মিতুর জন্য তৈরি আচার এখনও মায়ের ফ্রিজে
১২ মার্চ ২০১৯ ১০:২৭
।। সুমন মুহাম্মদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট।।
রাজশাহী: ‘মা আমি ১৩ মার্চ বাংলাদেশ আসবো। তুমি বাবাকে নিয়ে বিমানবন্দরে এসো। আর সাথে করে বরইয়ের আচার ও নাড়ু বানিয়ে নিয়ে আসবে।’
‘বাবা তুমি কি থুত্থুড়ে বুড়ো মানুষ হয়ে গিয়েছো যে তোমার লাঠি লাগবে?’
এগুলোই ছিল বাবা-মায়ের সঙ্গে বিলকিস আরা মিতুর শেষ কথা। মায়ের হাতের আচার কিংবা নাড়ু চেখে দেখার আর সুযোগ হয়নি তার। গত বছরের ১২ মার্চ নেপালের ত্রিভুবন বিমানবন্দরে ইউএস বাংলা এয়ারলাইনসের উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় যে ৫১ জন মারা যান, মিতু ছিলেন তাদেরই একজন।
রাজশাহীর মেয়ে মিতু। এক ভাই এক বোন আর বাবা-মা নিয়ে ছিল সংসার। নগরীর নওদাপাড়ার সেই সংসারে এখন শুধুই স্মৃতির বসবাস। মেয়ের স্মৃতি বুকে নিয়েই বেঁচে আছেন বাবা গোলাম কিবরিয়া আর মা মনোয়ারা বেগম।
সোমবার (১১ মার্চ) নওদাপাড়ার তিনতলা বাড়িতে বসেই কথা হয় মিতুর বাবা-মায়েল সঙ্গে। জানা গেল, মিতুর একমাত্র ভাই মাসুদ রানা মনি ঢাকায় চাকরি করেন। তাই রাজশাহীতে মেয়ের স্মৃতি নিয়ে বাস করছেন বিজিবির সাবেক কর্মকর্তা বাবা আর স্কুল শিক্ষক মা।
মনোয়ারা বেগম জানালেন, যেটুকু সময় স্কুলে থাকেন, সেটুকু সময় কেটে যায়। বাড়ি ফিরলেই চারদিকে মিতুর স্মৃতি। অ্যালবামের পাতা উল্টে আর চোখের পানিতে কেটে যায় দিন।
বাবা গোলাম কিবরিয়া জানান, বিজিবিরি চাকরি করার সুবাদে বছরের অধিকাংশ সময় কাটতো দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। ছুটিতে বাড়ি আসলেও প্রয়োজনীয় কথাবার্তা ছাড়া তেমন কথা হতো না মেয়ের সঙ্গে। তবে বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে বিদেশ যাওয়ার পর প্রায়ই টেলিফোনে কথা হতো। গত বছর ঢাকায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউআইটিএস এর সামবর্তন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে নিউইয়র্ক থেকে দেশে আসছিলেন মিতু। তবে তার আসার কথা ছিল ১৩ মার্চ সকাল সাড়ে ৭টায়। মিতুকে বিমানবন্দর থেকে নিতে ১২ মার্চ রাতে রাজশাহী থেকে ঢাকা যাওয়ার ট্রেনের টিকিটও কাটা হয়েছিল।
ফিরে দেখা: যে উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা কেড়ে নিয়েছে ৫১ প্রাণ
বিজিবির অবসরপ্রাপ্ত এই নায়েক সুবেদার বলেন, সেদিন (১২ মার্চ) সন্ধ্যা থেকেই প্রস্ততি নেওয়া শুরু করি ঢাকা যাবার জন্য। রাতে খাওয়া শেষ করে যখন যাবার প্রস্তুতি শেষ করি তখন ঠিক রাত ১০টার দিকে ফোনে খবর এল মিতু আর এই পৃথিবীতে নেই। নেপালে প্লেন দুর্ঘটনায় সে মারা গেছে। প্রথমে ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না। কারণ তাঁর তো আসার কথা ১৩ মার্চ, সে একদিন আগেই চলে এসেছে ঢাকায়, জানায় নি কাউকে। তার তো কুয়েতে যাত্রা বিরতির কথা ছিল! পরে জানতে পারেন, মিতু কুয়েতে না অবস্থান করে সরাসরি চলে আসে ঢাকায়। সেখানে তাঁর এক বান্ধবির সঙ্গে নেপালে যাওয়ার জন্য রওনা দেন। আর সেই নেপালযাত্রাই কাল হয়ে আসে তাদের জীবনে।
মেয়েকে শেষ দেখাটাও দেখতে পারলেন না, দেখলেন কফিনে মোড়ানো মরদেহ, এটা বলতে বলতেই চোখ মোছেন মিতুর বাবা।
জানা গেল, মিতুর মৃত্যু প্লেনের যন্ত্রাংশের চাপে হয়েছে। শরীরের কোনো অংশ তাঁর পুড়ে যায়নি। বুকে যন্ত্রাংশের চাপ লাগায় তার মৃত্যু হয়। এসময় তার পরনে যে পোশাক ছিল তাও ফেরত পেয়েছেন বলে জানান গোলাম কিবরিয়া। পরে মিতুর স্বামীর ইচ্ছায় ঢাকার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয় তাকে।
মিতুর বাবা গোলাম কিবরিয়া এখন হৃদরোগ ও কিডনির সমস্যায় আক্রান্ত। পরিবারের ছোট সন্তান ও একমাত্র মেয়েকে হারানোর বেদনা আজও ভুলতে পারেন নি তিনি।
আর্থিক ক্ষতিপূরণের টাকা পাননি বলে জানান মিতুর বাবা। বলেন, ‘উত্তরাধিকার সদন পাওয়ার অপেক্ষায় আছি। বিষয়টি ইউএস বাংলা দেখছে। অনেকেই টাকা পেয়েছেন। সনদ পেলেই কোম্পানির পক্ষ থেকে এই টাকা তারা পাবেন।’
মিতুর মা মনোয়ারা বেগম বলেন, নিউইয়র্ক থেকে প্লেনে ওঠার আগেও কথা হয়েছিল মেয়ের সঙ্গে। বরইয়ের আচার আর নাড়ু বানিয়ে প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন তিনি। সেই আচার আজও ফ্রিজে রাখা আছে। মেয়ের এই শেষ ইচ্ছেটুকু পূরণ করার সুযোগ না পাওয়ার বেদনা আজও তাঁকে শান্তি দেয় না।
মিতুর স্বামী আজিজুল হক ফায়ারম্যানস অ্যাসোসিয়েশন অব দ্য স্টেট অব নিউইয়র্কের একজন স্টাফ নার্স। ২০১৫ সালে বিয়ে করেন তারা। রাজধানীর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউআইটিএস থেকে এমবিএ করে স্বামীর সঙ্গে নিউইয়র্কে যান মিতু। ১৭ মার্চ ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যোগ দিতেই দেশে আসছিলেন তিনি।
সারাবাংলা/এসএমএন