Friday 03 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শিশুকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, প্রয়োজন নীতিমালা


১১ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৮:১৯

।। মাকসুদা আজীজ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর ।।

ঢাকা: শিশুদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন বন্ধে ২০১০ সালের ১৮ জুলাই বাংলাদেশ রিট পিটিশন দায়ের করে লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্র। ওই বছরেরই ৯ আগস্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক শাস্তি বন্ধ করতে পরিপত্র জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। পরে ২০১১ সালের ১৩ জানুয়ারি হাইকোর্টও এক রায়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি দেওয়ার নামে নির্যাতনকে সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করে। এ বিষয়ে নীতিমালা চূড়ান্ত করতেও নির্দেশ দেওয়া হয় সরকারকে। ওই বছরই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ১১ ধরনের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি নিষিদ্ধ করে একটি নীতিমালা করা হয়। পরে ২০১৬ সালে এ বিষয়ে আরও একটি পরিপত্র জারি করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।

বিজ্ঞাপন

হাইকোর্টের ওই রায়ের পর কেটে গেছে প্রায় আট বছর। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকেও নেওয়া হয়েছে একাধিক উদ্যোগ। তা সত্ত্বেও নিরাপদ নয় শিশুরা। এখনও শিশু নির্যাতনকে দেখা হয় শিশু পালনের একটি স্বাভাবিক নিয়ম হিসেবে। শারীরিক শাস্তি তো বটেই, মানসিক নির্যাতনও এখানে খুব স্বাভাবিকভাবে ধরা হয়। যে কারণে এখনও এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলপ্রকাশের পরপরই শোনা যায় আত্মহত্যার ঘটনার কথা। অন্যদিকে, বাংলাদেশ শিশু অধিকারের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১০টি শিশু আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে।

গত জুলাই মাসে শিক্ষকের মানসিক নির্যাতনের স্বীকার হয়ে আত্মহত্যা করে সুমাইয়া আক্তার মালিহা নামে এক শিক্ষার্থী। এরপর গত সপ্তাহেই ভিকারুননিসা নূন স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী অরিত্রী অধিকারীর আত্মহননের ঘটনায় ফের আলোচনায় আসে শিশুদের শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতনের শিকার হওয়ার বিষয়টি।

বিজ্ঞাপন

শিশু নির্যাতন বাংলাদেশের ঐতিহ্য!

২০১৭ সালে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের শহর ও গ্রাম অঞ্চলের ১২৬টি স্কুলগামী শিশুর ওপর শারীরিক নির্যাতন নিয়ে একটি জরিপ চালায় ব্লাস্ট ও সেভ দ্য চিলড্রেন (এসসিআই)। এই জরিপে শিশুদের মা-বাবা ও স্কুল শিক্ষকদের কাছ থেকে শিশুদের শারীরিক নির্যাতনের তথ্য নেওয়া হয়। জরিপে দেখা যায়, শুধু স্কুল নয়, শিশু নির্যাতনের শেকড় আরও অনেক গভীরে প্রোথিত।

ওই জরিপে অংশ নেওয়া ৯০ শতাংশ মা-বাবা স্বীকার করেন, তাদের সন্তানরা স্কুলে শারীরিক বা মানসিকভাবে নির্যাতিত হয়। মা-বাবাদের অর্ধেকেরই বেশি বলছেন, শিশুদের ওপর শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন বন্ধের রায় বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ সম্পর্কিত পরিপত্রের কথা তারা জানেনই না। এর চেয়েও ভয়াবহ তথ্য হচ্ছে— প্রায় ৭৯ শতাংশ মা-বাবা স্বীকার করেছেন, কথা না শোনা বা লেখাপড়ায় মন না দেওয়ার কারণে তাদের হাতেও নির্যাতিত হতে হয়েছে শিশুকে।

এদিকে, জরিপে অংশ নেওয়া শিক্ষকদের স্বীকারোক্তিও ভয়াবহ। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৮৬ শতাংশ স্কুল শিক্ষার্থী মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থীকে বকাঝকা করা হয়েছে এবং ৩০ শতাংশকে ভয় দেখানো হয়েছে বলেও স্বীকার করে নিয়েছেন শিক্ষকরা। অবশ্য তারা এও দাবি করেছেন, ৪৫ শতাংশ ক্ষেত্রে তারা শিশুদের বুঝিয়েছেন তাদের ভুল কী ছিল। যদিও মা-বাবারা বলেছেন, এর হার মাত্র ২৬ শতাংশ।

সেভ দ্য চিলড্রেনের চাইল্ড রাইটস গভর্ন্যান্স অ্যান্ড চাইল্ড প্রোটেকশন সেক্টরের ব্যবস্থাপক একরামুল কবীর সারাবাংলাকে বলেন, আমরা বিভিন্ন সময় কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, আমাদের সমাজে শিশুদের নির্যাতনের বিষয়টিকে কেউ আমলে নেন না। মানসিক নির্যাতন তো দূরের কথা, শারীরিক নির্যাতনকেই তারা পাত্তা দেন না। বরং এখনও মা-বাবাসহ শিক্ষকরাও বিশ্বাস করেন, শিশুকে ‘মানুষ’ করতে হলে কড়া শাসনের দরকার আছে। এর মাধ্যমে শিশু নির্যাতন একটি সামাজিক স্বীকৃতি পেয়ে যায়।

‘মানুষ’ করার উপায় কি নির্যাতন?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. মুজিবুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষকদের শিক্ষার বিষয়ে যতটা না আগ্রহী করা হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি নম্বরের পেছনে ছোটানো হয়। এই ছুটে শিক্ষকরা নিজেরা আতঙ্কিত থাকেন। কারণ স্কুলের ফলের ওপর তাদের সরকারি সুযোগ-সুবিধা নির্ভর করে। স্কুলে নির্দিষ্টসংখ্যক শিক্ষার্থীর ফল আশানুরূপ না হলে তার প্রভাবে পড়ে স্কুলের এমপিওপ্রাপ্তিতে। অন্যদিকে, মা-বাবারা আতঙ্কিত থাকেন, ফল ভালো না হলে ভালো প্রতিষ্ঠানে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ মিলবে না, ভালো চাকরি পাওয়া যাবে না। এসব আতঙ্কেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ব্যবহারের মাধ্যমে।

সেভ দ্য চিলড্রেন তাদের বিভিন্ন গবেষণায় দেখিয়েছে, এরকম শাসনের মধ্য দিয়েই বড় হওয়া মা-বাবা ও শিক্ষক শিশুদের লালন-পালনে সেই পদ্ধতি প্রয়োগেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।

জাতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ড. হেলাল উদ্দিন আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের দেশে শিশুদের সঙ্গে ব্যবহার কেমন হবে, সে বিষয়ে একদমই তলিয়ে ভাবার কোনো সংস্কৃতি নেই। সে ছোট বলেই যে তার আত্মসম্মানবোধ নেই, তা ভাবার কোনো সুযোগ নেই। আবার অনেক সময় শিশুদের শাসনের নাম করে তার সঙ্গে যে ব্যবহার করা হয়, তা বিজ্ঞানসম্মত নয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নিয়মভঙ্গের জন্য স্কুল থেকে বের করে দেওয়ার ভয় দেখানো বা মা-বাবাকে ডেকে পাঠানোর কথা। এগুলো শিশুদের আতঙ্কিত করে তোলে এবং তাদের মনোজগতের ক্ষতির কারণ হয়।

ড. মুজিবুর রহমান বলেন, সময়ের সঙ্গে অনেক কিছু বদলেছে। কিন্তু বদলায়নি শিশুদের সঙ্গে ব্যবহারের রীতিনীতি। আগে যে ‘শাসন’ শব্দটি ব্যবহার করা হতো, তা ব্যবস্থাপনায় বদলে দেওয়ার পরও শাসনের মানসিকতাটা থেকেই গেছে। আগে ধরে নেওয়া হতো, শিক্ষক একাই সব জানেন আর শিক্ষার্থীরা সাদা কাগজের মতো। কিন্তু বিষয়টি আর এমন নেই, এখনকার পড়ালেখা মানে ‘শিক্ষণ শিখন পদ্ধতি’। এই পদ্ধতিতে শিক্ষার্থী যেমন শিখবে, শিখবে শিক্ষকও। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এই পদ্ধতি পর্যন্ত পৌঁছাতে গিয়ে আমরা কিছু বিষয় হারিয়ে ফেলি।

এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের উদাহরণই টানেন ড. মুজিবুর। তিনি বলেন, শিক্ষকদের চাকরিতে প্রবেশের পরপরই সরাসরি ক্লাস নিতে পাঠানো হয়। তখন তারা নিজেদের ধারণা থেকে একটা পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের পাঠদান ব্যবস্থাপনা শুরু করেন, যা অনেক সময়ই শিশুদের জন্য মঙ্গলজনক হয় না।

নির্যাতন বন্ধের নীতিমালা প্রণয়নে বাংলাদেশের স্থান কোথায়?

২০১৭ সালের ব্লাস্ট ও সেভ দ্য চিলড্রেনের সেই গবেষণার পর জাতিসংঘের শিশু অধিকার বিষয়ক নীতিমালা (ইউএনসিআরসি) থেকে বাংলাদেশ সরকারকে শিশুদের সঙ্গে ব্যবহারের নীতিমালা প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়। পরে শিশুদের সঙ্গে ব্যবহারের একটি নীতিমালা (কোড অব কন্ডাক্ট) প্রণয়নের বিষয়টি ২০১৮ সালের চাইল্ড বাজেটের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় যুক্ত করা হয়। তবে সে নীতিমালা কেমন হবে বা কবে নাগাদ সেই নীতিমালা করা হবে, সে বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট ধারণা দেওয়া হয়নি।

একটি নীতিমালা, সবার জন্য

একরাম কবীর বলেন, শিশুদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনে বিদ্যমান নীতিমালার একটি বড় সমস্যা হচ্ছে, এখানে শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নির্যাতনের কথা বলা হয়েছে।

তবে ইউএনসিআরসি’র কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ সে সনদের স্বাক্ষরকারী একটি দেশ। সেখানে স্পষ্ট করে সব ধরনের সহিংসতা থেকে শিশুকে মুক্ত করার অধিকারের কথা বলা হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তো বটেই, শিশুর নিজের বাড়ি, বিকল্প যত্নকেন্দ্র, ডে কেয়ার ও ফৌজদারি স্থাপনাসহ সব ধরনের স্থাপনায় শিশুর শাস্তি বর্জনের কথা বলা হয়েছে। ফলে যেহেতু আমাদের নীতিমালায় শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়ে গেছে, তাই শিশুদের শাস্তি দেওয়াই যে একটা অপরাধ, তাই বুঝতে পারছেন না কেউ।

একটি বিজ্ঞানসম্মত সার্বজনীন নীতিমালার সুপারিশ করেন ড. হেলালও। তিনি বলেন, আমাদের দেশে জেন্ডারের বিষয়ে যেমন নীতিমালা প্রণয়ন করে নারীদের বিষয়ে মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে, ঠিক তেমনি শিশুদের বিষয়েও একটি নীতিমালা প্রয়োজন। এই নীতিমালা মানতে হবে সবাইকে। যেখানেই একটি শিশুর যাতায়াত থাকবে, সেখানেই শিশুর জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এমনকি, কারাগারেও যদি কোনো সাজাপ্রাপ্ত আসামির সন্তান তার সঙ্গে দেখা করতে যায়, সেখানেও সবাইকে সচেতন থাকতে হবে যেন শিশুটির মনোজগতে কোনো আঘাত না আসে, যা তার পরবর্তী জীবনকে প্রভাবিত করে।

সারাবাংলা/এমএ/টিআর

ব্লাস্ট শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন শিশু নির্যাতন

বিজ্ঞাপন

না ফেরার দেশে অঞ্জনা
৪ জানুয়ারি ২০২৫ ০১:৫৪

এই তাসকিনকে সমীহ করবেন যে কেউ
৪ জানুয়ারি ২০২৫ ০১:৪৭

আরো

সম্পর্কিত খবর