বাড়ির আঙিনার ও বুনোফুলে শহিদদের শ্রদ্ধা
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১৫:৫৮ | আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১৬:৫৩
গফরগাঁও (ময়মনসিংহ) থেকে: নিজ বাড়ির গাছ থেকে ফুল নিয়ে এসেছে শিক্ষার্থীরা। কেউ এসেছে রাস্তার ধার থেকে তুলে আনা বুনোফুল নিয়েও। স্কুল প্রাঙ্গণের শহিদ মিনারে সারিবদ্ধভাবে সেই ফুল দিয়েই ভাষা শহিদদের শ্রদ্ধা জানিয়েছে তারা। অংশ নিয়েছে গ্রামকে চারদিক থেকে ঘিরে রাখা কয়েক কিলোমিটার রাস্তা প্রদক্ষিণ করা এক দীর্ঘ র্যালিতেও।
শুক্রবার (২১ ফেব্রুয়ারি) এমন চিত্রই দেখা গেল ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার মাইজবাড়ী গ্রামে অবস্থিত মাইজবাড়ী হাতেম তাই উচ্চ বিদ্যালয়ে।
গফরগাঁও উপজেলা থেকে সাত কিলোমিটার দূরের গ্রাম মাইজবাড়ী। উচ্চ বিদ্যালয়সহ চারটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে এই গ্রামে। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠনেই ভাষা শহিদদের শ্রদ্ধা জানিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে নানা অনুষ্ঠান। স্কুলের শিক্ষার্থীসহ এলাকার বাসিন্দারাও সমানভাবে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন শহিদদের।
হাতেম তাই উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী ঋণী। স্থানীয় এক নার্সারি থেকে সে দু’টি গাঁদা ফুল কিনে নিয়ে স্কুলে এসেছে। র্যালিতে অংশ নেওয়ার পর স্কুলের শহিদ মিনার প্রাঙ্গণে সবার সঙ্গে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধাও জানিয়েছে।
ঋণী জানায়, বাড়িতে গাছ না থাকায় প্রতিবছরই ফুল কিনে শ্রদ্ধা জানায় সে। তার মতো অনেক শিক্ষার্থীই নার্সারি থেকে ফুল কিনে এনে শ্রদ্ধা জানিয়ে থাকে ভাষা শহিদদের প্রতি।
ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী আদিবের বাড়িতেই অবশ্য রয়েছে গোলাপসহ বেশকিছু ফুলের গাছ। সব গাছ থেকেই একটা-দু’টো করে ফুল নিয়ে বানিয়েছে তোড়া। সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী আরমানও নিজেদের বাড়ির ফুল গাছ থেকে গোলাপ ও গাঁদা ফুল নিয়ে এসেছে শ্রদ্ধা জানাতে। তাদের মতো অনেকেই বাড়ির আঙিনায় লাগানো গাছের ফুল দিয়ে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছে ভাষা আন্দোলনের ৬৮ বছর পূর্তির এই দিনে।
এছাড়াও রাস্তার ধারের বুনোফুল গাছ থেকে শিশু ও স্কুলের শিক্ষার্থীদের ফুল তুলতে দেখা গেছে। দলবেঁধে সেসব ফুল হাতে স্কুলের শহিদ মিনার প্রাঙ্গণে আসে শিক্ষার্থীরা। পরে দলবেঁধে শ্রদ্ধাও জানায়।
এদিকে, ভাষা শহিদদের শ্রদ্ধা জানিয়ে মাইজবাড়ীর হাতেম তাই উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এক দীর্ঘ র্যালি বের হয়। র্যালিটি স্থানীয় মাইজবাড়ী বাজারসহ গ্রামের বড় একটি অংশের রাস্তা প্রদক্ষিণ করে স্কুলের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে এসে শেষ হয়। শিক্ষার্থীরা ছাড়াও স্কুলের শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা অংশ নেন এই র্যালিতে। পরে তারা শহিদ মিনারে সারিবদ্ধভাবে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
হাতেম তাই উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তাশারফ হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, মনোরম পরিবেশে প্রতিবছর স্কুল প্রাঙ্গণের শহিদ মিনারে ভাষা শহিদদের শ্রদ্ধা জানানো হয়। স্কুলের পক্ষ থেকে প্রতিবছরই দীর্ঘ র্যালি অনুষ্ঠিত হয়। কুইজসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতারও আয়োজন থাকে। এবারও একই ধরনের আয়োজন ছিল।
তিনি বলেন, এবার স্কুলের প্রায় হাজার খানেক শিক্ষার্থী র্যালিতে অংশ নিয়েছে। শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে জাতীয় দিবসের যেকোনো অনুষ্ঠানকেই আমরা বিশেষ প্রধান্য দিয়ে থাকি। শিক্ষার্থীদের বইপড়া কার্যক্রমেও উদ্বুদ্ধ করি আমরা।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা জানান, ১৯৭২ সালে হাতেম তাই উচ্চ বিদ্যালয় প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। পরে ১৯৯৬ সালে বিদ্যালয়টি উচ্চ বিদ্যালয়ের স্বীকৃতি পায়। স্কুলটিতে পাশের হার প্রায় শতভাগ। প্রতিষ্ঠানটি উপজেলা পর্যায়ে ফলাফল ও বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় শীর্ষে থাকা স্কুলের একটি।
এদিকে, হাতেম উচ্চ বিদ্যালয় ছাড়াও মাইজবাড়ী হাতেম তাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও ভাষা শহিদদের স্মরণে অনুষ্ঠিত হয়েছে নানা অনুষ্ঠান। চিত্রাঙ্কন, রচনা ও আবৃত্তি প্রতিযোগিতা এবং আলোচনা সভার আয়োজন ছিল প্রাথমিক এই বিদ্যালয়টিতে।
স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক তাহমিনা ইয়াসমিন জানান, স্কুলের শিক্ষার্থীরাও হাতেম তাই উচ্চ বিদ্যালয়ের র্যালিতে অংশ নেয়। পরে তাদের মধ্যে চিত্রাঙ্কন, রচনা ও আবৃত্তি প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। বিজয়ীদের স্কুলের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে নানা পুরস্কার। গ্রামের অন্য দু’টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও একই ধরনের অনুষ্ঠান ছিল বলে জানা গেছে।
মাইজবাড়ী গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা ও হাতেম তাই উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি এস এম ওয়াহিদুর রহমান বাদল সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের গ্রামে যেকোনো জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠান খুবই জাঁকজমকের সঙ্গে আয়োজন করা হয়। গ্রাম হলেও অনুষ্ঠানগুলো শহরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই আয়োজন করা হয়ে থাকে। একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে স্কুলের শহিদ মিনার প্রাঙ্গণে এলাকার তরুণ ও যুবারা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়। দিনে মাইজবাড়ীর প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিজ নিজ স্কুলের ব্যানারে শহিদ মিনারে শ্রদ্ধা জানায়। র্যালি ছাড়াও চিত্রাঙ্কন, রচনা, আবৃত্তি ও আলোচনা সভার আয়োজন করে থাকে প্রতিষ্ঠানগুলো। সামাজিকভাবেও এমন আয়োজনের উদ্যোগ থাকে।
ওয়াহিদুর রহমান বাদল বলেন, একুশে ফেব্রুয়ারি মানেই তো ভাষা শহিদদের অবদানে অভিভূত হওয়ার দিন, তাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করার দিন। এই দিন আমাদের হৃদয়ে আলাদা এক স্পন্দনের জন্ম দেয়। আমরা অগ্রজরা চেষ্টা করি তরুণ ও কচি-কাঁচাদের মধ্যে এই দিনটির তাৎপর্য তুলে ধরার। সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে দেশের জন্য নিবেদিত হওয়ার শিক্ষাই আমরা দিয়ে থাকি তাদের।
একুশে ফেব্রুয়ারি বাড়ির ফুলে শহিদদের শ্রদ্ধা ভাষাশহিদদের শ্রদ্ধা মাইজবাড়ী হাতেম তাই উচ্চ বিদ্যালয়