সমৃদ্ধ মাতৃভাষা জাদুঘরে দর্শনার্থীর গরিবী হাল
২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ২২:০৮ | আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০১৮ ১৭:৪৫
জান্নাতুল ফেরদৌসী,স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
ঢাকা: রাজধানীর সেগুনবাগিচার শহীদ ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সরণীর কাঁচে মোড়ানো দৃষ্টিনন্দন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনিস্টিটিউট (আইএমএলআই) ভবনটি নজর কাড়ে পথচারীদের। এর বাইরেটা যেমন নজর কাড়া, ভেতরটাতেও তেমনি সম্মৃদ্ধ এক প্রতিষ্ঠান।
ইউনেস্কো ক্যাটেগরি-২ এর মর্যাদা পাওয়া এই ইনিস্টিটিউটের নিচতলাতেই গড়ে তোলা হয়েছে ভাষা জাদুঘর। মহান একুশের এই দিনে সারাবাংলার পাঠকদের এই ভাষা জাদুঘরের সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দিতেই এই প্রতিবেদন। কিন্তু সেখানে গিয়ে রীতিমত হতাশই হতে হয়েছে। দর্শনার্থী ছাড়া একটি জাদুঘরের কী-ই এমন বড়ত্ব? সে প্রশ্নই উঠে এসেছে।
মঙ্গলবার (২০ ফেব্রুয়ারি) সরেজমিনে দেখা যায়, সারাবিশ্বের ৬৬ টি দেশের ভাষার তথ্যসমৃদ্ধ এই জাদুঘরটি একেবারেই জনমানবশূণ্য। একজন মিউজিয়াম সহকারী ছাড়া পুরো জাদুঘরের ভেতরে-বাইরে আর কেউ নেই।
মিউজিয়াম সহকারী সুবর্ণা রায় খুব আগ্রহের সঙ্গে এই প্রতিবেদককে ঘুরে ঘুরে দেখালেন পুরো মাতৃভাষা জাদুঘরটি।
সমৃদ্ধ এই ভাষা সংগ্রহশালায় আছে আড়াই থেকে তিন হাজার বছর আগের মিশরীয় হায়ারোগ্লিফ (চিত্রলিপি), স্পেনের আলতামিরায় পাওয়া ১২ হাজার বছর আগের গুহাচিত্রের চিত্রলিপি।
জাদুঘরে দেয়ালের বোর্ডে শোভা পাচ্ছে ভারতবর্ষের পিপরাওয়ায় পাওয়া খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর আদি ব্রাহ্মী লিপি ও পাকিস্তানের মনসেরাতে পাওয়া সম্রাট অশোকের খরোষ্ঠী লিপি।
অন্যদিকের বড় দেয়াল জুড়ে বাংলালিপি ও সংখ্যালিপির বিবর্তন ও স্বরচিহ্নের বিবর্তন। বাংলা ভাষার আদি উৎস, ইন্দো ইউরোপীয় ভাষাগুলোর উৎপত্তি ও এশিয়ার প্রধান ভাষার নমুনাও রাখা হয়েছে এই জাদুঘরে। প্রদর্শন করা হয়েছে ১৯৮৪ সালে মৃত্তিকাগর্ভ থেকে সংগ্রহ করা আঙ্গুল আকারের মাটির ফলকের কিউনিফর্ম লিপির ত্রিশটি অক্ষরের চিত্রলিপি।
স্টেট অব নিউইয়র্কের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতিপত্র ছাড়াও দেয়াল জুড়ে শোভা পাচ্ছে ১৯৪৭ এর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলায় ভাষণের আলোকচিত্র। ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার সনদপত্র ও ভাষা শহীদদের আলোকচিত্রসহ অনেক দুর্লভ দলিল সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে এই ভাষা জাদুঘরে।
শুধু দলিল আর আলোকচিত্রই নয়, জাদুঘরটির প্রবেশ মুখেই সারাবিশ্বের মাতৃভাষা আর এর তথ্য নিয়ে ভার্চুয়াল আর্কাইভ তৈরির কাজও চলছে। যা অনেকটা শেষের পথে বলে জানালেন সুবর্ণা রায়।
এখানে যারা আসছেন তাদের প্রত্যেকেই মুগ্ধ হচ্ছেন জাদুঘরের সংগ্রহ দেখে। যার প্রমাণ মিললো জাদুঘরের রেজিস্ট্রি খাতায়। সেখানে যা লেখা সেগুলোর সবই প্রশংসা আর মুগ্ধতায় ভরা। তবে সব আয়োজন থাকার পরও দর্শনার্থী কম আসায় আক্ষেপ রয়েছে সে সব মন্তব্যে।
তবে একেবারেই যে দর্শনার্থীর দেখা মেলে না তা নয়, সে প্রমাণ মিললো দর্শনার্থীর রেজিস্ট্রার বুকে। তবে যিনি আসেন তিনি মুগ্ধ না হয়ে পারেন না।
মঙ্গলবার সকালে মোহসিন হাসান লিটু নামের একজন আইনজীবী রেজিস্ট্রার খাতায় লিখেছেন, মাতৃভাষাসহ বিশ্বের সব ভাষাকে জানার সহজতম উপায় এই সংগ্রহশালা। কিন্তু দর্শনার্থী কম আসে বলে মনে হলো। এমন চমৎকার জাদুঘর প্রচারের আলোয় আশা উচিত।
আরেকজন দর্শনার্থী পরিচয়ে লেখা রয়েছে শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি লিখেছেন, আগে কখনও এতো তথ্য সমৃদ্ধ আন্তর্জাতিক মানের এমন সংগ্রহশালা দেখিনি। সরকারকে ধন্যবাদ। তবে এর পরিচিতি বাড়ানো দরকার। এটি সবার কাছে পৌঁছে দিতে হবে।
বিশাল এ জাদুঘরটির লোকবল বলতে ওই সুবর্ণা রায়। যিনি গত চার বছর ধরে এখানকার দ্বায়িত্বে পালন করছেন। দর্শনার্থী কম থাকায় আক্ষেপ শোনা গেলো তার কণ্ঠেও। সুবর্ণা জানান, প্রতিদিন গড়ে দুই তিনজন করে দর্শনার্থী আসেন। তবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটে যারা প্রশিক্ষণ নিতে আসেন তারাও ঘুরে দেখে যান।
রেজিস্ট্রি খাতার হিসেবে গত জানুয়ারি মাসে এই ভাষা জাদুঘরে দর্শণার্থী এসেছে মাত্র ২১ জন, আর ২০ ফ্রেবুয়ারি পর্যন্ত ১৬ জন।
এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সিটিটিউটের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. জিনাত ইমতিয়াজ আলী জানান, লোকবলের অভাব আছে। তবে জাদুঘরটির ব্যাপক প্রচারের জন্য সম্প্রতি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চিঠি দেয়া হয়েছে।
এছাড়া আগামী জুনের মধ্যেই ভার্চুয়াল জাদুঘর চালু করা হবে। তিনি জানান, ছয়তলা ভবনের নিচতলায় গড়ে তোলা এই ভাষা জাদুঘর ছাড়াও তিন কোটি টাকার প্রকল্পের আওতায় এরইমধ্যে শেষ করা হয়েছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির ভাষা সমীক্ষা ,উচ্চমানের ভাষা লাইব্রেরি ও সারাবিশ্বের লিখনরীতির আর্কাইভ।
সারাবাংলা/জেডএফ