২০ দিনে সাড়ে ৭ কোটি টাকা জরিমানা: তবুও সড়কে ফেরেনি শৃঙ্খলা
২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১০:০৪ | আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১১:২৪
।। সাদ্দাম হোসাইন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা : রাজধানীর সড়কে যানচলাচলে শৃঙ্খলা ফেরাতে কঠোর অবস্থানে রয়েছে ট্রাফিক পুলিশ। গত আগস্টে ট্রাফিক সপ্তাহের ১০ দিনে গণপরিবহন, প্রাইভেট কার ও মোটরসাইকেলের চালকদের বিরুদ্ধে মামলা হয় প্রায় ৮৮ হাজার, জরিমানা হয় ৫ কোটি টাকারও বেশি। চলতি সেপ্টেম্বর মাসেও ৫ তারিখ থেকে পরবর্তী ২০ দিনে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে মোট ১ লাখ ২৫ হাজার ৫৫৭টি মামলা করেছে ট্রাফিক পুলিশ। তাতে জরিমানা হয়েছে সাড়ে ৭ কোটি টাকারও বেশি।
ট্রাফিক পুলিশ বলছে, এত বিপুল পরিমাণ মামলা ও জরিমানার পরও কমেনি ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতা। এখনও যত্রতত্র থামছে বাস, ওঠানামা করছে যাত্রী। যেখানে সেখানে পার্কিং, সড়ক ও ফুটপাত দখলের প্রবণতাও কমেনি খুব একটা। পথচারীদের নিয়ম ভাঙার মিছিলও থামেনি। মামলা আর জরিমানার মাধ্যমে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ট্রাফিক পুলিশের এই উদ্যোগ নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ও নগর পরিকল্পনাবিদরা। যদিও ট্রাফিক পুলিশ বলছে, এখনই সুফল না মিললেও এই উদ্যোগের সুফল মিলবে দীর্ঘ মেয়াদে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি নিরাপদ সড়কের দাবিতে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে গত ৫ আগস্ট থেকে ১৪ আগস্ট পালন করা হয় ট্রাফিক পুলিশ সপ্তাহ। ওই ১০ দিনে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে পরিবহনচালকদের নামে মামলা দেওয়া হয় ৮৮ হাজার ২৯৩টি, জরিমানা করা হয় ৫ কোটি ১০ লাখ ৯৬ হাজার ২৭৭ টাকা। এতেও সুফল না মিললে ৫ সেপ্টেম্বর থেকে মাসব্যাপী ট্রাফিক সচেতনতা মাস পালনের ঘোষণা দেয়।
ট্রাফিক বিভাগ জানায়, এই সচেতনতা মাস শুরুর পর ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২০ দিনে বিভিন্ন পরিবহনচালকদের ১ লাখ ২৫ হাজার ৫৫৭টি মামলা দিয়েছে ট্রাফিক পুলিশ। এসময় জরিমানা আদায় করা হয়েছে ৭ কোটি ৬৫ লাখ ৫৮ হাজার ৯০০ টাকা। পাশাপাশি ১ হাজার ১৭৫টি যানবাহন ডাম্পিং এবং ১৮ হাজার ৩২৯টি পরিবহনকে রেকারিং করে ট্রাফিক পুলিশ।
মামলা আর জরিমানার ভয়ে ট্রাফিক আইন ভাঙার প্রবণতা কমবে বলে প্রত্যাশা থাকলেও ট্রাফিক বিভাগ থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, ট্রাফিক অপরাধের প্রবণতা বাড়ছে। জানা গেছে, গত ২১ সেপ্টেম্বর ট্রাফিক পুলিশ মোট ৫ হাজার ৫৯২টি মামলা করেছে পরিবহনচালকদের বিরুদ্ধে এবং জরিমানা আদায় করেছে ৩৪ লাখ ১৫ হাজার ১৬০ টাকা। পরদিন ২২ সেপ্টেম্বর মামলার সংখ্যা আরও ২ হাজার ৭৮৩টি বেড়ে দাঁড়ায় ৮ হাজার ৩৮৫টি। জরিমানাও বেড়ে হয় ৩৬ লাখ ৯১ হাজার ৩৫৫ টাকা। মামলা ও জরিমানার পরিমাণ বেড়েছে পরদিন ২৩ সেপ্টেম্বরেও। এদিন মামলা হয় ৮ হাজার ৮৭২টি, জরিমানা আদায় হয় ৪০ লাখ ৮৯ হাজার ৯৮৫ টাকা।
সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে চালক ও পথচারীদের মধ্যে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন করছে ট্রাফিক পুলিশ। তাদের সঙ্গে নিরলসভাবে কাজ করছেন স্কাউট ও গার্লস গাইড সদস্যরাও। সেইসঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যান্য শাখার সদস্যরাও কাজ করছেন সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে। কিন্তু কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না সড়ক।
গণপরিবহনগুলোকে নির্ধারিত স্টপেজে যাত্রী ওঠানামা করানো এবং গাড়ির ভেতরে গাড়ির নাম্বার ও চালকের পরিচয় ঝুলিয়ে রাখার নির্দেশনা দেওয়া হলেও কোনো গণপরিবহনকেই এ নিয়ম মানতে দেখা যায়নি। একইসঙ্গে নির্দিষ্ট জেব্রা ক্রসিং ও ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহারের আহ্বান জানানো হলেও বেশিরভাগ পথচারীই তা মানছেন না। আর সাধারণ মানুষও মনে করছেন, ট্রাফিক পুলিশের মামলা-জরিমানা সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কোনো কাজেই আসছে না।
রামপুরার বাসিন্দা ইবনুল কায়েশ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এত বড় আন্দোলন হলো, ট্রাফিক সপ্তাহ পালন হলো, এখন ট্রাফিক মাসও চলে। কিন্তু কোনো পরিবর্তন চোখে পড়ে না। আগে যেমন ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় নষ্ট হতো, এখনও তাই হচ্ছে। তাহলে এত আয়োজন করে মামলা-জরিমানায় কী লাভ? আমাদের তো দরকার সমাধান। সেটাই তো হচ্ছে না।’
কুড়িল-আজিমপুর রুটের স্মার্ট উইনার পরিবহনের চালক রাশেদ সারাবাংলাকে বলেন, প্রায় ১১ বছর ধরে শহরে গাড়ি চালাই। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে রাস্তার অবস্থা তত খারাপ হচ্ছে। সিগন্যাল মানার কোনো বালাই নেই, রাস্তায় শৃঙ্খলা ফিরবে কিভাবে? জিজ্ঞাসা করে দেখেন, অনেক চালক জানেও না সিগন্যাল বাতির কোনটা কী! কারণ তারা গাড়ি চালাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু রাস্তায় সিগন্যাল দেখেনি কখনও। আর ঘরে ঘরে প্রাইভেট কার তো আছেই।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির উপকমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘সড়কে বহুদিন ধরে বিশৃঙ্খলা চলছে, তাই এটা নিয়ন্ত্রণে একটু সময় লাগবে। কোনো কিছুই রাতারাতি হয় না।’
ট্রাফিক সচেতনতা মাস তো শেষের দিকে। এ মাস শেষে কি সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা এখনই বলা যাচ্ছে না। আরও কিছুদিন গেলে হয়তো বলা যাবে।’
যদিও গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ও নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, মামলা ও জরিমানার ভয় দেখিয়ে সড়কে সাময়িকভাবে কিছুটা শৃঙ্খলা ফিরতে পারে, তবে তা টেকসই হবে না। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রয়োজন বিদ্যমান অবকাঠামোগুলোর যথাযথ সংস্কার এবং নগরবাসীর চাহিদার ওপর ভিত্তি করে নতুন অবকাঠামো গড়ে তোলা।
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামছুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘সমস্যার সমাধান না করে চালক বা সাধারণ মানুষকে জরিমানার মাধ্যমে শাস্তি দেওয়া অযৌক্তিক। জরিমানায় আইন অমান্যকারীরা কিছুটা ভয় পেতে পারে। তবে তা স্থায়ী হবে না।’ অবকাঠামো সুবিধা না দিয়ে মামলা-জরিমানার উদ্যোগকে জনবান্ধব নয় বলেও অভিহিত করেন তিনি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সহসভাপতি এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ সারাবাংলাকে বলেন, অনেক অসঙ্গতি আছে, অনেক পরিকল্পনায় ভুল আছে, নিয়ন্ত্রণে অনেক গাফলতি আছে। সবকিছু পথচারীদের ওপর, চালকদের উপর চাপিয়ে দিয়ে আইন মানানো যায় না। জরিমানা বা মামলার আগে প্রয়োজন কার্যকর অবকাঠামোগত সমাধান।
সারাবাংলা/এসএইচ/টিআর