ভিকারুননিসা স্কুল নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই
৫ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৮:২২ | আপডেট: ৫ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৭:৫৮
।। মেসবাহ শিমুল, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: রাজধানীর নামি প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ। তৎকালীন গভর্নর ফিরোজ খান নূনের সহধর্মীনীর নামে ১৯৫২ সালে রাজধানীর বেইলি রোডে এই বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে লেখাপড়ায় সুনাম ধরে রেখেছে এ বিদ্যালয়টি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এসে ভর্তি বাণিজ্যসহ নানামুখী কালিমা লেগেছে বিদ্যালয়টিতে। স্কুলটি নিয়ে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের অভিযোগের অন্ত নেই।
শিক্ষকদের কাছে শিক্ষার্থীদের মা-বাবার অপমানিত হওয়ার অভিযোগে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যার পর মঙ্গলবার (৪ ডিসেম্বর) সারাদিন স্কুল ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাছ থেকে অভিযোগের যে ফিরিস্তি শোনা গেল, তা রীতিমতো বিস্ময়কর। কেউ কেউ বলছেন, এখানকার প্রতিটি অভিভাবকের কাছে যত অভিযোগ রয়েছে, তা জমা করা গেলে ভাগাড়ে পরিণত হতে বিদ্যালয়টি।
অভিভাবকদের অভিযোগ, ২০১১ সালের পরিমল জয়ধর কাণ্ডের পর থেকে ধীরে ধীরে বিদ্যালয়টির সুনাম ক্ষুণ্ন হতে থাকে। তবে গত পাঁচ বছরে ভর্তি খাতে চরম অনিয়ম ও দুর্নীতি বিদ্যালয়টির সুনাম যেমন ক্ষুণ্ন করেছে, তেমনি শিক্ষার মানকেও করেছে নিম্নগামী। তাদের মতে, স্কুলটিকে ঘিরে কোটি কোটি টাকার ভর্তি বাণিজ্য হয় প্রতিবছর। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট স্কুলের ব্র্যান্ডকে পুঁজি করে কাড়ি কাড়ি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
সেইসঙ্গে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের সঙ্গে শিক্ষকদের দুর্ব্যবহার, নিয়ম বহির্ভূত ফি আদায়, কোচিং-প্রাইভেটে বাধ্য করা, ইচ্ছামতো ক্লাস-পরীক্ষার রুটিন চাপিয়ে দেওয়া, শিক্ষার্থীদের ন্যয়সঙ্গত দাবিও আমলে না নেওয়া, অভিভাবকদের কোনো অভিযোগ কানে না তোলা, কারণে-অকারণে অভিভাবকদের ডেকে শিশুদের সামনে অপমানজনক ব্যবহারসহ বিভিন্ন অভিযোগ তাদের। তবে এসব অভিযোগ করলেও গণমাধ্যমে নাম পরিচয় প্রকাশ হোক— অধিকাংশ অভিভাবক ও শিক্ষার্থীই তা চান না।
বিদ্যালয়টির ১ নম্বর গেটে দাঁড়িয়ে কথা হয় হাফিজুর রহমান নামের একজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ৭টা বছর খুব কষ্টে ছিলাম। মেয়েটা এখানে পড়ত। কত ধরনের অত্যাচার যে সহ্য করেছি, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। এখানকার কর্তৃপক্ষ অন্যদেরকে মানুষই মনে করে না। অথচ তাদের কাছে আমরা সন্তানদের দিয়ে মানুষ গড়ার স্বপ্ন দেখেছি।
রুবিনা জাহান নামের এক অভিভাবক সারাবাংলাকে বলেন, এখানে সবাই কমবেশি শিক্ষকদের দুর্ব্যবহারের শিকার। কিন্তু কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না। প্রত্যেকেরই পরিবার আছে। আমি মুখ খুলছি কারণ আমি একজন সিঙ্গেল মাদার। আমার দু’টি মেয়েকে এখানে পড়াতে গিয়ে অপমানিত হতে হতে এখন আর আমার অপমানবোধ কাজ করে না। তার মতে, এখানে সন্তানকে পড়াতে আসা যুদ্ধে নামার সমান। মা-বাবারা প্রতিনিয়ত এখানকার শিক্ষক-স্টাফদের সঙ্গে যুদ্ধ করেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
নামি বিদ্যালয় হওয়ায় ভিকারুননিসায় পড়ালেখার চাপ অনেক বেশি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেটি বাড়াবাড়ির সামিল— এমন মন্তব্য করে একজন অভিভাবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, টেস্ট পরীক্ষায় এমনি এমনি বাচ্চাদের ফেল করিয়ে দেয়। এবার ক্লাসে যে মেয়েটির এক রোল, তাকেও এক বিষয়ে ফেল করানো হয়েছে। রি-টেস্টের নামেও এখানে বাণিজ্য চলে। এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানসিক চাপ তৈরি হয়। তারা যেকোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
এখানকার শিক্ষার্থীরা যে ক্যাম্পাসে মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে থাকে, তার একটা প্রমাণ মিললো ক্যাম্পাস কম্পাউন্ডের ভেতরে। সেখানের একটি দেওয়ালে চিত্রের মাধ্যমে দশটি ধাপে ভিকারুননেসার শিক্ষার হাল তুলে ধরা হয়েছে। যার মধ্যে ভর্তি, পরীক্ষা, প্রেশার— এগুলো কিভাবে একজন শিক্ষার্থীকে হতাশার দিকে নিয়ে যায়, সেটিই তুলে ধরা হয়েছে।
এদিকে, নানা অভিযোগ থাকলেও অভিভাবকদের প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ খুবই কম এখানে। তারা বলছেন, সর্বাঙ্গে ব্যাথা। কার কাছে অভিযোগ করব? অভিযোগ করতে গেলে উল্টো ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। তাদের অপরাধে আমাদের বাচ্চাদের টিসি দেওয়া হোক, সেটা আমরা চাই না। তাই মুখ বুঁজে বছর পার করতে চাই আমরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরও কয়েকজন অভিভাবক সারাবাংলাকে বলেন, অভিযোগসহ বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য একটি গভর্নিং বডি থাকে। কিন্তু এখানকার গভর্নিং বডির কাজ উল্টো। তারা কেবল পয়সার ধান্ধা করে, আর আমাদের দমিয়ে রাখে।
জানা গেছে, গভর্নিং বডির এমন সিন্ডিকেটের কাছে অসহায় অভিভাবকরা বাধ্য হয়ে একটি অভিভাবক ফোরাম করেছেন। তারা নিজেদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে বিভিন্ন সময় সোচ্চার হন। তবে আইনি দিক দিয়ে তারা স্কুল কমিটির কোনো কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। এ কারণে অনেক অনিয়ম সম্পর্কে জানলেও তাদের কিছু করার থাকে না বলে জানান ফোরামের এক সদস্য।
তিনি বলেন, ২০১৮ শিক্ষাবর্ষে এক একটি ভর্তিতে সাত লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে। এভাবে দুর্নীতির মাধ্যমে যেমন অভিভাবকরা নিজেরা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন, তেমনি শিশুদেরও জীবনের শুরুর ধাপেই দুর্নীতিতে জড়িয়ে দিচ্ছেন। আর এতে করে পকেট ভরছে সিন্ডিকেটের। শিক্ষকরা হচ্ছেন কোটিপতি। শিক্ষক যখন কোটিপতি হয়ে যান, তখন তার পা তো মাটিতে থাকার কথা না। সে তো মানুষের সঙ্গে খারাপ আচরণই করবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ অভিভাবক ফোরাম সদস্য বলেন, ভিকারুননিসা ব্র্যান্ডের জন্য অনেকে লাখ লাখ টাকা খরচ করে। তবে আগের চেয়ে এখানে ভর্তিতে চাপ অনেক কমেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বছর পাঁচেক আগেও এখানে নির্ধারিত আসনের ৩০ গুণ আবেদন হতো। তবে এবার হয়েছে মাত্র ৮ গুণ। এতে বোঝা যায়, মান কমছে। চাপও কমছে। রাজধানীতে আরও কিছু ভালো মানের স্কুল গড়ে উঠলে চাপ আরও কমবে বলে মনে করেন তিনি।
পড়ালেখায় স্কুলের সুনামের পাশাপাশি বেশকিছু বিষয়ে দুর্নাম রয়েছে— সেটি স্বীকার করেছেন খোদ শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও। তিনি বলেছেন, এই স্কুলের ব্যাপারে তার কানে বেশকিছু অভিযোগ এসেছে। বিশেষ করে শিক্ষার্থীর আত্মহত্যাকে কেন্দ্র করে যে অভিযোগগুলো সামনে এসেছে, তার বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণেরও আশ্বাসও দেন তিনি।
যদিও এমন অভিযোগের কিছুই জানা নেই বলে জানিয়েছেন বিদ্যালয়টির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাসিম ফেরদৌস। তিনি বলেন, আমার কাছে অভিভাবকদের পক্ষ থেকে কখনও কোনো অভিযোগ আসেনি। এলে ব্যবস্থা নিতাম।
সারাবাংলা/এমএস/টিআর
আরও পড়ুন-
ক্ষমা চাইলেন ভিকারুননিসার অধ্যক্ষ
শান্তিনগরে ভিকারুননিসা শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা
তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়া হবে: শিক্ষামন্ত্রী
ভিকারুননিসার শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, তদন্তে ৩ কমিটি
ভিকারুননিসার প্রভাতী শাখার প্রধান শিক্ষক সাময়িক বরখাস্ত
শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ
বুধবার ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের
অভিযোগ অরিত্রীর আত্মহত্যা ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ