ভিআইপির অপেক্ষায় ফেরি, অ্যাম্বুলেন্সেই প্রাণ গেল স্কুলছাত্রের
২৯ জুলাই ২০১৯ ০৩:০৭ | আপডেট: ২৯ জুলাই ২০১৯ ০৯:৫৭
মাদারীপুর: কাঁঠালবাড়ি ১ নম্বর ফেরিঘাটে ফেরির জন্য অপেক্ষমান সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত স্কুলছাত্র বহনকারী একটি অ্যাম্বুলেন্স। অ্যাম্বুলেন্সটির ফেরিতে উঠতে সময় লাগে তিন ঘণ্টা। ততক্ষণে মস্তিষ্কে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়ে অ্যাম্বুলেন্সেই মারা যায় স্কুলছাত্র তিতাস ঘোষ (১১)। বৃহস্পতিবার (২৫ জুলাই) রাতে এ ঘটনা ঘটে। রোববার (২৮ জুলাই) রাত ১০টা পর্যন্ত এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি।
নড়াইলের কালিয়া উপজেলার কালিয়া পাইলট হাইস্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র তিতাস পৌর এলাকার মৃত তাপস ঘোষের ছেলে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) সূত্রে জানা যায়,বৃহস্পতিবার (২৫ জুলাই) রাত ৮টায় দিকে কাঁঠালবাড়ি ১ নম্বর ফেরিঘাটে পৌঁছায় তিতাসকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স। তখন ওই ঘাটেই ছিল কুমিল্লা নামে একটি ফেরি। অ্যাম্বুলেন্সে থাকা তিতাসের স্বজনরা ঘাটের কর্মকর্তাদের ফেরি ছাড়তে অনুরোধ করেন। ঠিক ওই সময়ই মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক ঘাট কর্তৃপক্ষকে একটি জরুরি বার্তা পাঠায়। বার্তায় বলা হয়, সরকারের একজন উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা ফেরিতে পদ্মা পার হবেন। তাই ১ নম্বর ফেরিঘাটে থাকা ফেরিটি যেন আগে না ছেড়ে যায়। আর এ কারণেই ঘাট কর্তৃপক্ষ ওই কর্মকর্তার গাড়ি না আসা পর্যন্ত ফেরি ছাড়তে রাজি হয়নি।
তিতাসের স্বজনদের অভিযোগ, ভিআইপি আসার অপেক্ষায় তিন ঘণ্টা ঘাটেই বসে ছিল ফেরিটি। আশপাশের লোকজনের অনুরোধের পরও ফেরি ছাড়েনি। এমনকি সরকারি জরুরি সেবা পাওয়ার নম্বর ৯৯৯ এ ফোন করেও কোনো কাজ হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, সরকারের এটুআই প্রকল্পের যুগ্ম সচিব আবদুল সবুর মণ্ডল পিরোজপুর থেকে ঢাকা যাচ্ছিলেন। তিনি কাঁঠালবাড়ি ঘাটে যাওয়ার আগে আমার কাছে ফেরিতে যাওয়ার বিষয়টি জানান। পরে আমি ঘাটের ব্যবস্থাপক সালামকে ভিআইপি ফেরিতে ওঠার বিষয়ে বার্তা পাঠাই। কিন্তু ওই ঘাটে অ্যাম্বুলেন্সে একজন গুরুতর আহত অবস্থায় রোগী আছে, তা আমি জানতাম না। ঘাটের ম্যানেজার এ বিষয় আমাকে কিছু জানাননি। পরে রোববার (২৮ জুলাই) বিষয়টি আমি জানতে পারি।
সরকারি কর্মকর্তা বা ভিআইপিদের জন্য ফেরি আগে থেকেই ঘাটে অপেক্ষায় থাকার কোনো নিয়ম আছে কি না? জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক আরও বলেন, তিনি (আবদুল সবুর মণ্ডল) চাঁদপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক। এ ছাড়া তিনি যুগ্ম সচিব। তাই তাঁকে ভিআইপি বলা যায়। এই ধরনের কর্মকর্তারা এই নৌপথে এলে তাঁদের বিশেষভাবে গুরুত্ব আগে থেকেই দেওয়ার রেওয়াজ চালু আছে।
এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিসি কাঁঠালবাড়ি ফেরি ঘাটের ব্যবস্থাপক মো. সালাম হোসেন মিয়া বলেন, ডিসি স্যার ফোন দিয়ে রাতে জানান, ভিআইপি যাবেন। তবে আমি তখন ঘাটে ছিলাম না। আমাদের স্টাফকে বলে দিই ভিআইপি আসার কথা। পরে সেখানে কী হয়, তা আমার জানা নেই।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে পদ্মা নদীতে স্রোত বেশি থাকায় ফেরি পারাপারে দ্বিগুণ সময় লাগে। এ ছাড়া রাতে তেমন একটা ফেরি চলে না। তাই ঘাটে যানজট কমবেশি থাকেই। তবে আমরা অ্যাম্বুলেন্সসহ সাধারণ যাত্রীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পারাপারের ব্যবস্থা করে দিই।
বৃহস্পতিবার (২৫ জুলাই) বিকেলে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় তিতাস গুরুতর আহত হয়। প্রথমে তাকে খুলনার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য বৃহস্পতিবার (২৫ জুলাই) রাতেই তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে পাঠানোর কথা বলেন চিকিৎসক। তাই চিকিৎসাসেবা অব্যাহত রেখে দ্রুত ঢাকায় পৌঁছাতে অর্ধলাখ টাকায় ভাড়া করা হয় আইসিইউ সুবিধা সম্পন্ন অ্যাম্বুলেন্স। অ্যাম্বুলেন্সটি ঘাটে এসে থামে রাত ৮টার দিকে। ঘাটে ফেরি পারাপারের জন্য তাঁরা ঘাট কর্তৃপক্ষ ও দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের কাছে সাহায্য চান। কিন্তু কোনো সাহায্য পাওয়া যায়নি। তিন ঘণ্টা অপেক্ষায় থাকার পরে রাত পৌনে ১১ টার দিকে একটি সাদা রঙের নোয়া মাইক্রোবাস ওঠার পরে ছাড়া হয় ফেরি। ছাড়ার আধা ঘণ্টার মধ্যেই মাঝ নদীতে মারা যায় তিতাস।
রোববার (২৭ জুলাই) তিতাসের বড় বোন তন্নীসা ঘোষ বলেন, আমার ভাইয়ের জীবন কেড়ে নিল ভিআইপি। এ দেশে জীবনের দাম বেশি না, ভিআইপিদের দাম বেশি?
তিতাসের কথা জানতে চাইলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিতাসের মা সোনামণি ঘোষ। তিনি বলেন, বাবা তোমাগো কাছে বললে কী আমার পোলারে পামু? ওরা আমার পোলারে মেরে ফেলছে। আমি ফেরিওয়ালাগো পায় ধরছি, তবুও ওরা ফেরি ছাড়ে নাই। ফেরি ঠিক মতোন গেলে হয়তো পোলাডা বাঁইচা যাইতো।
অ্যাম্বুলেন্স টপ নিউজ ফেরিঘাট মাদারীপুর মৃত্যু যুগ্ম সচিব স্কুলছাত্র