চিকিৎসকদের ২ বছরের ইন্টার্নশিপের প্রস্তাব প্রত্যাহার
১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ২০:০৩ | আপডেট: ১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ২১:৫৯
ঢাকা: দেশের মেডিকেল (এমবিবিএস ও বিডিএস কোর্স) শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদের মুখে ইন্টার্নশিপের সময়কাল এক বছর থেকে বাড়িয়ে দুই বছর করার প্রস্তাব প্রত্যাহার করা হয়েছে।
রোববার (১ সেপ্টেম্বর) দুপুরে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, প্রাথমিকভাবে আলোচনা করে মতামত জানানোর জন্য ওয়েবসাইটে যে খসড়া নীতিমালা প্রকাশ করা হয়েছিল তা প্রত্যাহার করা হয়েছে।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ‘মেডিকেল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজের এমবিবিএস-বিডিএস কোর্সের শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নশিপ প্রশিক্ষণ ও ইন্টার্নশিপ ভাতা প্রদান সংক্রান্ত নীতিমালা-২০১৯’ এর খসড়া নীতিমালাটি প্রাথমিকভাবে আলোচনা করে মতামত জানানোর জন্য ওয়েবসাইটে প্রদর্শন করা হয়েছিল। এটি একটি খসড়া নীতিমালা ছিল, কোনো চূড়ান্ত নীতিমালা নয়। নীতিমালাটি চূড়ান্ত করার জন্য সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন আছে বলেও জানানো হয়।
নীতিমালা প্রত্যাহার করা হয়েছে জানিয়ে বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে আলোচনা করে চূড়ান্ত করার আগে আবারও ওয়েবসাইটে প্রদর্শন করা হবে।
ইন্টার্ন চিকিৎসকদের দুই বছরের ইন্টার্নশিপের খসড়া প্রস্তাব বাতিল বিষয়ে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান সারাবাংলাকে বলেন, ‘এটি আসলে চূড়ান্ত কোনো নীতিমালা ছিল না। এই বিষয়ে তেমন কোনো আলোচনাও হয়নি। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই এই ধরনের নীতিমালা দেওয়া হয়েছিল যা আসলে ঠিক হয়নি। বিএমডিসির সঙ্গে আলোচনা করা ছাড়া এমন কোনো নীতিমালা প্রস্তাব করার এখতিয়ারও নেই কারও। আপাততভাবে নীতিমালাটি প্রত্যাহার করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যদি নতুন কোনো কিছু করতে হয় তবে সেটার ভালো-মন্দ, সুবিধা-অসুবিধা সকল দিক আলোচনা করেই করতে হয়। ইন্টার্নশিপ হচ্ছে কারিকুলামের একটি অংশ যা বিএমডিসি তৈরি করে। আশা করবো ভবিষ্যতে এই ধরণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অবশ্যই আলোচনা করে নেওয়া হবে।’
মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত খসড়া নীতিমালা প্রকাশের পরে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে আন্দোলন কর্মসূচি পালন করে শিক্ষার্থীরা। শনিবার (৩১ আগস্ট) স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা কলেজের অধ্যক্ষ ও হাসপাতালের পরিচালককে স্মারক লিপি প্রদান করেন। রোববার (১ সেপ্টেম্বর) সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরাও দুই বছরের ইন্টার্নশিপ বাতিলের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসেন।
নীতিমালাটি প্রকাশের পরই শিক্ষার্থীদের মাঝে ক্ষোভ দেখা দেয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও দেখা যায় প্রতিবাদের ঝড়। বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদে আন্দোলনে নামেন।
সোহরাওয়ার্দি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পঞ্চম বর্ষের ছাত্র ডা. আবদুল্লাহ আল-যাবাইর সারাবাংলাকে বলেন, ‘নীতিমালাটি বাতিলের চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত এখনো জানানো হয়নি। বলা হয়েছে আপাততভাবে প্রত্যাহার করা হয়েছে। আমাদের পড়াশোনার কাজে আমরা সবাই ব্যস্ত থাকি আর তাই আমরা চাই না রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে। কিন্তু অনৈতিক কোনো কিছু মেনে নেওয়া যায় না। আর তাই নীতিমালাটি বাতিল করা বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত না হলে আমরা আশ্বস্থ হতে পারছি না। আমাদের দাবিতে আমরা এখনো আগের অবস্থানেই আছি।’
ডা. আবদুল্লাহ আল-জুবায়ের আরও বলেন, ‘২০১২ সালের কারিকুলাম অনুযায়ী আমরা এখন পড়াশোনা করছি। আমাদের কারিকুলাম সংক্রান্ত যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রাখে বিএমডিসি। আমরা যখন ভর্তি হয় তখন পাঁচ বছরের পড়াশোনা এবং এক বছরের ইন্টার্নশিপ করতে হবে এমন জেনেই আমরা সবাই এখনো পড়াশোনা করছি। কিন্তু মাঝে যদি এমন সিদ্ধান্ত দেওয়া হয় তবে সেটা এক ধরনের অন্যায় হয়ে যায়। আমরা সেটার প্রতিবাদ করছি। অবকাঠামোগত উন্নয়ন, চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছাড়া বিভিন্ন উপজেলায় পাঠানোর সিদ্ধান্তও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। আর সবকিছু মিলিয়ে তাই আমরা চূড়ান্তভাবে এই সিদ্ধান্ত বাতিল না হওয়া পর্যন্ত আমাদের দাবিতে অনড় আছি।’
চিকিৎসকদের নিরাপত্তা ও অধিকার আদায় নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি অ্যান্ড রাইটস’ এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবুল হাসনাৎ মিল্টন বলেন, ‘বর্তমান প্রেক্ষাপটে ডাক্তারদের ইন্টার্নশিপের মেয়াদ দুই বছর করবার প্রস্তাবটা আমার কাছে উদ্ভট বলেই মনে হয়েছে। কী উদ্দেশ্যেই বা ইন্টার্নশিপ দুবছর মেয়াদী করা হবে তাও স্পষ্ট নয়। উপজেলা পর্যায়ে বিরাজমান চিকিৎসকের ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে যদি এটা করা হয়ে থাকে, তবে তা হবে ভীষণ অন্যায় এবং জনস্বার্থবিরোধী একটি পদক্ষেপ। পর্যাপ্ত সংখ্যক চিকিৎসক নিয়োগের মাধ্যমে উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসক সংকটের সমাধান করতে হবে, ইন্টার্ন চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণের মেয়াদ অন্যায্যভাবে এক বছর বাড়িয়ে তা করা যাবে না।’
নীতিমালা পেশের প্রক্রিয়ার ক্ষোভ জানিয়ে ড. আবুল হাসনাৎ মিল্টন বলেন, ‘এত গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রস্তাবনা যেভাবে পেশ করা হলো, তাতেও আমি উদ্বিগ্ন বোধ করছি। ইন্টার্নশিপ মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কারিকুলামের অংশ। এমবিবিএস ও ডেন্টাল ডিগ্রি বা ইন্টার্নশিপের কোন পরিবর্তন আনতে হলে বিএমডিসিকে সে উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে সকল স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। এভাবে মন্ত্রণালয়ে দুয়েকটা সভা করে ওয়েবসাইটে প্রস্তাবনা পেশ করাটাও রীতি বিরুদ্ধ। দেখে শুনে মনে হয়, স্বাস্থ্যখাতটা বোধ হয় আজকাল এডহক ভিত্তিতে চলছে। এ অবস্থার অবসান হওয়াটা জরুরি।’
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ জাহিদুর রহমান খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এমবিবিএস এবং বিডিএস ডাক্তারদের জন্য ইন্টার্নশিপ এক বছর থেকে বাড়িয়ে দুই বছর করার চিন্তা ভাবনা করছেন বলে একটি খসড়া নীতিমালা দিয়েছিল ওয়েবসাইটে। যেখানে উল্লেখ করা ছিল চিকিৎসকদের এক বছর নিজের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং এক বছর যেকোন উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ইন্টার্নশিপ করতে হবে। এই সিদ্ধান্ত কাদের সঙ্গে আলোচনা করে নেওয়া হয়েছে তা নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকে যায়। এখানে যেটা পরিষ্কার করে বলতে হয় তা হলো ইন্টার্নশিপ স্বাস্থ্য সেবার অংশ নয়, স্বাস্থ্য শিক্ষার একটি অংশ। উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সেই শিক্ষার সুযোগ একেবারেই অপ্রতুল। পর্যাপ্ত জনবল সেখানে আছে কি না তাও ভাবনার বিষয়। আর তাই নিরাপত্তার বিষয়টি চলে আসে। একই সঙ্গে অবকাঠামোগত দিকও একটি ব্যাপার। বর্তমান প্রেক্ষাপটে মেডিকেল কলেজের পরে ইন্টার্নশিপ চালু করলে কেবল বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতেই করা যায়, কোনভাবেই উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে না। সমাজের সব পেশার মানুষেরই এরকম আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা উচিত।’
উল্লেখ্য, ২৭ আগস্ট সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে এই খসড়া নীতিমালা প্রকাশ করা হয়। বর্তমানে পাঁচ বছরের এমবিবিএস কোর্সের পর মেডিকেলের শিক্ষার্থীদের এক বছর নিজ প্রতিষ্ঠানে ইন্টার্নশিপ করতে হয়। নতুন নীতিমালার এটি দুই বছর করার প্রস্তাব করা হয়। একই সঙ্গে দুই বছরের মধ্যে প্রথম বছরটি শিক্ষার্থীদের নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইন্টার্নশিপ করতে হবে বলেও জানানো হয়। আর দ্বিতীয় বছর কোনো উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তাদেরকে যুক্ত করা হবে বলেও উল্লেখ করা ছিল নীতিমালায়।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল, প্রথম বছরের প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান দ্বিতীয় বছর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অনুশীলন করবে। আগামী ১৮ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ওই খসড়ার ওপর মতামত চাওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে।