সম্প্রচার সম্মেলন: টেলিভিশনকে পে চ্যানেলে নিয়ে যাওয়ার আহ্বান
৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১৮:২৪ | আপডেট: ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১৯:৪৭
।। ঢাবি করেসপন্ডেন্ট।।
ঢাকা: বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোকে সরকারের পক্ষ থেকে অর্থ বরাদ্দ দিতে আহ্বান জানানো হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে শুক্রবার (৮ ফেব্রুয়ারি) ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার (বিজেসি) বা সম্প্রচার সাংবাদিক কেন্দ্রের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এ দাবি জানানো হয়।
সম্প্রচার মাধ্যমের কর্মীদের পেশাগত সক্ষমতা বাড়ানোসহ কর্মপরিবেশ ও তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শুক্রবার যাত্রা শুরু করেছে ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার (বিজেসি) বা সম্প্রচার সাংবাদিক কেন্দ্র। সকাল সোয়া ১১টায় প্রধান অতিথি হিসেবে সম্মেলন ও কেন্দ্রের উদ্বোধন করেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী।
উদ্বোধনের পর ‘সম্প্রচার শিল্প: একটি সম্ভাবনা সংকট?’ শিরোনামে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নেন জিটিভি ও অনলাইন নিউজ পোর্টাল সারাবাংলা ডটনেট এর এডিটর ইন-চিফ সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, বেসরকারি টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন অ্যাটকোর সিনিয়র সহ-সভাপতি মোজাম্মেল বাবু, নাগরিক টিভির এমডি রুবানা হক, নিউজ টোয়েন্টিফোর এর সিইও নঈম নিজাম, তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদ, প্রধানমন্ত্রীর উপ প্রেস সচিব আশরাফুল আলাম খোকন সাবেক সাংস্কৃতিক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, এমআরডিআই’র নির্বাহী পরিচালক হাসিবুর রহমান মুকুর প্রমুখ।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, ‘গণমাধ্যম আমাদের চতুর্থ স্তম্ভ। কিন্তু আজকে আমরা দেখছি চতুর্থ স্তম্ভ একটি সংকটের মধ্যে আছে। সংকটের তীব্রতা আমি বলব টেলিভিশন ক্ষেত্রে এটি আরও বেশি।’
দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে টেলিভিশন ক্ষেত্র বিকাশের বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সবার আগে ভারতের প্রসঙ্গটি আসবে। বিজ্ঞাপন এবং মানবসম্পদের দিক থেকে ভারত একটি বিশাল মার্কেট। ভারতে টেলিভিশন রেগুলিটি অব ভারত ট্রাই নামে যে সংগঠন আছে তারা বলছে, বিস্তৃত-বিকশিত টেলিভিশন খাতকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক দিকে নিয়ে যেতে হবে এবং সেই প্রাতিষ্ঠানিকতা দেওয়ার ক্ষেত্রে তারা মনে করে সরকারের দিক থেকে সব থেকে বড় সহায়তা আসবে। পাকিস্তানে ‘পাকিস্তান মিডিয়া রেগুলেশন অথরিটি’ আছে। তার কাজ হলো সামরিক শাসকদের মাধ্যমে টেলিভিশনগুলো নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু সেখানে সম্প্রতি কয়েকটি টেলিভিশন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সরকার টেলিভিশনগুলোকে সহযোগিতা করে নতুন করে উজ্জীবিত করেছে।’
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে ইশতিয়াক রেজা বলেন, ‘গত দুই যুগে টেলিভিশন একটি বিকাশের জায়গায় এসেছে। এই খাতে বড় পুঁজির প্রবেশ ঘটেছে। কিন্তু আমরা এখনও সংগঠন পর্যায়ে রয়েছি। আমরা এখনও প্রাতিষ্ঠানিকতা পাইনি।’
মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন, ‘সরকার নিউজ পেপারগুলোর কী ধরনের সহযোগিতা দেয়। সরকারের যে কোনো ঘোষণা পত্রিকায় যখন আসে বিজ্ঞাপন আকারে আসে। ফলে পত্রিকাগুলো সহযোগিতা পাচ্ছে। যে কোনো বিশেষ দিনে পত্রিকাগুলো সাপ্লিমেন্ট পাচ্ছে।’
‘আমরা টেলিভিশন সরকারের দিক থেকে কী পাই? প্রতিদিন সরকারের একটি খবর আমরা প্রচার করি। সেই ১৫-২০ মিনিটের জন্য আমরা কোনো ধরনের আর্থিক প্রণোদনা পাই না। এমনকি ওই ১৫-২০ মিনিটের ভ্যাট পর্যন্ত মৌকুফ করা হয় না। আমরা সরকারের যে কোনো ঘোষণা টিভিসি আকারে প্রচার করি। সেই টিভিসিগুলো ডিএফপিতে কোটি কোটি টাকা খরচ করে তৈরি করা হয় কিন্তু আমরা বিনা পয়সায় প্রচার করি। সুতরাং আমরা মনে করছি, আমাদের টেলিভিশনগুলো সরকারের বাণী নানাভাবে জনগণের কাছে নিয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন মন্ত্রীরা যা বলেন, একমাত্র টেলিভিশনগুলো সবার আগে মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। আজকে আমাদের দাবি হলো— আমাদের টেলিভিশন খাতকে বাঁচাতে হবে। যে আইনগুলো পরিবর্তন করার কথা, পে চ্যানেল করার কথা সেগুলো করবেন।’
অ্যাটকোর সিনিয়র সহ-সভাপতি মোজাম্মেল বাবু বলেন, ‘টেলিভিশন সম্পর্কে সরকার, সাংবাদিক এবং এই দু পর্যায়ের মাঝামাঝি যারা আছে তাদের মিথ না কাটালে টেলিভিশন শিল্পে কোনো অগ্রগতি হবে না। প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় আসার পর সবাই চাইলাম গণমাধ্যমের ক্ষমতা বিস্তৃতি করার জন্য টেলিভিশন লাইসেন্স আরও ওপেন করা হোক। তিনি কাউকে টেলিভিশন লাইসেন্স দিলেন কাউকে ব্যাংকের লাইসেন্স দিয়ে মনে করলেন উভয়ের উপকার করলেন। আমাদের ফেললেন ১০০ কোটি টাকা ঋণে আর তাদেরকে উন্মুক্ত করে দিলেন ১০০ কোটি টাকা ইনকামে। মাননীয় প্রধানন্ত্রীকে এই মিথটা ভাঙতে হবে যে, টেলিভিশন লাইসেন্স কোনো উপকার নয়। আমাদের উৎসাহ ছিল দেশের জন্য কাজ করব, দেশের কথা বলব। আমরা ছোটবেলায় বাবা-মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে লিটল ম্যাগাজিন পড়তাম। আমরা তারই একটা রূপ এখন যারা লিটল ম্যাগাজিন করছেন।’
তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি টেলিভিশন কোনো লিমিটেড কোম্পানি হতে পারে না। এটা ট্রাস্ট আইনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত। এখন থেকে প্রফিট নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এই ট্রাস্টে টেলিভিশন কর্মীদের স্টেকহোলডার করতে হবে। টেলিভিশন সাংবাদিকতা লাভজনক করতে পারে কেবল সাংবাদিক কর্মী ও উদ্যোক্তাদের সমন্বিত প্রয়াস। ফান্ডিং যেখান থেকেই আসুক। লভ্যাংশের অন্তত ২৫ শতাংশ সাংবাদিক এবং কর্মীদের মধ্যে বণ্টন হওয়া প্রয়োজন। তা না হলে কখনওই টেলিভিশনকে সম্প্রসারণ করা যাবে না। সবাই মিলে কাজ না করলে এটি কখনই লাভজনক প্রতিষ্ঠান হবে না। আজকে ৩০টি গণমাধ্যমের একটিও গণমাধ্যম না। এগুলো করপোরেট ফান্ডেড করপোরেটের বিজ্ঞাপনে চলা করপোরেটেড মিডিয়াম। এতএব এই টেলিভিশনগুলোকে জনসাধারণের (ক্রাওডেড) ফান্ডে নিয়ে যেতে হবে।’
আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ‘যারা খবর পড়েন তাদের অনেকেরই প্রশিক্ষণ দরকার। উচ্চারণের ক্ষেত্রে এত ভুল থাকে খবরে তা গ্রহণযোগ্য নয়।’
নাগরিক টেলিভিশনের এমডি রুবানা হক বলেন, ‘আমার মনে হয় একটা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি আমরা। বৈশ্বিক অর্থনীতি যেখানে দাঁড়িয়েছে সেখানে প্রতিযোগিতার কোনো অর্থ হয় না। এখানে এলে কোলাবেরশন দরকার। শিগগিরই দেখবেন কম্পিটিশিন একটা আউটডেটেড কনসেপ্ট হয়ে যাবে। ক্ষমতা এবং বিত্ত দুটির সংজ্ঞা বদলে দিতে হবে। ক্ষমতার জোরে চ্যানেল বানিয়ে অন্যকে ক্ষতির মধ্যে ফেলে দেওয়া দুঃখজনক। আটা-বস্তা, ইট-পাটকেল শীর্ষ সংবাদ কানে লাগে। কমার্শিয়াল হওয়ার একটা মাত্রা আছে। আমরা সমস্ত মাত্রা ছাড়িয়ে গেছি। ভালো রিয়েলিটি শো’র জন্য ২-৫ কোটি টাকার নিচে পারবেন না। টেলিভিশন থেকে কেউ কিছু শিখছি না শেখাতে পারছি না। কাজেই ঠিকঠাক টেলিভিশন চাইলে প্রত্যেকটি টেলিভিশনগুলোর মালিকদের এক হতে হবে।’
নিউজ ২৪ টিভির সিইও নঈম নিজাম বলেন, ‘টেলিভিশনের চ্যানেলের জন্য আলাদা ওয়েজবোর্ড আজও করা যায়নি। এটা হতাশাজনক।’
নাগরিক টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুবানা হক বলেন, আগামি ৫ বছরের জন্য নূন্যতম লাভ করে চ্যানেল টিকিয়ে রাখতে হবে। সবাইকে এক হতে হবে। কারণ অনলাইনে বিকল্প প্ল্যাটফর্মের জায়গা শক্ত হচ্ছে।’
এসময় সম্প্রচার সাংবাদিক কেন্দ্রের চেয়ারম্যান রেজোয়ানুল হক ও সদস্য সচিব শাকিল আহমেদ বিভিন্ন দাবী তুলে ধরেন। এর মধ্যে রয়েছে, পে চ্যানেল করা, বিজ্ঞাপনের টাকা পরিশোধের সময়সীমা বেঁধে দেয়া, টিভিকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা।
প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকন বলেন, ‘মিডিয়া সিন্ডিকেট থাকতে পারবে না।’
বাইরের দেশের বিজ্ঞাপন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ইউরোপে বাইরের কোনো দেশের বিজ্ঞাপন চলে না। আপনি কনটেন্ট চালান প্রোগ্রাম চালান কিন্তু বিজ্ঞাপন আপনি চালাতে পারবেন না। অ্যাটকো থেকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আর ফ্রি কখনও কিছু ভালো না। যদি এ রকম করা যায় চ্যানেল যারা দেখবে তাদের সবাইকে পে করতে হবে তহালে ভালো হবে।’
তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদ বলেন, ‘সংকটগুলো নিরসন করার জন্য আরও কী কী করা প্রয়োজন অ্যাটকোর সঙ্গে বসব। আলোচনা করতে হবে। পুরো গণমাধমকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য কাজ করছি এবং সেটা প্রথম কাজ বলে মনে করি। বাস্তবতার নিরিখে কী কী করা প্রয়োজন সেগুলো দেখব। আমাদের আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই।’
সারাবাংলা/কেকে/একে