Thursday 09 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের হেয়ালি-খামখেয়ালির শিকার ২৩৬ জন মানুষ!


১৩ নভেম্বর ২০১৮ ০৯:৩৮ | আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০১৮ ০৯:৪৫

।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

ঢাকা: চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. শামসুদ্দিন হলি ফ্যামিলি রেডক্রিসেন্ট হাসপাতালে যোগদান করেছিলেন ১৯৮৭ সালে। অবসর নিয়েছেন দীর্ঘ ২৫ বছর কাজ করে ২০১৩ সালে। অথচ ডা. শামসুদ্দিন অবসরের পর তার গ্রাচুইটির টাকা পাননি হাসপাতাল থেকে।

১৯৭৭ সাল থেকে ২০১৫ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত প্রায় ৩৮ বছর ৬ মাস ১২ কাজ করেছেন হাসপাতলের স্টোর ইনচার্জ ফজলুর রহমান। তিনি বলেন, আমরা কেবল ৫ থেকে ৭ জন আছি, যারা একটু ভালোভাবে জীবনযাপন করছি। বাকিরা সবাই অমানবিক জীবন কাটাচ্ছে। অথচ, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, তারা বিষয়টিকে পাত্তাই দিচ্ছেন না। এতগুলো মানুষ অমানবিক জীবন যাপনকরছেন-অথচ তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। নয়তো তারা আমাদের ডাকতেন, কথা শুনতেন দুপক্ষ মিলে কথা বলে নিশ্চয় একটা সমাধানের পথ বেরিয়ে আসতো। টাকা না পেয়ে চিকিৎসা করাতে না পেরে, বিনা চিকিৎসায় অন্তত ১০ জন মারা গিয়েছেন, তাদের মৃত্যুর দায়দায়িত্ব কী এড়াতে পারে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ-প্রশ্ন তাদের।

জানা যায়, এ পর্যন্ত ২৩৬ জন-চিকিৎসক, সেবিকা, কর্মকর্তা-কর্মচারি হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতাল থেকে অবসর নেওয়ার পর তারা গ্রাচুয়িটির টাকা পাচ্ছেন না। ভুক্তভোগীরা জানালেন, অবসরে যাবার পরপর গ্রাচুইটির টাকা যেটা এককালীন পাওয়ার কথা থাকলেও সেটা ২০০৮ সাল থেকে দেওয়া একেবারেই বন্ধ রয়েছে। হয়তো কোনো উৎসব পার্বণে তারা দয়া করে কিছু টাকা দেন। সারাটাজীবন এ হাসপাতালে চাকরি করে এখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদেরকে নিয়ে হেয়ালি করছেন, তাদের জীবন নিয়ে খামখেয়ালি করছেন বলে অভিযোগ এসব চিকিৎসক, সেবিকা, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।

বিজ্ঞাপন

তারা বলেন, অবসর নেওয়ার পর হাসপাতাল থেকে প্রথমদিকে মাসে মাসে ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা করে দিতো, পরে সেটা হলো কয়েক মাস পরপর কিন্তু দুবছর থেকে সেটা একেবারেই বন্ধ রয়েছে। অথচ, ওনাদের কোনো অধিকার নেই আমাদের প্রাপ্য টাকা আটকে রাখা, এটা আমাদের প্রাপ্যের টাকা, আমাদের কষ্টের টাকা, কাজের বিনিময়ে অর্জিত টাকা। সে টাকা কেন তারা আটকে রাখবে, বলেন তারা।

ভুক্তভোগীরা বলেন, গত অনেকদিন ধরেই পাওনা টাকার জন্য আমরা দাবি জানিয়ে এসছি। মানববন্ধন করেছি, হাসপাতালের পরিচালক, রেডক্রিসেন্টের চেয়ারম্যানসহ সবার কাছে স্মারকলিপি দিয়েছি। কিন্তু তাতে কোনো কাজ না হওয়াতে গত সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে রাষ্ট্রপ্রতি আবদুল হামিদের কাছেও স্মারকলিপি দিয়েছি-যেহেতু তিনি পদাধিকারবলে রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির সভাপতি।

তবে এতেও যদি কাজ না হয় তাহলে আমরা শেষ পর্যন্ত আইনের আশ্রয় নিতে বাধ্য হবো, বলেন তারা।

৬৯ বছরের ফজলুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, এরা কেবল আমাকে হজ্বে যাবার সময় দুই লাখ আর মেয়ের বিয়ের সময় দিয়েছে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা দিয়েছে। এখনও আমি ১৮ লাখ ৫৫ হাজার টাকা পাই। আমার স্ত্রী চাকরি করে আর এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি বলে কোনো রকমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া আরেক এক মেয়েকে নিয়ে বেঁচে আছি। কিন্তু অনেকেরই খেয়ে পড়ে থাকার মতো টাকা নেই, টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে না পেরে আমাদের অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন।

ফজুলর রহমান বলেন, আমার বাড়ি গোপালগঞ্জ, আওয়ামী লীগ করি, গণজাগরণ মঞ্চে থেকেছি দিনের পর দিন। কিন্তু দুঃখ হয়, এখানেও আওয়ামী লীগের লোকেরা সব পদ দখল করে আছে, অথচ তাদের আমাদের দিকে তাকানোর সময় নেই। তারা যদি একটু ভাবতো, ২৬ কোটি টাকা তারা মনে হয় করে না, যদি চেষ্টা করতো তাহলে পেয়ে যেতাম।

বিজ্ঞাপন

খাদ্য বিভাগের চিফ সুপারভাইজার হিসেবে দীর্ঘ ৪০ বছর তিন মাস চাকরি করেছেন ৬৫ বছরের বেশি মো. আফজাল খান। ২০১২ সালের জানুয়ারিতে তিনি অবসর নিয়েছেন এই হাসপাতাল থেকে। গ্রাচুইটির টাকা জমা হয়েছে ১৮ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। এর মধ্যে ১২ লাখ ২৫ হাজার টাকা পাওনা রয়েছে হাসপাতালের কাছে।

আফজাল খান বলেন, তার তিন মেয়ে দুই ছেলে। সরকারি চাকরি করে এক ছেলে, আর এক ছেলে মেডিকেলে পড়ছে। ওর পড়ার টাকাটা দিতে আমার কষ্ট হচ্ছে। আর মেয়েদের বিয়ে হয়েছে

হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী, কর্মকর্তা সেবিকাদের পক্ষ থেকে কমিটির সাধারণ সম্পাদক অঞ্জলি গোমেজ সারাবাংলাকে বলেন, ১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বরে যোগদান করে ২০১৬ সালের ২৯ জুন অবসর যাই। ৩৭ বছর ৯ মাস ২৯ দিনে আমার পাওনা ৩০ লাখ ৮০ হাজর টাকা কিন্তু সেখানে থেকে ৯০ হাজার টাকা পেয়েছি।

ক্ষোভ আর হতাশা নিয়ে অঞ্জলি গোমেজ বলেন, দীর্ঘ এই সময়ে অনেক শ্রম দিয়েছি, নিজের ১ মাস ১০ দিনের দুধের বাচ্চাকে বাড়িতে রেখে নাইট ডিউটি করেছি টানা ১৫ দিন, অন্যের বাচ্চাদের দেখাশোনা করেছি, সেবা করেছি। মানছি সেটা চাকরির জন্যই, কিন্তু এখনোতো সেই চাকরির ন্যায্য টাকাটাই চাইছি। আমরা অন্যায্য কিছু চাইছি না, আমাদের পাওনা টাকা আমরা পাচ্ছি না। এটা কোনো দয়া না, করুণা না, ভিক্ষা না, কারও অনুদানও না। এটা আমাদের প্রাপ্য টাকা। অঞ্জলি গোমেজ তাদের সমস্যা সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ জানিয়ে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করছি, তিনি আমাদের জন্য এগিয়ে আসুন।

শ্যামল কুমার সাহা- ১৯৮৫ সালে যোগদান করে এ হাসপাতালে চাকরি করেছেন ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত প্রায় ৩৫ বছর। তিনি বলেন, গত একবছর ধরে তারা আমাকে চিঠি দিয়েছেন, হিসাব দিয়েছেন কিন্তু ৩৭ লাখ ৪৫ হাজার ১৮২ টাকা। কিন্তু এই এক বছরে তারা আমাকে দিয়েছে মাত্র ৩০ হাজার টাকা। দুই মেয়ে এক ছেলে-এদেরকে নিয়ে কী করে সংসার চলে আমাদের সেটা কী কেউ এখানকার বড় কর্তারা ভেবেছেন। হিসাব বিভাগ থেকে চিঠি দিয়েছে পাওনা বুঝে নেওয়ার জন্য কিন্তু সেখানে গেলে কেবল বলে টাকা নাই। কেন নাই, তার কোনো সদুত্তর পাই না। দিনের পর দিন তারা আমাদের ঘুরিয়ে যাচ্ছে।

মৃত্যুর দারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি-চিকিৎসা দরকার, কিন্তু টাকার জন্য সেটা করতে পারছি না। আমিতো আমার কর্তব্যে কোনো অবহেলা করিনি। তাহলে এই হাসপাতাল কেন তাদের কর্তব্য করছে না। আমার অধিকার এই টাকা, তারা কেন সে টাকা দিচ্ছেন না, প্রশ্ন করেন শ্যামল কুমার সাহা। তিনি বলেন, এখন আমরা সন্দীহান হয়ে পরেছি, জীবন থাকতে এই টাকা পাবো কিনা।

কারণ ইতোমধ্যেই হাসপাতাল থেকে অবসর নেওয়া হাসপাতালের কনসালটেন্ট কার্ডিওলজিস্ট ডা. নুরুল ইসলাম, নার্সিং সুপারভাইজার সুমিতা মোল্লা, সিনিয়র স্টাফ নার্স ফুলকুমারী, নার্সিং সুপারভাইজার নিলীমা মাইথি, অ্যকাউন্টস বিভাগের রফিক, জুনিয়র নার্স বিথিকা, হাসপাতালের ফার্মাসি বিভাগের কর্মকর্তা আব্দুল জলিল, টেলিফোন অপারেটর মো. হাসান, স্টোর ইনচার্জ আব্দুল মজিদ খান, রেজাউল, রফিক, পরিমলসহ অন্তত ১০ থেকে ১২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের পাওনা টাকা পাওয়ার আগেই মৃত্যুবরণ করেছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মচারী সারাবাংলাকে বলেন, বর্তমানে যারা কর্মরত আছেন, তাদেরও প্রায় তিনমাস ধরে বেতন হচ্ছে না, অথচ হাসপাতালের সৌন্দর্যবৃদ্ধির কাজ চলছে কোটি কোটি টাকা খরচ করে।

জানতে চাইলে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান হাফিজ আহমদ মজুমদার সারাবাংলাকে বলেন, হাসপাতালের ফান্ডে কোনো টাকা না থাকায় অবসরপ্রাপ্তদের টাকা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

যারা বর্তমানের চাকরি করছেন তাদের বেতন হয় না এবং অবসরপ্রাপ্তদের ন্যায্য টাকা না দিলেও হাসপাতালের সৌন্দর্যবৃদ্ধির জন্য টাকা খরচ করা হচ্ছে প্রশ্ন করলে হাফিজ আহমদ মজুমদার বলেন, যারা টাকা দিচ্ছেন তারা হাসপাতালের উন্নয়নের জন্য, যন্ত্রপাতি কেনার জন্য দিচ্ছে, তারাতো কারও বেতন দেওয়ার জন্য বা অবসরপ্রাপ্তদের দেওয়ার জন্য টাকা দিচ্ছে না।

সারাবাংলা/জেএ/এমআই

হলি ফ্যামিলি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর