Wednesday 08 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘টার্গেট ছিল শেখ হাসিনা, উদ্দেশ্য গণআন্দোলন দমন’


২০ জানুয়ারি ২০২০ ২২:০১

চট্টগ্রাম ব্যুরো: যুগান্তকারী একটি রায়ে ৩২ বছর আগের লোমহর্ষক গণহত্যার স্মৃতি আবারও এসেছে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও স্বজন হারানো মানুষের সামনে। সেদিনের স্মৃতি হাতড়ে সাক্ষীরা বলছেন, পুলিশের নির্বিচারে গুলিবর্ষণের মূল টার্গেট ছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। উদ্দেশ্য ছিল সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন দমন করা। তবে সেই উদ্দেশ্য সফল হয়নি। এই গণহত্যার পথ ধরেই আন্দোলন তীব্র রূপ পায় এবং ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচার এরশাদ ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়।

বিজ্ঞাপন

সোমবার (২০ জানুয়ারি) বিভাগীয় বিশেষ জজের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা চট্টগ্রামের জেলা ও দায়রা জজ মো. ইসমাইল হোসেন চাঞ্চল্যকর এই মামলার রায় ঘোষণা করেন। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রাম লালদিঘীর ময়দানে যাওয়ার পথে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার গাড়িবহরে পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি চালালে ২৪ জন মারা যান। আহত হন কমপক্ষে দুই শতাধিক। শেখ হাসিনার প্রাণনাশের চেষ্টা হিসেবে আলোচিত ঘটনাটি ‘চট্টগ্রাম গণহত্যা’ হিসেবে পরিচিতি পায়।

বিজ্ঞাপন

এই ঘটনার নির্দেশদাতা হিসেবে আলোচিত তৎকালীন পুলিশ কমিশনার মীর্জা রকিবুল হুদা মৃত্যুবরণ করায় মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। তবে ‘হুকুমদাতা’ পলাতক গোবিন্দ চন্দ্র মণ্ডলের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়েছে। সেইসঙ্গে আরও চারজন তৎকালীন পুলিশ কনস্টেবলের ফাঁসির আদেশ হয়েছে। কারাগারে থাকা এসব আসামিরা হলেন- মোস্তাফিজুর রহমান, প্রদীপ বড়ুয়া, শাহ মো. আব্দুলাহ এবং মমতাজ উদ্দিন।

রায়ে পাঁচজনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হওয়ায় সন্তুষ্ট নিহতদের স্বজন এবং প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীরা। এদের মধ্যে কয়েকজন রায় ঘোষণার পর সারাবাংলার কাছে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।

নিহতদের একজন তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা অ্যাথেলবার্ট গোমেজ কিশোর। তার ভাই মামলার সাক্ষী তৎকালীন যুবলীগ নেতা চপল গোমেজ সারাবাংলাকে জানান, শেখ হাসিনার সমাবেশে যোগ দিতে গিয়ে তার ভাই এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণের শিকার হন। মারা যাবার পর পরিবার মৃতদেহও পায়নি। মৃতদেহ শ্মশানে পোড়ানো হয়। মৃত্যুর দুদিন আগে বরিশালে গ্রামে তার ভাই কন্যা সন্তানের বাবা হন। কিন্তু সেই খবর চট্টগ্রামে ভাইয়ের কাছে পৌঁছানোর আগেই তাকে যেতে হয়েছে পরপারে।

রেবা বিশ্বাসের স্বামী স্বপন বিশ্বাসও গুলিতে মারা যান। ৩২ বছর ধরে বিচার না পেয়ে অভিমানে সাংবাদিক ও রাজনৈতিক নেতা কারও সঙ্গে কথা বলেন না রেবা। স্বপনের মৃত্যুর সময় একমাত্র মেয়ে ছিল ছয় মাস বয়সী। এনজিওতে চাকরি করে সেই মেয়েকে চিকিৎসক বানিয়েছেন রেবা। তার দেবরের স্ত্রী কল্পনা বিশ্বাস সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার ভাসুর (স্বপন) কোনো রাজনীতি করতেন না। ছোট একটি দোকান ছিল। উনি মারা যাওয়ার পর একটি চাকরির জন্য অনেক নেতার কাছে গিয়েছিলেন উনার স্ত্রী। কেউ একটি চাকরি দেননি, সামান্য সহযোগিতাও করেননি। জীবনযুদ্ধ কি জিনিস, সেটা আমরা দেখেছি। ৩২ বছর ধরে একটা মামলা চলছে। উনি সাক্ষ্য দিতে গিয়েছিলেন। কিন্তু রায় নিয়ে উনার কোনো আগ্রহ নেই।’

সাংবাদিক নিরূপম দাশগুপ্তের লেখা ‘চট্টগ্রাম গণহত্যা: প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দি’ শীর্ষক বইটি নিষ্ঠুর ওই গণহত্যার প্রামাণ্য দলিল হিসেবে পরিচিত। সেখানে উল্লেখ আছে, ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি বিকেলে চট্টগ্রাম শহরের লালদিঘী ময়দানে তৎকালীন ৮ দলীয় ঐক্যজোটের একটি পূর্ব নির্ধারিত সমাবেশে যোগ দিতে এসেছিলেন শেখ হাসিনা। কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে শেখ হাসিনা ওইদিন সকাল ৮টা ৩৫ মিনিটে ঢাকা থেকে বিমানযোগে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে আসেন। এরপর দুপুর ১টার দিকে কয়েক হাজার মানুষের মিছিল নিয়ে শেখ হাসিনার গাড়ির বহর নগরীর কোতোয়ালী থানার কাছে পুরাতন বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনের সামনের সড়ক অতিক্রমকালে পুলিশ নির্বিচারে নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের ওপর হামলে পড়ে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই এলোপাতাড়ি চালাতে থাকে গুলি, টিয়ারগ্যাস। সাথে বেপরোয়া লাঠিচার্জ। জনতা মানব জাল তৈরি করে শেখ হাসিনাকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে সেদিন রক্ষা করে আইনজীবী ভবনে নিয়ে যান।

সেদিন আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর সঙ্গে ছিলেন প্রয়াত অধ্যাপক পুলিন দে, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, আমির হোসেন আমু, প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমদ, প্রয়াত আব্দুল জলিল, প্রয়াত সাইফুদ্দিন আহমদ মানিক, পঙ্কজ ভট্টাচার্য, দিলীপ বড়ুয়া, মোস্তফা মহসিন মন্টু, প্রয়াত আতাউর রহমান খান কায়সার, প্রয়াত এম এ মান্নান, প্রয়াত আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনসহ আরও অনেক কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতা।

আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন। রায় ঘোষণার পর তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘পাখির মতো গুলি করেছিল। চতুর্দিক থেকে নেত্রীকে বহনকারী ট্রাক লক্ষ্য করে এবং জনতার ওপর গুলি করা হচ্ছিল। বোঝাই যায়, টার্গেট ছিলেন নেত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। অনেকে ভেবেছিলেন, আমি মারা গেছি। আমি গুরুতর আহত হয়েছিলাম। সেদিনের দুঃসহ স্মৃতি কখনো ভুলবার নয়।’

শেখ হাসিনার সঙ্গে একই ট্রাকে থাকা দৈনিক পূর্বকোণের তৎকালীন সিনিয়র রিপোর্টার অঞ্জন কুমার সেনও আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘শেখ হাসিনাকে বহনকারী ট্রাক লক্ষ্য করে গুলি করা হয়েছিল। তিনি পেছনে ছিলেন। সামনে ছিলেন ট্রাকের হেলপার। এজন্য তিনি বেঁচে গেছেন, হেলপারের গায়ে গুলি লেগে সে মারা যায়। আমরা লাফিয়ে ট্রাক থেকে নেমে জীবন বাঁচাই। এত নৃশংস একটি ঘটনার বিচার হতে ৩২ বছর সময় লাগা খুবই দুঃখজনক। রাজনৈতিক নেতাদের আপসকামিতা এবং প্রশাসনের দুর্বলতার কারণেই এটা হয়েছে। তবে রায়ে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন হয়েছে যে, কোনো শাসকের ক্ষমতার মসনদ রক্ষা করার জন্য বেপরোয়া আচরণ করে কেউ পার পায় না।’

আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন আইনজীবী ও আওয়ামী লীগ নেতা ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুলও। তিনি বলেন, ‘সেদিন শাসকগোষ্ঠীর লক্ষ্য ছিল গণহত্যা চালিয়ে আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেওয়া। কিন্তু তাদের সেই লক্ষ্য পূরণ হয়নি। বরং গণআন্দোলন আরও তীব্র হয়েছিল। সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। এক পর্যায়ে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর গণঅভ্যুত্থানে পতন হয় এরশাদের।’

চট্টগ্রাম গণহত্যা নিয়ে বইয়ের লেখক নিরুপম দাশগুপ্ত সারাবাংলাকে বলেন, ‘ন্যায়বিচার হয়েছে। তবে এই রায় আরও দ্রুত হলে যারা বিচার এড়াতে পেরেছেন, তার পার পেতেন না। এরপরও একটা নজির স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু আমি বলতে চাই, যারা সেদিন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রক্ষা করতে গিয়ে অথবা শেখ হাসিনার সমাবেশে যোগ দিতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে, আহত হয়েছে, পঙ্গুত্ব বরণ করেছে, তাদের পাশে যেন শেখ হাসিনার সরকার দাঁড়ায়।’

গণআন্দোলন দমন গণহত্যা টপ নিউজ শেখ হাসিনা স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন

বিজ্ঞাপন

জীবন থামে সড়কে — এ দায় কার?
৮ জানুয়ারি ২০২৫ ১৮:৫২

বাসচাপায় ২ কলেজছাত্র নিহত
৮ জানুয়ারি ২০২৫ ১৮:৩৮

আরো

সম্পর্কিত খবর