Thursday 09 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘মেয়েটা কোলেই মারা গেল, বাঁচাতে পারলাম না’


১২ নভেম্বর ২০১৯ ২৩:৫৬ | আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০১৯ ১৩:১৭

ঢাকা: ‘মেয়েটা আমার কোলেই ছিল। হঠাৎ যখন জোরে শব্দ পাই, তখন মেয়েটাকে আরও জোরে জড়িয়ে ধরি। কিন্তু মেয়েটাকে বাঁচাতে পারলাম না।’

কথাগুলো বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন নাজমা আক্তার (৩০)। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা কেড়ে নিয়েছে তার দুই বছর দুই মাস বয়সী মেয়ে আদীবা আক্তার সোহার প্রাণ। এই দুর্ঘটনায় তিনি নিজেও আহত হয়ে বর্তমানে চিকিৎসাধীন জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালে (পঙ্গু হাসপাতাল)। ট্রেনে থাকা তার স্বামী মাহিন আহমেদ সোহেল (৩৫) ও চার বছর বয়সী ছেলে নাফিজুল হক নাফিজও একই হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আহত হয়েছেন নাজমার মা’ও।

বিজ্ঞাপন

https://youtu.be/6DOhC3xjwAM

মঙ্গলবার (১২ নভেম্বর) কসবায় তূর্ণা নিশীথা ও উদয়ন এক্সপ্রেসের মুখোমুখি সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন ১৬ জন। তাদেরই একজন নাজমার মেয়ে সোহা। এদিন সন্ধ্যায় পঙ্গু হাসপাতালে সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের কথা হয় নাজমা আক্তারের সঙ্গে।

নাজমা বিলাপ করতে করতে বলেন, ‘মেয়েটা কোলেই মারা গেল। আমি আমার মেয়েকে শেষবারের মতো দেখতে চাই, আমাকে আমার মেয়ের কাছে নিয়ে যাও। আমি হাঁটতে পারছি না। আমার মেয়ের চেহারাটা আমারে কেউ দেখাও।’

মাহিন আহমেদ সোহেল ও নাজমা আক্তার দু’জনেই কাজ করেন চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। চট্টগ্রামেই থাকেন তারা। ছুটিতে গিয়েছিলেন গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জে। সেখান থেকে কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার পথেই এই দুর্ঘটনার শিকার হন সপরিবারে।

নাজমা আক্তার কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, রাত সাড়ে ১২টা বাজে আমি, আমার স্বামী আর আমার দুই বাচ্চাকে নিয়ে ট্রেনে উঠি চট্টগ্রাম যাওয়ার জন্য। আমি জানালার সামনেই বসি। আমার কোলে ছিল আদীবা। আমার মা ছিল পাশে। আদীবার বাবা আর আমার ছেলে আমাদের সামনের আসনে বসেছিল। আদীবা ঘুমিয়েছিল। রাত আড়াইটা থেকে তিনটার দিকে হঠাৎ করে কী হলো বুঝতেই পারিনি। দুনিয়াটা মনে হলো ঘুরন্তি দিলো, আর আমরা সবাই পড়ে গেলাম। আমার শরীরের অর্ধেক কিছু একটার নিচে ছিল। সেখান থেকে আমাকে টেনে বের করা হয়। আমার মেয়েটা তখন আমার বুকের মধ্যে। এরপর দেখি সবাই নিচে পড়ে আছে। আমার মেয়েরে আমি ডাকি, কিন্তু মেয়ে আমার সাড়া দেয় না। মাথায় চাপ লেগে মেয়েটা আমার জায়গার মধ্যেই মারা গেছে। আর আমার স্বামীও অর্ধেক ভেতরে ছিল, ছেলেটা সাইডে ছিল। ছেলেটার বুকের মধ্যে চাপ লেগেছিল।

বিজ্ঞাপন

নাজমা বলেন, আমার পা নাই, আমার স্বামীরও পা নাই। আমার মায়েরও পা নাই। আমরা কিভাবে সামনের দিনগুলি চলব, জানি না।

দুর্ঘটনায় মেয়েকে হারানোর বেদনা রয়েছে। পরিবারের সবার আহত হওয়ার কষ্টও রয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে দুর্ঘটনাস্থল থেকে নিজেদের সম্পদ হারিয়ে মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানোর বেদনাও।

নাজমা বলেন, আমার স্বামী একসময় ব্যবসা করত। সেখানে ক্ষতি হয় প্রায় ৭-৮ লাখ টাকা। আর তাই আমরা চট্টগ্রাম গিয়ে চাকরি শুরু করি। বাড়ি থেকে এবার যাওয়ার সময় আমাদের সঙ্গে অনেক মালপত্র ছিল। টাকা-পয়সা, মোবাইল, চালের বস্তা, ২৫-৩০ কেজি মাছ ছিল। আমার হাতে স্বর্ণের বালা ছিল। কিছছু পাই নাই। ফোন করার জন্য যখন মোবাইল খুঁজি, দেখি কিছছু নাই। আমার মোবাইলে ইমো ছিল। আমার মেয়ের ছবি ছিল ওই মোবাইলেই। কিন্তু এখন আমি আর আমার মেয়ের সেই স্মৃতিগুলোও আর পাব না।

কাঁদতে কাঁদতে নাজমা আক্তার বলেন, ট্রেনে ওঠার আগে আমার মেয়ে কী হাসি-খুশি ছিল। আর এখন সে নাই। আমার স্বামী বা আমি কেউই চাকরি করতে পারব না।

নাজমা আক্তারের স্বামী মাহিন আহমেদ সোহেল সারাবাংলাকে বলেন, ছুটিতে বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলাম। চট্টগ্রামের উদ্দেশে যাওয়ার পথে আখাউড়া জংশন যখন পৌঁছাই, তখন একটি ট্রেন আমাদের ক্রস করে। এরপর কসবা পৌঁছাই। সেখানেও ট্রেনটি কিছুক্ষণ দেরি করে। এর একটু পরে গাড়ি ছাড়ার পরেই মনে হলো যেন গাড়িটা মুহূর্তের মধ্যে দুমড়ে-মুচড়ে গেলো। এরপর আর কিছু বলতে পারি না।

সোহেল বলেন, মেয়েটা আমার সামনেই ছিল। ওর মা আর ও নিচে পড়ে গেছিল। ওদের ওপরে আরও কয়েকজন ছিল। আমি ছেলেটারে উঠায়ে নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু মেয়েটারে আর বাঁচাতে পারলাম না। আমার শ্বাশুড়ির অবস্থাও খুব ব ক্রিটিকাল। সিএমএইচে আছেন তিনি। আমার স্ত্রীর দুইটা পা ও হাত ভেঙেছে। আমার পা ভাঙছে আর কোমড়ের অনেকখানি মাংস উঠে গেছে। বাচ্চাটা অনেক ব্যাথা পেয়েছে।

দুর্ঘটনা স্থলে নিজেদের মালামাল লুটের কথা বলেন সোহেলও। তিনি বলেন, অনেক কিছু নিয়েই ট্রেনে উঠেছিলাম। টাকা-পয়সা, চাল, মাছ অনেক কিছুই ছিল। আমার বউয়ের হাতে দুইটা স্বর্ণের বালা ছিল, কানে স্বর্ণের দুল ছিল, মোবাইল ছিল। কিন্তু কিছুই পাইনি।

উল্লেখ্য, মঙ্গলবার (১২ নভেম্বর) ভোর পৌনে ৪টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার মন্দবাগ রেলওয়ে স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী তূর্ণা নিশীথা এক্সপ্রেসের সাথে সিলেট থেকে চট্টগ্রামগামী উদয়ন এক্সপ্রেসের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ভয়াবহ এ দুর্ঘটনায় সর্বশেষ ১৬ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছেন শতাধিক।

দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন। তিনি জানান, তূর্ণা নিশীথার চালক সিগন্যাল অমান্য করা ভুল বোঝাবুঝি থেকে এ দুর্ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। দুর্ঘটনার কারণ উদঘাটনে পাঁচটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এরই মধ্যে তূর্ণা নিশীথা এক্সপ্রেস ট্রেনের চালক, সহকারী চালকসহ তিন জনকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়।

আদীবা আক্তার সোহা উদয়ন এক্সপ্রেস কসবা ট্রেন দুর্ঘটনা তূর্ণা নিশীথা নাজমা আক্তার ব্রাহ্মণবাড়িয়া মন্দবাগ রেলওয়ে স্টেশন মাহিন আহমেদ সোহেল