Tuesday 07 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রোহিঙ্গারা এখন স্থানীয়দের জন্য বিষফোঁড়া


২৫ আগস্ট ২০১৮ ১৬:২০ | আপডেট: ২৫ আগস্ট ২০১৮ ১৭:৩৫

।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

ঢাকা: জাতিসংঘের শরণার্থী-বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর)-এর গ্লোবাল ট্রেন্ডস-২০১৭ এর তথ্যানুযায়ী বর্তমান বিশ্বে যত উদ্বাস্তু রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দেওয়া দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান। তবে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার তালিকাতে বাংলাদেশ প্রথম।

আজ শনিবার (২৫ আগস্ট) বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে এক বছর পূর্ণ করছেন দেশ ছেড়ে পালিয়ে আসা এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। এই একবছরের নিজ দেশে ফেরত যাবার বিষয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেক ‘দেন-দরবার’ হলেও সেখানে কোনো অগ্রগতি হয়নি। বরং, এখনও নির্যাতন চলছে রাখাইনে। ফলে সীমান্তে রোহিঙ্গাদের স্রোত বন্ধ হয়নি এখনও। এ পরিস্থিতিতেই রোহিঙ্গা সংকটের একবছরের মাথায় এসে এই প্রশ্নগুলোই আসছে ঘুরেফিরে।

রোহিঙ্গারা কি আসলেই মিয়ানমারে ফিরতে চাই?

গত বছরেরে এই দিনে যখন রোহিঙ্গারা নিজ দেশে নির্যাতিত, নিপীড়িত হয় নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশে আসতে শুরু করে তখনকার সময়টা ছিল আজকের দিনের চেয়ে ভিন্ন। কক্সবাজারের স্থানীয়রা তখন নিজেদের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন এসব ঘরহীন মানুষদের, নিজেদের খাবারের কথা চিন্তা না করে খাইয়েছিলেন দিনের পর দিন অভুক্ত থাকা এসব মানুষকে। কিন্তু ঠিক এক বছরের মাথায় বদলে গেছে এ চিত্র, অন্য দেশ থেকে আসা এসব মানুষ বরং কক্সবাজারবাসীর কাছে দেখা দিয়েছে বিষফোঁড়া হিসেবে।

এক বছরেও থামেনি রোহিঙ্গাদের স্রোত

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয়দের কৃষিজমি, কর্মসংস্থান ও আয় কমে গেছে। ধ্বংস হয়েছে বনাঞ্চল ও পাহাড়। একইসঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। নিজেদের বাড়িতে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে এখন নিজ বাড়িতে পরবাসী দশা তাদের। এসব কিছুই রোহিঙ্গাদের প্রতি বিরূপ মনোভাবের কারণ।

বিজ্ঞাপন

এদিকে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের জন্য ‘বিশাল চাপ’ হিসেবে স্বীকার করেছেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, নতুন ও পুরাতন মিলিয়ে ইতোমধ্যেই প্রায় ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছেন। যাদেরকে সব ধরণের সাহায্য-সহযোগিতা সরকার করে যাচ্ছে। তবে এতোকিছুর পরও এ বিশাল জনগোষ্ঠী দেশের জন্য এখন ‘বিশাল চাপ’ হিসেবে দাঁড়িয়েছে।

এদিকে, গত এক বছরে রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনে ১১ লাখ ১৮ হাজার ৫৫৭ জন রোহিঙ্গাকে নিবন্ধিত করা হয়েছে, যারা কি না উখিয়া ও টেকনাফের ৩০টি শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দা। তবে স্থানীয় এবং সরকারি ও বেসরকারি সূত্র বলছে, এসব শিবিরের বাইরেও এখন রোহিঙ্গারা রয়েছেন। যারা কি না ছড়িয়ে ছিটিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে।

অতি সম্প্রতি কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়াতে অবস্থিত এসব রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সরেজমিনে গিয়ে দেখা রোহিঙ্গারা ক্যাম্প ছেড়ে বাইরে বের হয়ে এসেছেন, কাজ করছেন স্থানীয়দের মতো। তাদের কথা বলার ধরণ, ভাষা এবং চেহারাতে মিল থাকার কারণে সবার পক্ষে স্থানীয় এবং রোহিঙ্গাদের মধ্যে পার্থক্য বোঝা সম্ভব হয় না।

ঝুঁকি-শঙ্কায় রোহিঙ্গাদের এক বছর

‘এক থেকে ছয় পর্যন্ত উচ্চারণটা ঠিক থাকে, পার্থক্য শুরু হয় এরপর থেকে। তারা বলেন, হাত (সাত)। সাত শব্দটা এখনও আয়ত্তে আসেনি তাদের। বিশ থেকে ভেঙে ভেঙে হিসাব করে তারা- একশো বিশকে বলেন, ছয় কুড়ি। কথা বলার ঢঙে এই পার্থক্য আর গেঞ্জির ওপর লুঙ্গি পরা দেখে কেবল নিশ্চিত হওয়া যায়- এরা কক্সবাজারের স্থানীয় নন, রোহিঙ্গা।’

বিজ্ঞাপন

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নির্ধারিত ক্যাম্পগুলো ছেড়ে রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে পড়ছে পুরো কক্সবাজারে, আর তাতে নানাভাবে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন কক্সবাজরের টেকনাফ-উখিয়ার স্থানীয় বাসিন্দারা। প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার কারণে স্থানীয় প্রায় ৫ লাখ মানুষ কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছেন। তারা বলছেন, গত বছরের আগস্টে যখন রোহিঙ্গারা আসতে শুরু করে, তখন তাদের প্রতি সহানুভূতি-মায়া-ভালোবাসা ছিল। এখন তার বদলে ক্ষোভ জন্ম নিচ্ছে স্থানীয়দের মনে। ক্যাম্পগুলোর আশেপাশে স্থানীয় বনাম রোহিঙ্গাদের সংঘর্ষ এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা।

লম্বাসিয়া ক্যাম্প-২-এর বাসিন্দা সাইফুল্লাহের সঙ্গে দেখা হয় কুতুপালং রাস্তার মাথার বাজারে। সাইফুল্লাহ জানালেন, ক্যাম্পগুলোতে যেসব জিনিস পাওয়া যায় না, সেগুলো কিনে নিয়ে গিয়ে তিনি বিক্রি করেন। এতে তাদের আয় ভালোই হয়। ক্যাম্পের বাইরে কিভাবে এলেন জানতে চাইলে নিরব থাকেন সাইফুল্লাহ।

সাইফুল্লাহকে ঘিরে তখন স্থানীয়দের ভিড়। তারা বললেন, রোহিঙ্গাদের কারনে এখন স্থানীয়রা কোণঠাসা, রোহিঙ্গারা তাদের কাছে বিষফোঁড়ার মতো। স্থানীয় বাজারে রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ হিসেবে আসা চাল, ডাল ও তেল কম দামে পাওয়া যায়। কিন্তু সবজি, মাছ-মাংসের দাম আমাদের সামর্থ্যের বাইরে চলে গেছে। আর এ সংকটকেই কাজে লাগাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা, তারা পণ্য মজুদ করছেন। রোহিঙ্গাদের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য তো গেছেই, গোয়াল থেকে গরু চুরি করছে, গাছ থেকে সুপারি নিয়ে যাচ্ছে তারা। স্থানীয়রা বলছেন, আমরা যাদের আশ্রয় দিলাম, তাদের জন্য এখন আমরাই না খেয়ে মরছি।

কুতুপালং রাস্তার মাথার বাজারেই কথা হয় ৫৫ বছরের শুভধন শর্মার সঙ্গে। জানালেন, বার্মার লোকেরা আইয়া ব্যবসা-বাণিজ্য করতেছে, আমরা কিছু করতে পারি না। একই কথা বলেন, ৭৪ বছরের অধোলাল বড়ুয়া। তিনি বলেন, সেলুনে কাজ করে সংসার চালাতাম। কিন্তু এখন সব কাজ বন্ধ আমাদের। দোকান বন্ধ করে এখন ঘরে বসে আছি। লাখ লাখ মানুষ আসছে বার্মা থেকে, তাদের কারণে এখন আমাদের দেশে আমরা কাজ পাচ্ছি না, বলেন অধোলাল।

কুতুপালংয়ের পূর্ব পাড়ার শুভাষী বড়ুয়া, বাসু বড়ুয়াসহ অন্যরা বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য স্থানীয়রা ইতোমধ্যে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। নানাভাবে নিগৃহের শিকার হচ্ছেন তারা। এমনকি সাংবাদিক, এনজিও সবাই খোঁজ নিচ্ছে রোহিঙ্গাদের- স্থানীয়রা কেমন আছেন সেদিকে কারও নজর নেই। অথচ, রোহিঙ্গারা গোয়াল থেকে গরু নিয়ে যাচ্ছে, গাছ থেকে ফল নিয়ে যাচ্ছে, শিকড়সহ গাছ উপড়ে নিচ্ছে। আর সবার সহযোগিতার কারণে তাদের হাতে টাকাও রয়েছে অনেক। স্থানীয় বাজারে ব্যবসা-বাণিজ্যও নিয়ন্ত্রণ করছে তারা।

কক্সবাজার জেলার পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, রোহিঙ্গারা আমাদের জন্য হুমকি, নানা কারণেই। কয়েকদিন পর এদের নিয়ন্ত্রণ করা যাবে কি না সেই বিষয়ে এখনই কর্মকৌশল নির্ধারণ করা উচিৎ।

রাখাইনে তাদের কী অবস্থা ছিল- মোটা দাগে দেখতে হবে বাংলাদেশে তারা খারাপ অবস্থায় আছে কি না। একইসঙ্গে তাদের প্রত্যাশা যেন বেড়ে না যায় সেদিকে আমাদের খেয়াল রাখা উচিৎ বলে মন্তব্য করেন শরাণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. রাহমান নাসির উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, স্থানীয়দের আয় কমে যাচ্ছে কারণ স্থানীয় বাজারে রোহিঙ্গারা অল্প মজুরিতে শ্রম বিক্রি করছে, তারা ক্রমান্বয়ে জব-মার্কেট দখল করে নিচ্ছে।

অথচ শুরুর দিকে রোহিঙ্গাদের প্রতি স্থানীয়রাই সব করেছে। কিন্তু ধীরে ধীরে স্থানীয়দের দুর্দশার জন্যও তারা রোহিঙ্গাদের ব্যাপক উপস্থিতি দায়ী বলছেন তারা। এসব কারণে চাপা ক্ষোভ রয়েছে স্থানীয়দের ভেতরে, বলেন রাহমান নাসির উদ্দিন।

সারাবাংলা/জেএ/এমআই

রোহিঙ্গা

বিজ্ঞাপন

রিশাদ-জাহানদাদে কুপোকাত সিলেট
৭ জানুয়ারি ২০২৫ ২০:২১

আরো

সম্পর্কিত খবর