‘বাস মালিকদের কোনো সন্তান নাই?’
২ জানুয়ারি ২০১৯ ১৭:১৭ | আপডেট: ২ জানুয়ারি ২০১৯ ২১:১২
।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: ‘আমার কপালে এই ছিল! আমার ময়নারে দিয়া দাও। নিয়া যাইগা দেশে। এই ঢাকায় থাকমু না। কেবল আমার ময়নারে ফিরায়ে দাও তোমরা। যে বাস আমার ময়নারে নিয়া গেলো, সেই বাস মালিকের কি কোনো ময়না নাই?’
মঙ্গলবার (১ জানুয়ারি) মালীবাগে আবুল হোটেলের সামনে বাসচাপায় নিহত মিমের মা জরিনা বেগম বুধবার (২ জানুয়ারি) ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে বসে এভাবেই আহাজারি করছিলেন।
https://youtu.be/JKQicsN4enQ
জরিনা বেগম একমাত্র মেয়ে মিমকে ‘ময়না’ বলেই ডাকতেন। তিনি মনে করেন, সব কন্যা সন্তানকেই তার মা-বাবা ময়না নামেই ডাকেন। মেয়েকে হারিয়ে তাই জরিনা বেগমের প্রশ্ন, ‘ময়না হারানোর যন্ত্রণা কি বাস মালিকেরা বোঝেন না?’ ময়না হারিয়ে মা কেমন করে বাঁচেন, সে প্রশ্নও তোলেন তিনি।
সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো মিম
ঢামেক হাসপাতালের মর্গের খোলা জায়গায় যখন জরিনা বেগম বিলাপ করছিলেন, তখন মর্গের ভেতরে ময়নাতদন্ত চলছিল মিম ও একই ঘটনায় নিহত পলির। ময়নাতদন্ত কী, কখন শেষ হবে, সেটা জানেন না এই জরিনা বেগম। তিনি কেবল ময়নাকে নিয়ে চলে যেতে চান এই শহর ছেড়ে। বলছিলেন, আর কোনোদিনই তিনি এই ঢাকায় আসবেন না। ঢাকা শহর তার মেয়েকে কেড়ে নিয়েছে, যে মেয়ের মাত্র দুনিয়াকে চিনতে শুরু করেছিল।
উল্লেখ্য, মঙ্গলবার (১ ডিসেম্বর) দুপুর দেড়টার দিকে রাজধানীর মালিবাগে আবুল হোটেলের সামনে যাত্রীবাহী বাসচাপায় পোশাক শ্রমিক মিম আক্তার ও নাহিদ পারভিন পলি মারা যায়। এ ঘটনায় শ্রমিকরা প্রথমে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ, ভাঙচুরসহ কয়েকটি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন। এ সময় পাঁচ ঘণ্টা সড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকে। এরপর সাড়ে ৬টার দিকে স্বাভাবিক হয় মালিবাগ-রামপুরা সড়কে যান চলাচল।
জরিনা বেগম কিছুক্ষণ কথা বলেন। কিছুক্ষণ পাশে বসা আত্মীয়ের কাঁধে মাথা রাখেন। তাকে কথা না বলার জন্য আত্মীয়রা অনুরোধ করলেও চুপ থাকেন না তিনি। কিছুক্ষণ পরপরই বিলাপ করে কেঁদে ওঠেন।
বগুড়ার বাসিন্দা জরিনা বেগম মেয়ে মিমের দুর্ঘটনার কথা শুনেই মঙ্গলবারই ঢাকায় আসেন। মেয়ের লাশ হাসপাতালে রেখে তাকে কোনোভাবেই বাসায় নেওয়া যাচ্ছিল না। কোনোভাবে রাতটা সেখানে কাটালেও ভোর হতেই তিনি চলে আসেন মর্গে।
জরিনা বেগম বলেন, ‘আমার ময়না ক্লাস ফাইভের পরীক্ষা দিয়া বেড়াইতে আসছিল ঢাকায়। কিন্তু ইলেকশন ছিল বইলা তার আর বাইর হওয়া হয় নাই। কিন্তু সেই বচ্ছরের পত্থম দিনে ময়না বেড়াইতে গেলো, আর আইলো না, আর আইবো না।’
আরও পড়ুন: ‘সুখের দেখা পাওয়ার আগেই প্রাণ গেলো!’
মেয়ের বয়স মাত্র ১৩ বছর জানিয়ে জরিনা বেগম বলেন, ‘আমি থাকলে ময়নারে যাইতে দিতাম না। আমার ময়নারে কই পামু, আমি কেন এই জায়গায়, আমি তো কোনোদিন এই জায়গায় আসি নাই।’ মর্গের দিকে হাত তুলে তিনি বলেন, ‘ময়নারে আনে না কেন? তারে কই রাইখা দিছে? দেশে যাইয়া আমি কী জবাব দিমু? কার কাছে কী কমু? আমি কেন মইরা গেলাম না? আমার মাইডার তো কেবল জীবন শুরু হইছে। সে কেন আমারে রাইখ্যা চইলা গেলো? মাগো ও মা- ও মিম, তুই কই মা? আমার মা’রে কই রাখছে, আমারে একটু দেখবার দে।’
জরিনা বেগম যখন কাঁদছিলেন, তখন স্বজনরা তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। এ সময় স্বজনরা বাসচালকের বিচারের দাবি তুলে বলেন, ‘আমরা কোনো টাকা-পয়সা চাই না, কেবল বিচার চাই।’
এই প্রতিবেদেকের পরিচয় জানতে পেরে স্বজরা বলেন, ‘কেবল একটাই অনুরোধ আপনাদের কাছে। যে ড্রাইভার অ্যাকসিডেন্ট করছে, আমরা তার কঠিন বিচার চাই।’
মিমের ভাই সাইফুল বলেন, ‘কাল দেখেছি, ড্রাইভারের লাইসেন্স নাই, লাইসেন্সের একটা টোকেন দিয়া কেমনে গাড়ি চালায়?’
ঢামেক হাসপাতালে জরিনা বেগমের বিলাপ
গ্রাম থেকে আসা আরেক আত্মীয় বলেন, ‘আমি মনে করি, এই মৃত্যুতে বাস মালিকেরও দায় রয়েছে। তারও কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত। গাড়ির ভার সে বইতে পারবে কি না, তার অভিজ্ঞতা আছে কি না, সেইটা দেখার দায়িত্ব মালিকদের। মালিকরা কি কেবল টাকার গন্ধটাই পান? সন্তান হারা বাবা-মায়ের কান্না কি তাদের চোখে পড়ে না? তারা কি কারও বাবা নন?’
ঘটনার দিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে স্বজনরা অভিযোগ করেন, দুপুরের খাবার খেয়ে পলি ও মিম যখন রাস্তা পার হচ্ছিল, তখন ‘সুপ্রভাত ঢাকা মেট্রো ব ১১৯৬১৩’ বাসটি তাদের দুজনকেই চাপা দেয়।
এ ঘটনায় নিহত মিমের মা জরিনা বেগম বাদী হয়ে হাতিরঝিল থানায় মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় সুপ্রভাত পরিবহনের বাসের চালক মো. জুনায়েদকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
সারাবাংলা/জেএ/এমএনএইচ