Tuesday 07 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বেল্ট অ্যান্ড রোড: ঋণের ফাঁদ নয়, উন্নয়নে সর্বজনের অন্তর্ভুক্তি


১৭ ডিসেম্বর ২০১৯ ১৬:৪৫ | আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯ ১৮:১২

২০১৩ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং প্রস্তাবিত বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) আলোচনা আজ দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে গেছে। এরই মধ্যে চীনের এই উদ্যোগের সুফল মানুষ পেতে শুরু করেছে। সেই আলোচনায় বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিআরআই উদ্যোগে চীনের সাথে একাত্ম হয়েছিল। বাংলাদেশের সেই সমর্থন চীন চিরদিন মনে রাখবে।

দুনিয়ার ইতিহাসে চীনই প্রথম সীমান্তের তোয়াক্কা না করে প্রকৃতার্থেই সবার স্বার্থ নিয়ে ভাববার সাহস দেখিয়েছে। বারবার চীনের পক্ষ থেকে বিআরআইয়ের প্রকৃতি সম্পর্কে সবাইকে জানানো হলেও, এই প্রকল্প নিয়ে জিজ্ঞাসা, আগ্রহ এবং অমূলক প্রচারণার যেন শেষ নেই।

বিজ্ঞাপন

সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে এসে যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী প্রতিরক্ষা সেক্রেটারি র‍্যানডাল জি স্ক্রাইভার যেমনটা বলে গেলেন, ‘বিআরআই প্রস্তাবিত আঞ্চলিক উন্নয়ন অংশীদার রাষ্ট্রগুলোর পক্ষে বিনামূল্যে বা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে পাওয়া সম্ভব নয়। উল্টো এই উদ্যোগ রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব এবং আন্তর্জাতিক আইনের সাথে সাংঘর্ষিক।’

বিগত কয়েক বছরে যুক্তরাষ্ট্র যে আচরণ করেছে তার সম্পূর্ণ বিপরীতে চীন। কারণ, বৈশ্বিক স্বার্থ ও আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কিত ইস্যুগুলো আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের আচরণ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। অন্য প্রসঙ্গের কথা বাদ দিলেও এই উদ্যোগ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যায় অপবাদ এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য অবশ্যই এই অঞ্চলে যেকোনো ধরনের শান্তি স্থাপনের প্রচেষ্টা ও বিকাশের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক।

তবুও বিআরআই আসলে কীভাবে সর্বজনের প্রতিনিধিত্ব করে তা এখনও সবার বোধগম্য হচ্ছে না। বিশেষত, উন্নত বিশ্বের দেশ যুক্তরাষ্ট্র যখন এই উদ্যোগকে বিদ্যমান আন্তর্জাতিক আইনের জন্য হুমকি বলে মিথ্যাভাবে ব্যাখ্যা করে, তখন আমি বিআরআই সম্পর্কে কিছু বলতে চাই।

বিজ্ঞাপন

বিআরআই মূলত তিনটি বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়েছে। যথা:

১. উন্মুক্ত প্রকৃতির

২. সর্বজনের অন্তর্ভুক্তিমূলক

৩. পারস্পরিক বিনিময়বান্ধব

বেল্ট অ্যান্ড রোড কী?

বেল্ট অ্যান্ড রোডের উদ্যোগের অধীনে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার সুবিধাকে লক্ষ্য ধরে কয়েকটি মহাদেশ এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে যোগাযোগের একটি প্লাটফর্ম তৈরির জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রায় দুই হাজার বছর আগের ইউরেশিয়ান মহাদেশজুড়ে বিস্তৃত সিল্করুটের ধারণা থেকে এই উদ্যোগ যাত্রা। সিল্করুট হলো- সিল্ক, চিনামাটির আসবাপপত্র, মশলা, মদ ইত্যাদির বাণিজ্য প্রসারের জন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যকার যাত্রাপথ। সেই সময়, বণিকদের বাণিজ্য শুরু করার ক্ষেত্রে চীন ছিল প্রারম্ভিক পয়েন্ট। সেই বাস্তবতা থেকে দেশটি এখন আবার সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট এবং একবিংশ শতাব্দীর মেরিটাইম সিল্ক রোডের সূচনাকারী হিসাবে কাজ করতে আগ্রহী।

বিআরআই ধারণাটি সর্বজনের দেশ ও অঞ্চল, উন্নয়নের স্তর, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ধর্ম, রীতিনীতি ও জীবনযাত্রাকে আশ্রয় করে তৈরি হয়েছে। এই উদ্যোগ হবে উন্মুক্ত, সর্বজনের অন্তর্ভুক্তিমূলক, পারস্পারিক বিনিময়ে ও শান্তিপূর্ণ উন্নয়নের অপর নাম। সবার পরামর্শ, অবদান এবং অংশীদার নীতির ভিত্তিতে বিআরআই প্রধানত পাঁচটি ক্ষেত্রে কাজ করার মাধ্যমে বিকাশ ও সমৃদ্ধির যৌথ পরিবেশ তৈরি করতে চায়। সেগুলো হলো- নীতির সমন্বয়, অবকাঠামোগত সুবিধা সৃষ্টি, নিরবিচ্ছিন্ন বাণিজ্য, অর্থনৈতিক সংহতি এবং মানবিক সম্পর্ক উন্নয়ন।

মানবিক সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে অবকাঠামোগত বড় প্রকল্প, বাণিজ্য ও বিনিয়োগের দিকে মনোনিবেশের মাধ্যমে সক্রিয় অর্থনৈতিক কার্যক্রম নিঃসন্দেহে বিআরআইয়ের সবচেয়ে স্পষ্টতম অংশ। তবে যোগাযোগের অন্যান্য ক্ষেত্র যেমন: সংস্কৃতি বিনিময়, প্রযুক্তি স্থানান্তর এবং জনগণের সাথে যোগাযোগ বাড়ানোর প্রস্তাবও দেয় বিআরআই। স্থানীয় সংস্থাগুলোর সহযোগিতায় বাংলাদেশে ছয় বছর ধরে চীনা নবববর্ষ আয়োজন রীতিমতো সাংস্কৃতিক কার্নিভালে পরিণত হয়েছে। পর্যটন, শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে চীনে ভ্রমণকারী বাংলাদেশিদের সংখ্যা আশ্চর্যজনক হারে বাড়ছে। এছাড়াও, অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি এবং অ্যাকাডেমিক এক্সচেঞ্জের জন্য চীনা থিংক ট্যাঙ্ক, পণ্ডিত এবং বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশে আসছেন। এ সবকিছু বিআরআই উদ্যোগেরই অংশ।

কেন বেল্ট অ্যান্ড রোড?

এখন পর্যন্ত চীনের সাথে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে (বিআরআই) চুক্তিবদ্ধ হয়েছে ১৫০টি দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা। ২০১৩ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিআরআইভুক্ত দেশগুলোর সাথে চীনের বাণিজ্য দাঁড়িয়েছে ৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। ওই দেশগুলোর বিভিন্ন খাতে এককভাবে চীন বিনিয়োগ করেছে ৯০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিআরআই উদ্যোগের মাধ্যমে স্থানীয়দের জন্য দুই লাখ ৪৪ হাজার চাকরির ক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছে। সমাজের অভিন্ন ভবিষ্যতের ব্যাপারটি উল্লেখ করে দলিল দস্তাবেজ জাতিসংঘ ও জি২০ এর মতো আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর কাছে পাঠানো হয়েছে। বৈশ্বিক শান্তি ও উন্নয়নে বিআরআইয়ের অনস্বীকার্য ভূমিকা ওই সংগঠনগুলো স্বীকার করে নিয়েছে । সে কারণেই সবাই মিলে এগিয়ে যাওয়ার এক নতুন উপলক্ষ তৈরি হয়েছে।

বিআরআই উদ্যোগের সূচনালগ্ন থেকেই জড়িত থাকার কারণে বাংলাদেশ এখান থেকে বিশেষভাবে উপকৃত হচ্ছে। ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের সাথে চীনের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়ে ১৮ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে থেকে ২০১৮ বাণিজ্যবর্ষ শেষ করেছে। চীনের চলমান গুরুত্বপূর্ণ জিটুজি প্রকল্পের অন্যতম অংশীদার বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্নের পদ্মাসেতুতে কারিগরি ভূমিকা রাখছে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এবং দেশটির রেলওয়ে ব্রিজ নির্মাণ প্রকৌশলীদের একটি দল।

এছাড়াও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আটটি বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু, মৈত্রী প্রদর্শনী কেন্দ্র, আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র তৈরির কাজ চলছে। বিশেষত, ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের বাংলাদেশ সফরের পর থেকে বিআরআই উদ্যোগের বিভিন্ন পদক্ষেপ দ্রুত থেকে দ্রুততম সময়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে।

বেল্ট অ্যান্ড রোড কি ঋণফাঁদ?

বিআরআই উদ্যোগের বিরুদ্ধে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোর বহুল প্রচারিত একটি অভিযোগ হলো- এর মাধ্যমে অংশীদার রাষ্ট্রগুলোকে কৌশলে বড় ধরনের ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে ফেলছে চীন। যে ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য ওই রাষ্ট্রগুলোর নেই। যদিও বহুবার চীনের সরকারি কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর প্রতিনিধিরা নিজ মুখেই এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তারপরও মিথ্যা প্রচারণা থেমে নেই।

এ প্রসঙ্গে শ্রীলংকা একটি ভালো উদাহরণ হতে পারে। শ্রীলংকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, শ্রীলংকার মোট ঋণের ১০ দশমিক ৬ শতাংশ চীনের কাছে। চীনা ঋণের ৬১ শতাংশরই সুদ আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় অনেক কম। শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার এবং বিরোধীদলীয় নেতা স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, চীনা ঋণ নয়, তারা বহুজাতিক সংস্থার ঋণ পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছেন। বরং চীনের সমর্থনেই তারা অন্যান্য উৎস থেকে পাওয়া ঋণ পরিশোধে উদ্যোগী হতে পারছেন। একই রকম ঘটনা পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে। তাদের মোট ঋণের ১০ শতাংশ পেয়েছে চীনের কাছ থেকে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন আরও সুসংগঠিত। কিছুদিন আগেই বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর জানিয়েছেন, দেশটির মোট ঋণের ৩০ শতাংশের কম তারা চীনের কাছ থেকে নিয়েছে। তাই ওই ঋণকে ফাঁদ ভাবার কোনো সুযোগ নেই। তারপরও বিআরআই উদ্যোগের অংশীদার রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা তৈরির স্বার্থে টেকসই ঋণ ফ্রেমওয়ার্কের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সহযোগিতা অব্যাহত রাখা হয়েছে।

মোটের ওপর গত ছয় বছরে চীন বিআরআই উদ্যোগের অংশীদার রাষ্ট্রগুলোর সাথে কোনো ধরণের ঝুঁকির চর্চাও প্রয়োগ করেনি। বিআরআই উন্মুক্ত এবং উন্নয়নে সর্বজনের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করে। সর্বোপরি, ২০১৯ সালের দ্বিতীয় বিআরআই ফোরাম থেকে প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের ঘোষণা অনুযায়ী, ভবিষ্যতে দ্বিপাক্ষিক, ত্রিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক উদ্যোগের মাধ্যমে বিআরআই উদ্যোগকে আরও দুর্নীতিমুক্ত ও জনবান্ধব করার মাধ্যমে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ অর্জনের চেষ্টা করছে চীন। এখানে অংশীদারদের জাতীয় স্বার্থ এবং পরিবেশ ইস্যুকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। পারস্পারিক সহযোগিতার মাধ্যমে কল্যাণমূলক পৃথিবী গড়ে তোলার এই লড়াইয়ে যোগ দিতে অন্যান্য রাষ্ট্রের প্রতি চীন উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছে।

লেখক: বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত

চীন বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ রাষ্ট্রদূত লি জিমিং

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর