তারুণ্যের বাতিঘর বুদ্ধিজীবী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
২৩ জুন ২০২৪ ১৪:৩৩ | আপডেট: ২৪ জুন ২০২৪ ১৪:৩৫
১৯৩৬ সালের ২৩ জুন জন্মগ্রহণ করেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। এ তারিখ বিবেচনায় ২০২৪-এর ২৩ জুন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ৮৯তম জন্মবার্ষিকী। ৮৯তম জন্মদিন। তিনি আমাদের শিক্ষক। জাতিরও শিক্ষক বটে। কলম তার নিত্যযন্ত্রণা সঙ্গী। বিষয় বহুবিধ। তিনি লিখেছেন অবিরাম। এখনো লিখছেন। একটি পরিবর্তন; এবং সুষম পরিবর্তন তার লেখা ও সৃষ্টির মাঝে আছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। অসংখ্য তার সৃষ্টিকর্ম। একশর ওপরে গ্রন্থ রচনা করেছেন। প্রতিটি বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন খোলামেলা। রাজনৈতিক কথাও তিনি বলেছেন অরাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে, যাতে পক্ষপাতদুষ্ট না হয়ে পড়ে সেসব কথা। তার ভাবনার সমগ্রতা সম্ভবত মধ্যবিত্তকে নিয়েই। কারণ তিনি নিজেও মধ্যবিত্ত। মধ্যবিত্তের শিক্ষা, বাজনীতি এবং অর্থনীতি কী হবে, কী হওয়া উচিত নে বিষয়ে তার নিজস্ব ব্যবস্থাপত্র আছে। যারা তাকে পড়েছেন, তারা জানেন- তিনি লেখাটাকে শুধু আনন্দের বিষয়বস্তু করেননি। বরং তার প্রতিটি দেখাই একটি সুস্থ সুন্দর জীবনের কথা বলতে চেয়েছে। লিখেছেন সাহিত্য, শিল্প, সমাজ, সংস্কৃতি, শিক্ষা ও রাজনীতি নিয়ে। নতুন-পুরনো সবকিছুতে তার আগ্রহ রূপান্তরপিয়াসী। হস্তান্তরে তার বিশ্বাস নেই। রূপের নিজস্বতা আছে। অরূপের আছে অমৃত্তিকাময় কল্পচিন্তা। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী কণের পক্ষে তথা যার একটি অবয়স আছে, অস্তিত্ব আছে। যাকে সামনে রেখে বক্তব্যকে ছেড়ে দেয়া যায়, তার পক্ষে। দিনি মৃত্তিকানগ্ন মানুষের কথা বলতে চান সব সময়ই অরূপের সাধনা তার নেই। যে জন্য কল্পনাবসত কথা তার শিল্পচিন্তায় অনুপস্থিত। শুধু একজন শিক্ষক হিসেবেও তিনি কাটিয়ে দিতে পারতেন তার জীবন। কিন্তু দেশ, জাতি ও প্রতিবেশের প্রতি তিনি দায় অনুভব করেছেন। ফলে লিখেছেন এদের নিয়েই। শেখায় সমীক্ষা হয়েছে জীবন ও সমাজ। স্বাধীনতা শব্দটাকে বড় ভালোবাসেন তিনি, কিন্তু স্বাধীনতার পূর্ণতা বিঘ্ন হলে তিনি সেখানে উচিত কথাটা বলেছেন কোনো দ্বিধা ছাড়াই। উচিত কথায় গোস্বা করা মানুষের অভাব নেই এ দেশে। কিন্তু কে বা কারা বেজার হলেন এ নিয়ে তিনি ভাবিত নন। একটি মাটির ঠিক সঠিক উৎস কোনটি, সেটিকে তিনি খুঁজে বের করতে প্রচেষ্ট হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, রোকেয়া, জসীমউদদীন, জীবনানন্দ যেমন তার আলোচনায় এসেছেন, তেমনই আলোচ্য হয়েছেন শেকসপিয়র, এলিয়ট, ওয়ার্ডন ওয়ার্থ, ইয়েটস, অরওয়েল প্রমুখ। নমাজ ও সাহিত্য তার প্রিয় বিষয় এবং সেখানে অগ্রাধিকার পেয়েছে দার্শনিক তত্ত্ব। সেই যে ‘অন্বেষণ’ (১৯৬৪) দিয়ে শুরু করেছিলেন যাত্রা, সে যাত্রাপথ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে কাথাও নেই। একটুও। ২০২৩ সালে এসে লিখলেন ‘মুক্তি কত দূরে’। সম্পাদনা, শিক্ষকতা, মিছিল, মিটিং, সেমিনার এসবই চলেছে সমানতালে। বৃদ্ধিবৃত্তিক একটি সারস্বত সমাজ বিনির্মাণে তার কর্মপ্রয়াস। তিনি কখনো একা, কখনো সবাইকে নিয়েই হেঁটেছেন। হাঁটেন। কিন্তু থেমে যাওয়াটা আর সত্তার বাইরে। ঔপনিবেশিক রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসা বাঙালি দুইবার স্বাধীন হয়েছে, ১৯৪৭-এ একবার, ১৯৭১-এ আরেকবার। উভয় স্বাধীনতার তিনি প্রত্যক্ষদর্শী। পরবর্তী সময়ে এই উভয় স্বাধীনতা নিয়েই তিনি বিস্তর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। হিসাব করেছেন কী পাইনি, কী পেয়েছি। পাইনি কেন, ভারত বিশদ ব্যাখ্যা আছে তার লেখায়। কী কী পেয়েছি সেসবের বিবরণও নাতিদীর্ঘ নয়। যেখক, শিক্ষক, সম্পাদক এই ত্রিসভায় কোনো বিরোধ আছে কি? কোন পরিচয়কে বড় করে দেখেন? এসব প্রকার প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, ‘আমি শিক্ষক, লেখক ও সম্পাদক- তিন ভূমিকাতেই দায়িত্ব পালন করেছি। কিন্তু এই তিনের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা ছিল না, বিরোধ তো নয়ই। আসনে তিনটি মিলিয়েই একটি জীবন।… ভিন ক্ষেত্রেই আন্তরিক ছিলাম। তবে নিজেকে আমি মূলত একজন লেখক হিসেবেই দেখি। শিক্ষকতা আমার পেশা। কিন্তু আমি সাহিত্যেরই শিক্ষক ছিলাম। আর পত্রিকা সম্পাদনা আমার সাহিত্যচর্চারই অংশ’। [দৈনিক প্রথম আলো, ২২ জুন ২০২২।। সমাজনুন্ত্রী সিরাজুল ল ইসলাম চৌধুরী শ্রেণিদ্বন্দের প্রশ্নে বারবার মুক্তি কামনা করেছেন কৃষক ও শ্রমিকের। একটি বৈষম্যহীন, সাম্যবাদী সমাজ তার কাম্য। কিন্তু গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করেছেন অসাম্য, শোষণ, মহাজনি অত্যাচার, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ফোঁপর দালালির পাঁক থেকে এ জাতির যেন মুক্তি নেই। ফার্সি বণিক শ্রেণির সর্বত্র উত্থানকে তিনি মনে করেন, সমাজের ভেতরে অর্থনৈতিক বৈষম্য তৈরি করার মূল কারণ। পুজিবাদ সমাজকে পীড়ন করে। পুজিবাদ সমাজকে কখনো জেগে উঠতে সহায়তা করে না: কেবল অন্ধ প্রতিযোগিতায় উদ্বুদ্ধ করে। এই পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে তিনি কথা বলেন। শিরোনাম দিয়েছেন, সেসবের ভেতরেও রয়েছে বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর। সবল কিন্তু আকর্ষণীয়। অভিনব তো বটেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাঠকের আগ্রহও বাড়ে কেবল শিরোনাম দেখেই। অবশ্যই নামসর্বস্ব বই তিনি লেখেননি সে কথা তো আমরা জানি। কিছু বইয়ের নাম উল্লেখ করতে পারি- নিবাতাম গৃহী (১৯৭৪), কুমুব বন্ধন (১৯৭৯), উনিশ শতকের বাংলা গদ্যের সামাজিক ব্যাকরণ (১৯৮৩), কেউ বলে বৃদ্ধ, কেউ বলে নদী (১৯৯১), ভয় পেয়ো না বেঁচে আছি (১৯৯৫), বন্ধ করো না পাখা (২০০৩), হস্তান্তর নয়, রূপান্তর চাই (২০০৭), দীক্ষ দীক্ষার খবরাখবর (২০১১), জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি (২০১৫), পিলার হুকুম (২০১৭), বাংলা সাহিত্য ও বাচলল্ট মধ্যবিত্ত (২০১৭), সময় বহিরা যায় (২০১৯), জাতীয়তাবাদের উদ্বিগ্ন হৃদয় (২০২২) ইত্যাদি। পাপপুণ্যের ঐহিকতা কিংবা পারলৌকিতা নির্ভর সমাদৃত সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এর গ্রন্থসমূহ যেন মানুষের ভেতরে যে নিয়তিবাদ প্রকট হয়ে ওঠে, নে নিয়তিনির্ভর জনচিন্তা থেকে শিক্ষিত মানুষকে মুক্ত করতে চান। যেখানে অবক্ষয়, অপচয় অপশক্তি ব্যাপক রূপ লাভ করেছে, সেখানে অধ্যাপক চৌধুরী লড়াকু সৈনিকের মতো কথা বলেন, থাকেন সবার আগে। আয়োজনের আগিদটাকে বড় করে দেখেন। পৃথিবীব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তি যেভাবে প্রলোভনের কাঠিন্সজেন্স দিয়ে তরুণদের প্রতিনিয়ত আকর্ষণ করছে, তিনি এসবের বিরুদ্ধে কথা বলেন। দেশপ্রেম যদি থাকে, সে পরধনলোভী হবে না কখনো, হবে না সাম্প্রদায়িক এ বিশ্বাসকে তিনি জোর দিয়েই প্রচার করেন। তার যুক্তিমনস্ক মন সব সময়ই একটি প্রগতিবাদী সমাজকেই প্রতিষ্ঠা দিতে চায়। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী অবশ্যই একজন ফ্রিথিংকার। তিনি বৈশ্বিক, বৈষয়িক নন। আবার অবশ্যই ঐহিক ভাবে তিনি দেন। জীবন ও জীবিকার মাঝে যে দূরত্ব, এ দূরত্ব নিরসনে তিনি সাহিত্যের ভূমিকাকে স্পষ্ট করতে চান। কারণ শাস্ত্র বিদ্যা সামাজিক মানুষ ভাগ্যের পরিবর্তনে, জাতিগত পরিবর্তনে আন্তশক্তির উদ্বোধন করতে পারে না। তারা ভীকু। তাদের পথসীমা সংকীর্ণ। স্বপ্রতিষ্ঠ চেতনাবহ্নিকে যারা জানাতে সামর্থ্য রাখেন- তাদের নিয়ে জুনাব চৌধুরী সমাজ ও সভ্যভার সৌধ নির্মাণ করতে আগ্রহী। এখানে অবশ্যই পাঠ্যানুরাগী মানুষ থাকবে। মুক্তচিন্তার সঙ্গে পরিশীলন হবে গুণের। কদর হবে শিল্পের, মাধুর্যের। ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থ কখনোই জাতীয় স্বার্থের কাছে বড় হবে না এবং সাহিত্য হবে না সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পকে জাগিয়ে দেয়ার অস্ত্র, যা ইতিপূর্বে বড় লেখকদের ক্ষেত্রে হরহামেশাই ঘটেছে। আমাদের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চেতনায় অখণ্ড একটি পরিচয় বিদ্যমান, তা হবো- হিন্দু-মুসলমান উভয়ই আমরা আদিগত পরিচয়ে এই পরিচয় পরিধিকে প্রতিষ্ঠা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন অসংখ্য গুণী লেখক। তাতে কষ্ট আছে; আবার এ শিক্ষাও আছে যে, কীভাবে নেপথ্যে থেকে নিজেদের মুক্ত রাখা যায়। পরনির্ভরশীলতা কাটেনি। কলোনিয়াল সুদু এখনো আমাদের তাড়া করে বেড়ায়- এটি তো সভা। যে জন্য আমাদের ভেতরে-বাইরে হতাশা, হতাশার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে থেকে বেরোলেও আমাদের অনাকাঙ্ক্ষিত নৈরাজ্য আর শ্রীতি । তিনি বিশ্বাস করেন- পাঠের সংস্কৃতি যখন বাড়বে, তখনই কেবল জানচৈতন্যে নতুন জাগরণ তৈরি হবে। এই জাগরণ মঞ্চে থাকবে ভরুণরাই। আাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে একটি আত্মপ্রত্যয়ী, আত্ববিশ্বাসী প্রজন্ম জন্মলাভ করবে। তারা এগোবে। সঙ্গে নেবে অন্যদেরও। একা নয় কোনোভাবেই। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে, নতুন বিশ্বাস ও সাধনার মূলমন্ত্রে এরা দীক্ষিত হবে। সংস্কৃতিমান হয়ে ওঠার সদ্য প্রতিযোগিতায় এরা সর্তক থাকবে। প্রলুদ্ধ পুঁজিকে এরা করবে ঘৃণা- অধ্যাপক চৌধুরী তার সাহিত্য সাধনায় এ সিদ্ধান্তকেই বারবার উচ্চারণ করেছেন। ইঙ্গিত দিয়েছেন সেই। পরিবর্তনমুখী সমাজ বিপ্লবের, যার মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার পরিপূরণ ঘটবে। জনগণের মুক্তির সংগ্রামের স্বার্থেই আমাদের সময়ের অন্যতম প্রধান লড়াকু বুদ্ধিজীবী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর আরও দীর্ঘ জীবন কামনা করি। তাকে জানাই লড়াকু অভিনন্দন ও শ্রদ্ধা তার ৮৯তম জন্মদিনে।
সারাবাংলা/এসবিডিই