একুশে ফেব্রুয়ারির আত্মত্যাগ
২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১৮:২৬ | আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১৮:৩৩
মামুন রশীদ
সাধারণ মানুষ যেন বুঝতে পারে, তাদের জন্য যেন সহজ হয় সকল দাফতরিক কাজকর্ম— তাই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উঠেছিল। আজ বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা। আমাদের দাফতরিক ভাষা। কিন্তু অধিকাংশ সময় যে বাংলা ব্যবহৃত হয়, তা সাধারণের ভাষা না। এখনো দাফতরিক চিঠিপত্রে সাধারণ বাংলা, যাকে আমরা প্রমিত বাংলা বলে চিহ্নিত করি, তার ব্যবহার নেই। এখনো মানুষের মুখের ভাষার সঙ্গে দাফতরিক ভাষার তফাৎ অনেক। এখনো ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে সামান্য কথাকে বর্ণনা করা হয়। এখনোও গৎবাঁধা দাফতরিক ভাষাই নানাক্ষেত্রে ব্যবহৃত। ঠিক একইভাবে আমাদের এ অঞ্চলের, এ ভূখণ্ডের মধ্যে বসবাসকারী অন্য ভাষার প্রতি আমাদের ‘বিমাতা-সুলভ’ আচরণও কিন্তু স্পষ্ট।
কয়েক বছর আগে একটি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, আমাদের সিলেট অঞ্চলে বসবাসকারী ‘পাত্র’ সম্প্রদায়ের কথা। প্রতিবেদনটিতে পাত্রদের সম্পর্কে বলা হয়, ‘পাত্রদের যদি নিঃস্ব জাতি বলা হয়, তাদের ভাষাকে বলতে হবে নিঃস্বতর ভাষা।’ পাত্র সম্প্রদায়ের ভাষার নাম ‘লালং’। এ ভাষা তাদের নিজস্ব। তাদের আলাদা সংস্কৃতি ও ভাষা থাকলেও নেই বর্ণমালা। ফলে ভাষাটির লিখিত রূপও নেই।
পাত্ররা নিজেদের লালং জাতি এবং ভাষাকে লালং ভাষা বলে। প্রতিবেদনটিতে একটি জরিপের ফল উল্লেখ করে আরও বলা হয়েছিল— সিলেট জেলার জৈন্তা, গোয়াইনঘাট ও সিলেট সদর মিলিয়ে বর্তমানে রয়েছে ৬০৭টি পাত্র পরিবার। এসব পরিবারের জনসংখ্যা তিন হাজার ৬৩৩ জন। পাত্রদের প্রায় সবাই লালং ভাষায় কথা বললেও তাদের ভাষায় বাংলা শব্দ এখন এমনভাবে মিলেমিশে গেছে, বর্তমানে লালং ভাষায় প্রায় ৫০ শতাংশের মতো বাংলা শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এমনকি পাত্রদের এক থেকে দুই শতাংশ মানুষ নিজেদের মধ্যে এখন লালং ভাষায় কথাই বলে না।
ভাষা বদলের এই চিত্র সবচেয়ে বেশি ঘটছে পাত্র শিশুদের বেলায়। তাদের কাছ থেকে দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে মাতৃভাষা। তারা লালংয়ের পরিবর্তে বাংলা শিখছে, পাত্র বয়োবৃদ্ধদের বিদায়ের মধ্য দিয়ে লালং ভাষারও বিদায় ঘণ্টা বাজছে। হয়তো খুব দ্রুতই এ ভাষা হয়ে উঠবে ইতিহাসের অংশ হবে। তার মানে আমরা, যারা মাতৃভাষার জন্য আন্দোলন করেছি, বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছি, প্রাণ দিয়েছে বন্দুকের সামনে। তাদের হাতেই, তাদের ভাষার আগ্রাসনেই হারিয়ে যাচ্ছে সেই দেশেরই অন্য একটি ভাষা!
বাংলা ভাষাভাষীদের কাছেই একই দেশের অন্য ভাষাগুলো হেরে যেতে বাধ্য হচ্ছে। এটা শুধু লালংয়ের ক্ষেত্রেই নয়, আমাদের অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃজাতি-গোষ্ঠীর সম্প্রদায়ের ভাষারও একই পরিণতি।
বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় মানুষ বুকের রক্ত দিয়েছে। আজ সেই ভাষা কেন অন্য ভাষার সঙ্গে বিরূপ আচরণ করছে? আসলে ভাষা দিয়ে, অর্থাৎ জোর করে চাপিয়ে দেওয়া ভাষার মাধ্যমে যেকোনো জাতির, একটি জনগোষ্ঠীর চিন্তা, মত প্রকাশের যে সুযোগ ও সীমা, তাকে খণ্ডিত ও বদ্ধ করে দেওয়া সম্ভব। আর এক্ষেত্রে সেটাই করছে বাংলা ভাষা। ফলে আমরাই অন্য একটি ভাষার হারিয়ে যাওয়া দেখছি, মেনে নিচ্ছি।
অথচ আমরাই ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছি। সেকি শুধুই ছিল ভাষার জন্য আবেগ? তা তো নয়। বরং এর পেছনে যেমন আবেগ ছিল, তারচেয়েও বেশি ছিল যুক্তি এবং আমাদের অধিকার সচেতনতা। আমরা শাসিতের ভাষা বুঝতে চেয়েছিলাম, যাতে করে পূর্বে আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া জুলুম-নির্যাতন যেন প্রতিহত করতে পারি। যেন আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারি। যেন আমরা নিজেদের অধিকার বুঝে নিতে পারি। এর মাধ্যমে আমরা একইসঙ্গে খুঁজে নিতে চেয়েছিলাম আমাদের স্বাতন্ত্র্যও। আমরা খুঁজে নিতে চেয়েছিলাম আমাদের আত্মনুসন্ধান। সেইসঙ্গে আমরা আমাদের সত্তাসন্ধানের প্রক্রিয়াও শুরু করেছিলাম। আজ লালং ভাষার শব্দ সম্ভারে ঢুকে পড়েছে প্রায় অর্ধেক বাংলা শব্দ। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বলা যায়, এই ভাষাটি হারিয়ে ফেলছে তার নিজস্বতা। ভাষার এই আগ্রাসন, সে কিন্তু আমাদরে দিকেও আঙুল তুলে আছে।
আজ কিন্তু আমরা হিন্দি ভাষা নিয়েও চিন্তিত। টিভি সিরিয়াল ও হিন্দি চলচ্চিত্র দেখে আমাদের শিশুরাও হিন্দি শিখছে। স্বাভাবিকভাবেই এতে আমরা খুশি না। অথচ আমাদের তো খুশি হবার কথা ছিল। খুশি হবার কথা ছিল এই ভেবে যে— আমাদের শিশুরা ছোট থেকেই বাংলার সঙ্গে আরও একটি ভাষা শিখছে, তারা ছোট থেকেই হয়ে উঠছে ‘বহুভাষাবিদ’। কিন্তু আমরা এক্ষেত্রে আশাবাদী না হয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ছি। কেন? এই ‘কেন’র উত্তরের মধ্যেই রয়েছে সমাধান।
মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা— এই স্লোগান আমরা ধারণ করেছিলাম। কারণ, মাতৃভাষার মাধ্যমে পড়ালেখা যতটা বোধগম্য হতে পারে, মানুষ যতটা বিকশিত হতে পারে, সমৃদ্ধ হতে পারে— অন্য ভাষায় শিক্ষাগ্রহণের মধ্যে ততটা কখনোই সম্ভব হয় না।
নিজস্ব ভাষার মাধ্যমে একটা দেশের, একটি জাতির সংস্কৃতি বেঁচে থাকে। কারণ একটি জাতির নিজের অস্তিত্ব, তার শেকড় তার ভাষা। এটা আমাদের বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য তেমনি আমাদের এ অঞ্চলে বসবাসরত অন্য ভাষাভাষীদের ক্ষেত্রেও সমান প্রযোজ্য।
এ অঞ্চলে বসবাসরত আদিবাসীদের ভাষার সঙ্গে তাদের সংস্কৃতি, তাদের চেতনা, তাদের জীবনযাপন, সব মিলে মিশে আছে। বাংলা আমাদের প্রাণের ভাষা, আমাদের মায়ের ভাষা। আমাদের প্রতিবাদের ভাষা, আমাদের স্বাধীনতার ভাষা। এই ভাষার আত্মত্যাগের ইতিহাসের শিক্ষা থেকেই আমরা অন্য ভাষাভাষীদের শ্রদ্ধা করব, তাদের ভাষা বাঁচিয়ে রাখার উদ্যোগ নেব। আর এটা করব নিজেদের স্বার্থেই। একুশের ফেব্রুয়ারি আত্মত্যাগ কি আমাদের এই শিক্ষাই দেয় না?
লেখক: সাংবাদিক, কবি