দেড় দশকে তাঁত কমেছে ৪২ শতাংশ, জনবল ৬৪ শতাংশ
২৭ জুন ২০১৯ ১৯:১৮ | আপডেট: ২৭ জুন ২০১৯ ২১:২৭
ঢাকা: ২০০৩ সাল থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে দেশে হস্তচালিত তাঁতের সংখ্যা কমেছে ২ লাখ ১৫ হাজারেরও বেশি। শতাংশের হিসাবে এই দেড় দশক সময়ে তাঁত কমেছে প্রায় ৪২ শতাংশ। একই সময়ে তাঁত শিল্পে নিয়োজিত মানুষের সংখ্যা কমেছে ৫ লাখ ৭১ হাজার আটশ জন। শতাংশের হিসাবে তা প্রায় ৬৪ শতাংশ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তাঁত শুমারি-২০১৮-এর চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) রাজধনীর আগারগাঁওয়ের পরিসংখ্যান ভবনের আয়োজিত অনুষ্ঠানে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
আরও পড়ুন- ‘বন্ধ থাকা হস্তচালিত তাঁত চালু করতে ৭৫ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে’
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা কমিশনের আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য আবুল কালাম আজাদ, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব গুলনাহার নাজমুন্নহার। পরিসংখ্যান ব্যুরোর মহাপরিচালক ড. কৃষ্ণা গায়েনের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন জরিপ শাখার পরিচালক জাহিদুল হক সরদার। মূল প্রবদ্ধ উপস্থাপন করেন প্রকল্প পরিচালক মহিউদ্দিন আহমেদ।
কমছে তাঁতের সংখ্যা
২০১৮ সালে পরিচালাতি তাঁত শুমারির হিসাব অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে তাঁতের সংখ্যা ২ লাখ ৯০ হাজার ২৮২টি। এর মধ্যে সক্রিয় তাঁত রয়েছে ১ লাখ ৯১ হাজার ৭২৩টি। অন্যদিকে ২০০৩ সালের শুমারিতে তাঁতের সংখ্যা ছিল ৫ লাখ ৫ হাজার ৫৫৬টি। এর মধ্যে সক্রিয় ছিল ৩ লাখ ১১ হাজার ৮৫১টি তাঁত। এরও আগে ১৯৯০ সালের শুমারিতে তাঁতের সংখ্যা ছিল ৫ লাখ ১৪ হাজার ৪৫৬টি এবং সক্রিয় তাঁত ছিল ৩ লাখ ৫২ হাজার ২১৩টি।
কমছে তাঁত শিল্পে নিয়োজিত জনবলও
তাঁত শুমারির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তাঁত শিল্পের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন ৩ লাখ ১৬ হাজার ৩১৫ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৪০ হাজার ৪৫ জন, নারী ১ লাখ ৭৬ হাজার ২৭০ জন।
এর আগে ২০০৩ সালের শুমারিতে এই শিল্প খাতে নিয়োজিত জনবল ছিল ৮ লাখ ৮৮ হাজার ১১৫ জন। এর মধ্যে পুরুষ ছিলেন ৪ লাখ ৭২ হাজার ৩৬৭ জন, নারী ৪ লাখ ১৫ হাজার ৭৪৮ জন।
এরও আগে, ১৯৯০ সালের শুমারির তথ্য অনুযায়ী, তাঁত শিল্পে যুক্ত ছিলেন ১০ লাখ ২৭ হাজার ৪০৭ জন। এর মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ৫ লাখ ৭১ হাজার ৭৬৫ জন, নারী ৪ লাখ ৫৫ হাজার ৬৪২ জন।
যেসব কারণে কমছে তাঁত
প্রকল্প পরিচালক মহিউদ্দিন আহমেদ জানান, তাঁত বন্ধ কিংবা নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে ৮৩ দশমিক ৫ শতাংশ তাঁতী বলেছেন মূলধনের অভাবের কথা। এছাড়া সূতার মূল্য বেড়ে যাওয়াকে ৫৫ দশমিক ১ শতাংশ, সুতার অভাবকে ৩৭ শতাংশ, বিপনণের সমস্যাকে ২৭ দশমিক ৭ শতাংশ, দক্ষ শ্রমিকের অভাবকে ২৯ দশমিক ২ শতাংশ, নকশার অভাবকে ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ, উন্নত প্রযুক্তির অভাবকে ২৩ দশমিক ২ শতাংশ এবং রঙ ও রাসায়নিকের দাম বেড়ে যাওয়াকে ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ তাঁতী তাঁত বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলাবদ্ধতা বা বন্যা, কৃষি খাতে অন্তর্ভুক্তি, অলাভজনক হওয়া, ব্যবসা পরিবর্তনসহ আরও বেশকিছু কারণ তাঁতীরা উল্লেখ করেছেন বলে জানিয়েছেন মহিউদ্দিন আহমেদ।
কোথায় কত তাঁত
তাঁত শুমারির প্রতিবেদনে বলা হয়, সবচেয়ে বেশি তাঁত রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগে— ১ লাখ ২০ হাজার ১৯৮টি। এছাড়া রাজশাহী বিভাগে ৯১ হাজার ৬৯৯টি, ঢাকা বিভাগে ৫০ হাজার ২৬৩টি, খুলনা বিভাগে ১৮ হাজার ৬২১টি, রংপুর বিভাগে ৪ হাজার ৫৮৩টি, সিলেট বিভাগে ৪ হাজার ১২২টি ও ময়মনসিংহ বিভাগে ২৪৪টি তাঁত রয়েছে।
তাঁতীদের আর্থসামাজিক চিত্র
তাঁত শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের আর্থসামাজিক চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে শুমারিতে। এ ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, ঘরের দেয়ালের ধরনের মধ্যে ইট ও সিমেন্টের দেয়াল রয়েছে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ তাঁতীর। এছাড়া খড় বা বাঁশ বা পাতা দেয়াল রয়েছে ৩৫ দশমিক ৪ শতাংশ, টিন বা কাঠ ৩২ দশমিক ৫ শতাংশ, কাঁদামাটির দেয়াল ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ এবং অন্যান্য দেয়াল রয়েছে শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ তাঁতী পরিবারের। অন্যদিকে তাঁতীদের ঘরের ঢালাই করা ছাদ রয়েছে ২ শমিক ৯ শতাংশ তাঁতীর। এছাড়া টিনের চাল রয়েছে ৮৬ দশমিক ৭ শতাংশ, টালি ১ দশমিক ৩ শতাংশ এবং খড় বা বাঁশ বা ছনের চাল রয়েছে ৯ শতাংশ তাঁতী পরিবারের।
গৌরব ফিরিয়ে আনার আহ্বান
অনুষ্ঠানে পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বলেন, তাঁতের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এতে মন খারাপের কিছু নেই। কেননা প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে এমন অবস্থা হয়েছে। এই পরিবর্তনকে মেনে নিতে হবে। একসময় ঢেকিতে ধান ভাঙা হতো। এখন সেই ঢেকিছাঁটা চাল হারিয়ে গেছে। এটা বাস্তবতা। কিন্তু ঐতিহ্য রক্ষায় তাঁত শিল্পের সমসা সমাধানে উদ্যোগ নিতে হবে।
আবুল কালাম আজাদ বলেন, তাঁতের তৈরি পণ্য লাভজনক করা না গেলে এই শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। কেননা মূলধনসহ বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে এই খাতে। এসব সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নিতে হবে। দেশের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে হলে সঠিক পদক্ষেপ প্রয়োজন। এই শুমারিতে যেসব তথ্য উঠে এসে এসেছে, এর ফলে সরকারের নীতি নির্ধারণে সুবিধা হবে।
গুলনাহার নাজমুন্নাহার বলেন, মসলিন একসময় আমাদের গৌরব ছিল। আজ সেটি হারিয়ে গেছে। এখন আবার নতুন করে ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাঁতের এই শুমারিটিও আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা তাঁত শিল্প রক্ষায় এসব তথ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
সারাবাংলা/জেজে/টিআর