২০৩০ সালের আগেই দেশকে কুষ্ঠমুক্ত করার ঘোষণা প্রধানমন্ত্রীর
১১ ডিসেম্বর ২০১৯ ১৫:১৯ | আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০১৯ ১৯:১১
ঢাকা: ২০৩০ সালের আগেই দেশকে কুষ্ঠ রোগীমুক্ত করার আশা দেখছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘আমরা ২০৩০ সাল না, তার আগেই বাংলাদেশকে কুষ্ঠরোগী শূন্য করতে সক্ষম হবো। হাম-পোলিওসহ বিভিন্ন রোগ একে একে আমরা দূর করেছি।’ তাই এই অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে দেশের সকলকে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।
বুধবার (১১ ডিসেম্বর) সকালে রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে ২০৩০ সালে কুষ্ঠরোগ নির্মূল শীর্ষক জাতীয় সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
কুষ্ঠ আক্রান্তদের সাহায্যে নিজের সময় কাটানোর বিভিন্ন অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘মহাখালীতে আমার স্বামী পরমাণু বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করতেন, ওখানে এটমিক এনার্জির কোয়াটার আছে। যখন ওনাকে থাকতে শুরু করি, তখন আমি দেখতাম প্রায় ৫০-৬০ জন বা একটু কম-বেশী তারা ওখানে চলে আসত। কেন আসত ঠিক আমি জানি না! কিন্তু আসলেই তাদেরকে নগদ অর্থ দিয়ে সাহায্য করতাম, খাবার-টাবার যা জোগাড় থাকত, তাদেরকে দিতাম।’
বিভিন্ন সময়ে কুষ্ঠরোগীদের সাহায্য সহযোগিতা করার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘তাদের সাথে আমার একটা অন্যরকম সম্পর্ক হয়ে যায়। প্রথম প্রথম অনেকেই তাদেরকে খাবার দিতে যেতে চাইত না। মনে করত, কাছে গেলে কি যেন কি হবে? আমি নিজে যখন দেওয়া শুরু করলাম, আমার সঙ্গে যারা ছিল তারাও তখন আন্তরিকতার সঙ্গে তাদের পাশে দাঁড়াত। আমি বলেছিলাম যদি কখনো সরকারে যেতে পারি, আপনাদের জন্য একটা ব্যবস্থা করবো।’
‘সেই ব্যবস্থাটা পরিবর্তীতে করেছিলাম গাজীপুরে কালিয়াকৈর উপজেলার গোয়ালি ইউনিয়ন একটি জায়গায় তাদের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প নির্মাণ করে।’ এ ব্যাপারে সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কুষ্ঠ রোগে আক্রান্তদের দূর দূর ছাই ছাই না করে, তারাও সমাজের অংশ। তারাও আমাদের এবং তারা রোগাক্রান্ত। এই কথাটা মাথায় রেখে তাদের চিকিৎসায় ব্যবস্থা নিতে হবে। তারা যে সুস্থ হয়ে উঠবে না, তা কিন্তু না।’
কুষ্ঠরোগীদের পরিসংখ্যান তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘১৯৮৫ সালে যেখানে পঙ্গুত্ববরণকারীর সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। সেটা এখন কমে ২৯৭ জনে নেমে এসেছে। প্রায় ৪ হাজার লোক বছরে পঙ্গুত্ব বরণ করত। সেটা আমি কমিয়ে ফেলতে শুরু করেছি। এখনো রোগী শনাক্ত করা হচ্ছে এবং প্রতিবছর ৩ হাজার ৭২৯ জনের মতো রোগী শনাক্ত করছি। তবে এটা একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে যদি শনাক্ত করা যায়, আর যদি চিকিৎসায় ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তাহলে এটা আর বৃদ্ধি পায় না এবং তাদেরকে পঙ্গুত্ববরণ করতে হয় না। তারা সুস্থ হয়ে যেতে পারে। সেই সুযোগটা রয়েছে। সেই জন্য আমরা এই উদ্যোগটা নিয়েছি।’
এজন্য শুরু থেকেই সচেতনতা সৃষ্টিরর পাশাপাশি চিকিৎসকসহ সেবা প্রদানকারী লোকদের প্রতি অনুরোধ জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘সব থেকে প্রয়োজন, সামাজিকভাবে একটা সচেতনতা সৃষ্টি করা। সাধারণ মানুষকে বলব, এরা আমাদের সমাজেরই একজন। কাজেই তাদেরকে দূরে ঠেলা না। যদি এ ধরনের কোনো লোক পাওয়া যায়, তাদেরকে সহানুভূতির সাথে দেখা, তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা এবং তারা যেন ভালভাবে সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন সেই দিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি একান্তভাবে প্রয়োজন।’
তিনি আরও বলেন, ‘১৯৯৮ সালের মধ্যেই আমরা প্রায় ১০ হাজার জনগণের মধ্যে একজন কুষ্ঠরোগী নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলাম। আমরা কিন্তু এমডিজি অর্জন যেটা ২০০০ সালে অর্জন করার কথা ছিল সেটা ১৯৯৮ সালেই অর্জন করে ফেলেছিলাম। কাজেই এই অসাধ্য সাধনটা করা সম্ভব।’
কুষ্ঠ রোগের প্রাদুর্ভাব বাংলাদেশের সব এলাকায় সমান না। কিছু কিছু এলাকায় বেশি দেখা যায় বলেও একটি জরিপের তথ্য তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। এ লক্ষ্যে যেসব এলাকায় এখন বেশি দেখা যাচ্ছে, সেই সব এলাকার দিকে আরও বিশেষভাবে দৃষ্টি দেওয়ার আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, ‘আমরা যদি এটা করতে পারি, তাহলে মনে করি, ২০৩০ লাগবে না। বরং তার পূর্বেই বাংলাদেশকে আমরা এই ল্যাপরোসি শূন্য করতে সক্ষম হবো, এটা আমার বিশ্বাস। আমরা মনে করি, এটা তাদের অধিকার।’
১৮৯৮ সালে ব্রিটেনের একটি আইনে কুষ্ঠ রোগীদের আশ্রয় কেন্দ্রে বন্দী রাখার বিধান ছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সেই আইনটি কিন্তু আমাদের দেশেও প্রচলিত ছিল। আমরা সেই আইন পরিবর্তন করে দিয়েছি। আমরা ২০১১ সালে সেই আইন পরিবর্তন করে দিয়েছি। কুষ্ঠ রোগীদের বন্দীখানায় নয়, তাদেরকে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। তারা সমাজেরই একজন। সেই হিসাবে স্বীকৃতি দিতে হবে। তারা যেন সুস্থ হতে পারে, তার জন্য যা যা করণীয় করতে হবে। আর নতুন কেউ যেন আক্রান্ত না হয়, সেটাও দেখতে হবে। সেই ব্যাপারে আরও সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।’
সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ ও সচেতনতার ফলে প্রতিবিন্ধীরা এখন সমাজের মূলস্রোতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, সে দিক বিবেচনায় কুষ্ঠরোগীদের প্রতিও সহানুভূতিশীল এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে সবাইকে দেখার আহ্বান জানান।
বাংলাদেশে পোলিও, হামসহ বিভিন্ন রোগ দূর করার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কাজেই বাংলাদেশ পারবে না, এটা ঠিক না। আমি মনে করি, আমরা পারব।’
জনগণের দোরগোঁড়ায় চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে ঔষধ কোম্পানি গুলোর ভূমিকা স্মরণ করেন এবং বিনা পয়সায় কুষ্ঠরোগীদের ঔষধ সহযোগিতা করারও আহ্বান জানান সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘আমাদের ল্যাপরোসি রোগীদের জন্য যে বিশেষায়িত ঔষধটা দরকার, সে ঔষধটা যদি তারা দেশে উৎপাদন করে এবং বিনামূল্যে বিতরণের ব্যবস্থা নেয় তাহলে কিন্তু আমরা খুব তাড়াতাড়ি আামদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব।’
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘কারও কুষ্ঠ রোগ দেখা গেল, আর তাকে চাকরি থেকে বের করে দিতে হবে, তাকে সমাজ থেকে দূরে ঠেলে দিতে হবে, তাকে ফেলে দিতে হবে, এই মানসিকতা সম্পূর্ণভাবে পরিহার করতে হবে। কারও যদি কুষ্ঠ রোগ দেখা দেয়, তাকে চাকরিচ্যুত করা যাবে না, তাকে সমাজ থেকে দূর দূর করা যাবে না। তাকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। যেখানে সে চাকরি করবে, তাদেরই একটা দায়িত্ব থাকবে, সে যেন সুচিকিৎসা পায়। তিনি যেন সুস্থ হতে পারে। এর ফলে সে যেন পঙ্গুত্ব বরণ না করে। এটা তাদের নিজের দায়িত্ব হিসাবে নিতে হবে। সেই অনুরোধটাও সবাইকে করে যাচ্ছি।’
‘একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, এক সময় মনে করা হত এটা একটা অভিশাপ। আসলে এটা অভিশাপ না। এটা একটা জীবাণু সংক্রামণের মাধ্যমে হয়। তাহলে কোন জীবাণু সংক্রামণের মাধ্যমে হয়, গবেষণার মাধ্যমে সেটা বের করে, সেই জীবাণুটা যেন বিস্তার লাভ করতে না পারে। এবং আমাদের দেশ থেকে যেন এটা সম্পূর্ণভাবে চিরতরে দূর হয়, তার পদক্ষেপ আমাদের নিতে হবে।‘
‘এর জন্য আমি মনে করি, আমাদের গবেষণাও একান্তভাবে প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গবেষণা হচ্ছে, ঔষধ বের হচ্ছে। আামদের দেশেও আমরা এটা করতে পারি। তাতে আমরা নিজেরাই নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারব। পরনির্ভরশীল হতে হবে না। আমরা সেটাই চাই’- বলেন শেখ হাসিনা।
কুষ্ঠরোগে আক্রন্তরাও যাতে সমাজে তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে সুন্দরভাবে বাঁচতে পারে, সেই পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আহ্বান জানান তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি বিশ্বাস করি, ২০৩০ সাল না, তার পূর্বেই যেন আমরা অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারি। সেইভাবে আমাদের সকলকে কাজ করতে হবে।’
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের সভাপতিত্বে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শেখ ফজলুল করিম সেলিম এবং স্বাগত বক্তব্য রাখেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব আসাদুল ইসলামসহ অন্যরা।