্টিল, গাড়ি ও ক্ষুদ্র ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যের শিল্প-কারখানা অবস্থিত। শিল্পসমৃদ্ধ উহান শহরে ১ কোটি ১০ লাখ মানুষের বাস। জানুয়ারির ২৩ তারিখে লকডাউন করা হয় শহরটি। তবে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব প্রায় শূন্যের কাছাকাছি নেমে আসায় গত বুধবার (৮ এপ্রিল) এ শহরে লকডাউন পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হয় এবং কারখানাগুলো আবারও পুরোদমে চলতে শুরু করে।
উল্লেখ্য, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড মূলত গাড়ি, বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ অন্যান্য শিল্প কারখানা নিঃসরণ করে থাকে। চীনের ৬০ শতাংশ বিদ্যুপ্রকল্পে কয়লা ব্যবহার করা হয়— যা বায়ু দূষণ করে থাকে। এসব কারখানা থেকে নিঃসৃত নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগ বিশেষ করে অ্যাজমার জন্য অন্যতম দায়ী।
উহানের বায়ুমান বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে নাসা বাণিজ্যিক কার্যক্রম ও ভ্রমণ স্থগিত হওয়াকে চিহ্নিত করেছিলো। নাসার এ দাবির সঙ্গে একমত প্রকাশ করেছে খোদ চীনও। দেশটির ন্যাশনাল ডেভোলাপমেন্ট অ্যান্ড রিফর্ম কমিশনের প্রকাশিত এক জরীপে দেখানো হয়েছে, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে চীনের মহাসড়কগুলোর ব্যবহার ২৫ শতাংশ কমে গেছে। একই সময়ে জ্বালানি তেলের ব্যবহারও কমে গেছে ১৪ শতাংশ।
চীনের সরকারি পরিসংখ্যান মতে, গত ফেব্রুয়ারিতে বাতাসে ক্ষতিকর অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণা পিএম২.৫ হ্রাস পেয়েছে গড়ে ২৭ শতাংশ। এছাড়া নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড হ্রাস পায় ২৮ শতাংশ এবং সালফার ডাই অক্সাইডের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে ২৩ শতাংশ।
চীনের পরিবেশ আন্দোলনের অন্যতম প্রভাবশালী কর্মী লিউ কিয়ানও বায়ুমান বৃদ্ধির জন্য লকডাউনকে চিহ্নিত করেছেন। তিনি জানান, শিল্প-কারখানা বন্ধ হওয়া ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞাই গত কয়েক সপ্তাহে চীনের বায়ুমান বৃদ্ধির প্রাথমিক কারণ। লিউ বলেন, বায়ু দূষণের কারণ বহু এবং জটিল। তবে শিল্প-কারখানায় উৎপাদন কর্মকাণ্ড ও গণপরিবহণের ব্যবহার কমে যাওয়ায় বায়ু দূষণ অনেকটাই কমে গেছে।
তবে বায়ুমানের এ উন্নতি অবশ্য ধরে রাখতে পারেনি চীন। ইতিমধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমণের কেন্দ্রস্থল চীন থেকে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র স্থানান্তরিত হয়েছে। আর এতেই চীনে আবারও শিল্প-কারখানা ও যোগাযোগ পুরোদমে শুরু হয়েছে। লকডাউন তুলে নেওয়ায় চীন আবারও স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে, একইসঙ্গে বায়ু দূষণও ফিরছে আগের অবস্থায়।
ফিনল্যান্ডের হেলসিঙ্কিতে অবস্থিত সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ার- এর প্রখ্যাত গবেষক লাউরি মিলিভির্তা বলেন, নাসা ও চীনের সরকারি পরিসংখ্যানে যা দেখা গিয়েছিলো, অর্থাৎ বাতাসের মান বৃদ্ধির যে চিত্র আমরা দেখেছিলাম তা মধ্য মার্চ থেকে আবারও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে শুরু করে। এবং মার্চের শেষ নাগাদ তা প্রায় আগের অবস্থানেই ফিরে যায়।
বেইজিংভিত্তিক দাতব্য প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব পাবলিক অ্যান্ড এনভায়োরেনমেন্টাল অ্যাফেয়ার্স- এর পরিচালক মা জুন এ ব্যাপারে বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতি চাঙ্গা করতে যে প্রণোদনা প্যাকেজ দেওয়া হচ্ছে তার ফলে যেভাবে উৎপাদন কারখানাগুলো চলবে, এতে আরও দ্রুত বায়ু দূষণ বাড়বে। যখনই কারখানাগুলো পুরোদমে চালু হবে, গ্যাস নির্গমনও পুরোদমে হবে। আরেকটি মহামারি বা লকডাউনের আগে তা আর গত দিনগুলোর অবস্থায় ফিরবে না। আরেকটি মহামারি মানেই ভয়ংকর ব্যাপার। মহামারির সময় বাতাসের মানের যে অর্জন তা ধরে রাখা যায়নি।
উল্লেখ্য, ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দা থেকে চীনের অর্থনীতিকে উদ্ধার করতে ৪ ট্রিলিয়ন ইয়েনের বিশাল প্রণোদনা দিয়েছিল চীন। যার ফলে চীনের শিল্প-কারখানাগুলো কঠোর মাত্রায় উৎপাদন শুরু করেছিলো, যা পরের বছরগুলোতে চীনের বায়ু দূষণ মারাত্মক মাত্রায় বাড়য়ে দিয়েছিলো। এ নিয়ে চীনে বহু সমালোচনাও হয়।
উল্লেখ্য, এবারে করোনাভাইরাস মহামারি শুরুর আগেই চীনের অর্থনীতি অনেকটাই চাপে ছিলো। গতবছর চীনের অর্থনীতিতে মন্দাভাব চলছিলো। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধের প্রভাবে চীনে উৎপাদন অনেকটাই হ্রাস পায়। গত বছর মাত্র ৬ দশমিক ১ শতাংশ উৎপাদন প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিলো চীন। এবার মহামারির কারণে ক্ষতি যুক্ত হওয়ায় ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতিতে চাঙ্গাভাব আনতে ব্যাপক পদক্ষেপ নিচ্ছে চীন।
মা জুন বলেন, গতবছর ধরেই চীনের স্থানীয় সরকারগুলো চাপে রয়েছে। আর এতে এখন আশঙ্কা হচ্ছে— যেকোনো মূল্যে উৎপাদন বাড়াতে চীনের পরিবেশ সুরক্ষার নীতিগুলোর প্রতি উদাসীন থাকবে কারখানাগুলো।
তবে মা বলেন, এখন চীনের সময় উচ্চ কার্বন নিঃসরণ করে এমন প্রকল্পে অর্থ খরচ না করে পরিবেশ সহায়ক সবুজ প্রকল্পে অর্থ ঢালার। কেননা, অর্থনৈতিক উন্নতি ও পরিবেশ সুরক্ষার মধ্যে ভারসাম্য রাখলেই কেবল সবুজ চীন গড়া সম্ভব। এখন চীনের এটাই বেশি প্রয়োজন।
-সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট অবলম্বনে।