বিনোদন থেকে বিএনপিতে
৯ জানুয়ারি ২০১৮ ০৮:২৭ | আপডেট: ১৭ মার্চ ২০১৮ ১৮:৪৭
আসাদ জামান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
ঢাকা : সঙ্গীত, অভিনয়, সুর, নাটক-থিয়েটার, ফুটবল-ক্রিকেট, গান-কবিতা, সাহিত্যকর্ম এসবে সাফল্য মানুষকে দেয় বিপুল জনপ্রিয়তা। কেউ কেউ তারকা খ্যাতি পেয়ে যান। তাদের ভক্তও থাকে প্রচুর। যেখানেই যান ভক্তরা ভীড় করে থাকে। অটোগ্রাফ শিকারিরা ছেঁকে ধরে। দুচোখে একবার দেখতে পাওয়াই যেনো অনেক বড় কিছু। ফলে এরা থাকেন একটু ধরা-ছোঁয়ারও বাইরে। কিন্তু এদের মধ্যে কেউ কেউ রয়েছেন যাদের আরও চাই। আর সে জন্য একটা পর্যায়ে তারা রাজনীতিতে যোগ দেন। আবার এও হতে পারে রাজনীতিরই প্রয়োজন হয় তাদের। হতে পারে তাদের তারকা খ্যাতিকে কাজে লাগাতে চায় দলগুলো। ফলে তাদের জন্য থাকে অফার। আর সে কারণে একসময় পর্দায় ঝড় তোলা নায়ক-নায়িকা, কিংবা সাহিত্য-সংস্কৃতির আরও নানা অঙ্গনের পারঙ্গমরা হয়ে ওঠেন রাজনীতিক। বিশ্বের দেশে দেশে এর উদাহরণ রয়েছে। বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম নয়। সারাবাংলার পাঠকদের জন্য আজ তুলে ধরা হলো তাদের কথা যারা বিনোদন জগত থেকে যোগ দিয়েছেন বিএনপিতে।
বাংলাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপিতে রয়েছেন বিনোদন জগতের এক ঝাঁক তারকা। যতটা দেখা যাচ্ছে এসব রাজনীতিক খুব ভাল মতোই রপ্ত করেছেন রাজনীতির কলা-কৌশল। রাজপথে মিছিল-মিটিং, পুলিশের লাঠি-পেটাও খেয়েছেন কেউ কেউ। পুরস্কার হিসেবে দল থেকে পেয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ পদ। ক্ষমতার পালা বদলে কারো কারো ভাগ্যে জুটেছে কিংবা জুটতে পারে এমপি-মন্ত্রীত্বও।
স্বাধীনতা ও দেশপ্রেম নিয়ে অসংখ্য কালজয়ী গানের স্রষ্টা গাজী মাজহারুল আনোয়ার। তিনি একাধারে একজন চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, রচয়িতা, গীতিকার ও সুরকার। ২০ হাজারের বেশি গান রচনা করেছেন তিনি। বিবিসি বাংলার জরিপে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিশটি বাংলা গানের তালিকায় রয়েছে তার লেখা তিনটি গান। ২০০২ সালে একুশে পদক লাভ করেছেন তিনি।
জয় বাংলা বাংলার জয়, একতারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল, একবার যেতে দে-না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়, জন্ম আমার ধন্য হল,গানের খাতায় স্বরলিপি লিখে, আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল, যার ছায়া পড়েছে, শুধু গান গেয়ে পরিচয়, গীতিময় সেইদিন চিরদিন, ওপাখি তোর যন্ত্রণা, ইশারায় শীষ দিয়ে, চোখের নজর এমনি কইরা, এই মন তোমাকে দিলাম, দয়াল কি সুখ তুমি পাও, চলে আমার সাইকেল হাওয়ার বেগেসহ অজস্র কালজয়ী গানের স্রষ্টা গাজী মাজহারুল আনোয়ার গত দুই যুগ ধরে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।
দলটির অঙ্গ সংগঠন জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা-জাসাস’র সঙ্গে প্রথমে সম্পৃক্ত থাকলেও এখন মূল দলের সঙ্গে রয়েছেন তিনি। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত বিএনপির সর্বশেষ জাতীয় কাউন্সিলে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা নির্বাচিত হয়েছেন তিনি।
তবে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সর্বজন শ্রদ্ধেয় গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানটি আওয়ামী লীগের দলীয় সঙ্গীতের মর্যাদা পেয়েছে। সাম্প্রতিক রাজনীতি ও দ্রব্যমূল্য নিয়ে লেখা একটি গান এখন বিএনপির সব প্রোগ্রামেই বাজানো হয়।
আশরাফ উদ্দিন আহমেদ উজ্জ্বল। ঢাকাই চলচিত্রে যিনি ম্যাগাস্টার উজ্জ্বল নামেই খ্যাত। প্রয়াত সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘বিনিময়’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রাঙ্গণে ঢোকেন শক্তিমান এই অভিনেতা। অভিনয় করেছেন শতাধিক ছায়াছবিতে।
অভিনয়ের পাশাপাশি চলচ্চিত্র প্রযোজনা ও পরিচালনাও করেছেন বেশ কয়েকটি। অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী, ইয়ে করে বিয়ে, নালিশ, নসিব, উসিলা, নিজেকে হারিয়ে খুঁজি এসব তার জনপ্রিয়তা পাওয়া ছবির বড় তালিকার অংশ। আর তার পরিচালিত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে- শক্তি পরীক্ষা, তীব্র প্রতিবাদ ও পাপের শাস্তির মত ছবি।
বিনোদন জগতের এই পরিচিত মুখ এখন বিএনপির সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক। দলটি অঙ্গ সংগঠন জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা-জাসাস’র সিনিয়র সহ-সভাপতিও ছিলেন তিনি।
কিংবদন্তি সঙ্গীত শিল্পী রুনা লায়লা-সাবিনা ইয়াসমিনের পর বাংলাদেশের সঙ্গীতাঙ্গনে বেবী নাজনীন অন্যতম। গত চার দশকে অসংখ্য জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন তিনি। শ্রেষ্ঠ প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসেবে ১৯৯৩ ও ২০১৩ সালে পেয়েছেন জাতীয় চলচিত্র পুরস্কার।
প্রথিতযশা এই কণ্ঠশিল্পী এখন বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। প্রথম দিকে জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা-জাসাসের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও এখন মূল দলে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। সর্বশেষ কাউন্সিলে সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হয়েছেন তিনি।
৯০ দশকের শেষেরে দিকে ‘তোমার কোনো দোষ নেই আমারই তো দোষ, আমারই তো ভুল’ গান নিয়ে সঙ্গীতাঙ্গনে ঝড় তুলে যার আগমন তিনি হলেন শিল্পী মনির খান। তার অঞ্জনা সিরিজের গান বাংলা গানের জগতে স্থায়ী আসন করে নিয়েছে। এছাড়া আট আনার জীবন, চিঠি লিখেছে বউ আমায় ভাঙা ভাঙা হাতে, জোর করে ভালবাসা হয় না অসংখ্য জনপ্রিয় গানে কণ্ঠ দিয়ে শ্রোতাদের হৃদয় জয় করা মনির খান এখন পুরোদস্তুর রাজনীতিবিদ।
বিএনপির সহ-সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক মনির খান গত মেয়াদে জাসাসের সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ঝিনাইদহ থেকে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন তিনি। দল নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় শেষ পর্যন্ত ভোটের মাঠে জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের সুযোগ পাননি প্রখ্যাত এই সঙ্গীত শিল্পী।
হাফিজ উদ্দিন পরিচালিত ‘প্রিয় তুমি’ সিনেমার মাধ্যমে বড়পর্দায় অভিষেক হওয়া হেলাল খান এখন বিএনপির বড় নেতা। কিছু দিন আগে নাশকতার মামলায় গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন ‘বাজিগর’, ‘সাগরিকা’, ‘আশা আমার আশা’, ‘হাছন রাজা’, ‘মমতাজ’, ‘জুয়াড়ি’, ‘গুরু ভাই’, ‘কুখ্যাত খুনি’সহ অর্ধশতাধিক সিনেমার এই জনপ্রিয় নায়ক।
বিএনপির অঙ্গ সংগঠন জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা- জাসাসের সর্বশেষ কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক নির্বিচিত হওয়া হেলাল খান প্রযোজিত ছবির মধ্যে বাজিগর, সাগরিকা ও হাছন রাজা অন্যতম। হাছন রাজা চলচ্চিত্রটি ২০০২ সালে সেরা চলচ্চিত্রের ক্যাটাগরিতে পুরস্কার পায়। একই বছর ‘জুয়াড়ি’ চলচ্চিত্রে খলনায়কের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার।
এ ছাড়া সঙ্গীত শিল্পী আসিফ আকবর, রিজিয়া পারভীন, ন্যান্সি, অভিনেতা বাবুল আহমেদ, খল অভিনেতা শিবা সানু, অভিনেত্রী রিনা খান বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। মাঝে মধ্যে খল অভনেতা মিশা সওদাগরকেও বিএনপির প্রোগ্রামে দেখা যায়। আর প্রখ্যাত চলচিত্রকার ও অভিনেতা আমজাদ হোসেনকেও খালেদা জিয়ার একটি জন্মদিনে উপস্থিত হতে দেখা গেছে।
বিনোদন জগৎ থেকে বিএনপিতে আসা এসব তারকাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে দলটির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রাজনীতির প্যাটার্ন এখন চেঞ্জ হয়েছে। আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভায় বিনোদন, সাংস্কৃতিক জগতের বাসিন্দাদের জায়গা হলে ভবিষ্যতে বিএনপির মন্ত্রিসভায়ও বিনোদন জগতের লোকদের দেখা যেতে পারে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘ সব মত ও পথের মানুষের সমাবেশ ঘটেছে বিএনপিতে। সবাইকেই আমরা যথাযথ মূল্যায়নের চেষ্টা করছি। আগামীতে এরাই দলটাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।’
সারাবাংলা/এজেড/এমএম