লেখক ও গবেষক আহমদ মমতাজ স্যার এক অনন্য বাতিঘর
১০ মে ২০২৩ ১৬:৩৩
কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন, “আমরা জানি একদিন মরে যাব এই জন্যে পৃথিবীটাকে এত সুন্দর লাগে যদি জানতাম আমাদের মৃত্যু নেই তাহলে পৃথিবীটা কখনওই এত সুন্দর লাগতো না”। শেখ সাদি বলেছিলেন,“এমনভাবে জীবনযাপন করো যেন কখনও মরতে হবে না, আবার এমনভাবে মরে যাও যেন কখননো বেঁচেই ছিলে না”। উক্তিগুলো আমার খুব প্রিয়।
সত্যি মানুষের জীবনটা এমন হওয়া উচিত, যেন কখনও মরতে না হয়। মানুষ তার সৎকর্মের মধ্যে বেঁচে থাকেন। মরে গেলেও যেন মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকেন। সবাই যেন বলে, আহা, তিনি একজন মহৎ ও পরোপকারী মানুষ ছিলেন। আমার কাছে মনে হয়, মৃত্যু মাত্রই আমরা জন্মি। সমুদ্রের পানে উড়ে যাওয়া পরিযায়ী পাখির মতো, এই এলো বুঝি এই চলে গেল। মাঝখানে ডানা মেলে উড়ে যাওয়া ক্ষণিক সময়টুকু। সময়ের সমুদ্রের মাঝে আমাদের বসবাস অথচ জীবনটা যে সমুদ্রের ঢেউয়ের জলরাশির মতো, শরতের ঝরে পড়া শিউলি ফুলের মতো, হেমন্তে কৃষকের কাঁধে নৃত্য করা সোনালি ধানের গোছা থেকে ঝরে পড়া ফসলের মতো। আহা আমরা অনুভব করতে পারি না। মানুষের জীবনটা যেন এক শস্যক্ষেত্র। কবি বোধহয় এজন্য বলেছিলেন, “যে জীবন ফড়িংয়ের দোয়েলের মানুষের সাথে তায় হয় নাকো দেখা”। আসলে মানুষ তার কর্মের মাধ্যমে বেঁচে থাকেন হাজার বছর। সৃজনশীল ও গবেষণাধর্মী এবং ইতিহাস নিয়ে যিনি প্রতিনিয়ত নাড়াচাড়া করেছেন গবেষণা করেছেন নিজের শিকড় নিয়ে সমুদ্রের তলদেশ থেকে যেভাবে ডুবুরিরা হীরা, মানিক জহরত মণি মুক্তা কুড়িয়ে আনেন ঠিক সেভাবে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সরেজমিনে গিয়ে ইতিহাসের তথ্যসংগ্রহ করেছেন তা আবার গবেষণা করে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। ইতিহাসের পাতায় চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন ইতিহাসজ্ঞ, লেখক ও গবেষক, বাংলা একাডেমির সহকারী পরিচালক প্রয়াত আহমদ মমতাজ স্যার।
মানুষের মৃত্যু হয় কিন্তু স্মৃতির মৃত্যু হয় না। তা ফিরে আসে বারবার মনকে নাড়া দিয়ে যায়, তেমনই একজন সত্যিকারের সৎ বিনয়ী ও পরোপকারী লেখক গবেষক মমতাজ স্যার। যার গবেষণার জিয়নকাঠির আলো প্রদীপ শিখার মতো দীপ্তিমান হয়ে আলো ছড়াচ্ছে সমগ্র বাংলাদেশে।
মমতাজ উদ্দিন ১৯৬০ সালে ২০ জুন চট্টগ্রামের মীরসরাই উপজেলার ১নং করেরহাট ইউনিয়নের পশ্চিম অলিনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আবদুল বারি ও মা আমেনা খাতুন। আহমদ মমতাজ নামে পরিচিত। তিনি চট্টগ্রাম কলেজ থেকে বাংলায় অনার্স এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। আহমদ মমতাজ স্যার কর্মজীবন শুরু করেন শিক্ষক হিসেবে। পরবর্তীতে একটি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত ছিলেন। নব্বই দশকের দিকে তিনি সাংবাদিকতা পেশায় জড়িয়ে পড়েন। ১৯৯২ সালের দিকে ঢাকায় মুদ্রণ ও প্রকাশনর সঙ্গে যুক্ত হন ২০১৩ সালে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিতে যোগদান এবং পরবর্তীতে বাংলা একাডেমির লোকজ সংস্কৃতি প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে নিবিড় গবেষণা কর্মে নিয়োজিত থাকেন বাংলাপিডিয়া, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষা প্রকল্প ৯ম খ-, ২০১৪ সালে বাংলা একাডেমিতে সহকারী পরিচালক পদমর্যাদায় যোগদান করেন। চারদশক ধরে সাহিত্যচর্চা, গবেষণা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড এবং প্রবন্ধ, গল্প, ইতিহাস, ঐতিহ্যবিষয়ক অনুসন্ধানীমূলক অসংখ্য রচনা ও সম্পাদনা করেন কীর্তিমান গবেষক মমতাজ স্যার।
২০০৯ সালে আহমদ মমতাজ স্যারের সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় চট্টগ্রাম সমিতি ভবনে। স্যারের সাথে প্রথম পরিচয়েই ভালো লাগল। প্রথম যখন জানলাম তিনি একাধারে লেখক, গবেষক এবং চট্টগ্রাম সমিতির চট্টলশিখার সম্পাদক। ব্যাংকার পরিচয় দেওয়ার পর খুব উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন। তিনি আমাকে বললেন, রশীদ এনাম আমিও কিন্তু এক সময় ব্যাংকার ছিলাম পরবর্তীতে গবেষণা ও লেখালেখিতে জড়িয়ে পড়ি। চট্টগ্রাম সমিতিতে ২০০৯ সাল থেকে কাজ শুরু করি শহিদ ভাইয়ের মাধ্যমে, ২০১০ সালে চট্টগ্রাম সমিতিতে জীবন সদস্য হলাম। সে সময় থেকে মেজবান ও মিলনমেলায় উপকমিটিতে আমাকে রাখতেন। মমতাজ স্যার আমাকে বলতেন রশীদ তুমি যেহেতু লেখালেখি করো আমার সাথে থাকবে চট্টল শিখায় কাজ করতে হবে। স্যারের উৎসাহ পেয়ে ভালো লাগল।
এরপর মমতাজ স্যারের সাথে কখনও প্রেসে, কখনও চট্টগ্রাম সমিতির অফিসে কখনও বাংলা একাডেমিতে, কখনওবা এশিয়াটিক সোসাইটির অনুষ্ঠানে, লেখালিখি, এডিট, লেখা টাইপ, তথ্যসংগ্রহ করা এসব কাজে সময় দিতাম। স্যারের সাথে যতক্ষণ থাকতাম নতুন কিছু শিখতাম। বিশেষ করে লেখালেখি নিয়ে পরামর্শ দিতেন। স্যার খুব বিনয়ী ও মৃদুভাষী, মুচকি হাসি দিয়ে বলতেন, রশীদ এটা এভাবে হবে না এভাবে হবে ভুল বানান খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বের করে শুদ্ধ করতেন। স্যার ছিলেন আমার একজন শিক্ষক ও লেখার জন্য শুদ্ধতম অনুপ্রেরণাকারীদের একজন। মমতাজ স্যারের যে বিষয়টা আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছে তা হলো তার ধৈর্য। সারাদিন বাংলা একাডেমিতে কাজ করে নিবেদিতপ্রাণ হয়ে শিকড়ের টানে ছুটে আসতেন চট্টগ্রাম সমিতি ভবনে। মেজবান ও মিলনমেলার ম্যাগাজিন বের করতে হবে খুব তাড়া চট্টল শিখার জন্য। আমি অফিস শেষ করে মাঝে মাঝে চট্টগ্রাম ভবনে যেতাম মমতাজ স্যারের কাছ থেকে শেখার জন্য।
২০১২ সালে চট্টগ্রাম সমিতির শতবর্ষী উদ্যাপনে সবচেয়ে প্রশংসনীয় কাজ হয়েছিল চট্টল সাহিত্য সম্মিলন করা। চট্টগ্রামের লেখক ও কবি সাহিত্যিকদের একত্রিত করে সম্মাননা দেওয়া। বিশাল কর্মযজ্ঞের জন্য মমতাজ স্যার কালের সাক্ষী হয়ে থাকবেন।
এক সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম বিএমএ ভবনে লেজার ভিশনের প্রেসে জেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা সমিতির প্রাক্তন দপ্তর সম্পাদক শহিদ ভাই, নাজিমসহ আমরা চারজন মিলে প্রেসে রাত তিনটা পর্যন্ত কাজ করলাম। আহমদ মমতাজ স্যারের কাজ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখলাম, স্যার যখন কাজ করতেন ডানে বামে তাকাতেন না। একধ্যানে টুক টুক করে লিখতেন, এডিট করতেন, সংযোজন বিয়োজন। সেদিন কাজ করতে করতে কখন যে রাত তিনটা বেজে গেল টেরও পেলাম না। কাঁধে বইয়ের থলি নিয়ে রিকশায় চেপে বসলেন, আমাকে বললেন রশীদ আমার সাথে চল তোমাকে পল্টন নামিয়ে দিব।
পরদিন স্যার বললেন, রশীদ তোমার একটা লেখা চট্টল শিখার জন্য দিও। আমি “সুবর্ণ এক্সপ্রেস” নামে একটা ছোটোগল্প দিলাম। স্যার লেখাটা পড়ে খুশি হলেন। লেখাটি তিনি যত্ন করে এডিট করে চট্টল শিখা ম্যাগাজিনে ছাপালেন। এজন্য সমিতির একজন নির্বাহী পরিষদের সদস্যর কাছ থেকে আহমদ মমতাজ স্যারকে কথা শুনতে হলো। কেন আমার লেখা ছাপাল। স্যার খুব অভিমান করলেন, কষ্টও পেয়েছেন। আমাকে বলল, রশীদ আমি ম্যাগাজিনের সম্পাদক; কি লেখা যাবে না যাবে সেটা আমার ব্যাপার। অনেকে আমার উপর ছড়ি ঘোরাতে চায়। এসব করলে আমি কীভাবে কাজ করব। খুব অপমানিতবোধ করলেন মমতাজ স্যার। আহা ! যে কি না দু কলম লেখার যোগ্যতা নেই, আমড়া কাঠের ঢেঁকি সে-ও মাতব্বরি করে বেড়ায়।
স্যার পরবর্তী বছর অভিমান করে ম্যাগাজিনের সম্পাদনায় আসলেন না। এমনকি মেজবানেও যায়নি। আহমদ মমতাজ স্যারের জন্য যে কাজটি আমাকে মুগ্ধ করেছে ১৯১২ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত শতবর্ষে চট্টগ্রাম সমিতির ম্যাগাজিন ও সমিতির ইতিহাস রচনা। আহা এই বইটি রচনা করতে গিয়ে কলকাতা থেকে শুরু করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। শুধু তাই নয় চট্টগ্রাম সমিতি ভবনে নিজ পরিকল্পনায় গড়েছেন চমৎকার একটি পাঠাগার। প্রতিবছর জানুয়ারি মাস এলে স্যারের জন্য ডায়েরি, ক্যালেন্ডার নিয়ে যেতাম বাংলা একাডেমিতে। অনেক খুশি হতেন। কাজের ফাঁকে গল্প করতেন, চা বিস্কুট খেতে খেতে আড্ডা হতো। আবার কাজে ডুব দিতেন। সেবার ২০১৯ সালে আমাকে উৎসাহিত করলেন বাংলা একাডেমির সদস্য হওয়ার জন্য। স্যারের কথামতো ফরম নিয়ে পূরণ করে জমা দিলাম। স্যার সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিলেন আমার ‘চাটগাঁইয়া মেজ্জান’-র উপর বই করছি জেনে। নিজেও লেখা দিলেন চাটগাঁইয়া মেজ্জান বইয়ের জন্য। বইটি দেখে এত খুশি হয়েছিলেন আমার মনে হচ্ছিল যেন স্যার নিজে করেছেন। প্রশংসা করে বললেন, অনেক সুন্দর এবং চমৎকার একটা কাজ করলে রশীদ! আমি মুগ্ধ তোমার মাথায় এত সুন্দর আইডিয়া কীভাবে এলো? আমি আনন্দিত। ভালো করেছ। আমি হেসে বললাম স্যার আমি আপনার শিষ্য আপনার দোয়া নিয়ে কাজ করেছি সে জন্য ভালো হয়েছে।
স্যার অনেক দোয়া করলেন। যেদিন চাটগাঁইয়া মেজ্জান বইটি স্যারের হাতে তুলে দিচ্ছিলাম সেদিন স্যারের জীবনসঙ্গিনী লেখক রাইহান নাসরিন আপাও ছিলেন বাংলা একাডেমিতে। আপার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন, ও রশীদ এনাম ব্যাংকার কিন্তু সে ভালো লিখে। আমার সাথে চট্টল শিখায় কাজ করেছে।
স্যারের সাথে শেষ দেখা হয়েছিল ২০২১ এর এক বাসন্তি গোধূলিবেলায় একুশের বইমেলায়। রাইহান, নাসরিন আপা ও তাদের সাথে ছোটো ভাতিজা ভাতিজিরাও ছিল, স্যার বাদাম চিবুচ্ছেন আর বই কিনছেন মাঝে মাঝে বইয়ের পাতা উলটিয়ে দেখছেন। হঠাৎ পেছন থেকে ডাক- রশীদ এনাম তোমার বইয়ের কী অবস্থা কেমন সাড়া পাচ্ছ? বললাম, স্যার ভালো। খুব ভালো লাগছে এজন্য যে বাংলাদেশে মেজবানের উপর আমি প্রথম গ্রন্থ করলাম এটা আমার জন্য আনন্দের। মমতাজ স্যার ও নাসরিন আপার যৌথভাবে লেখা “শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু” বইটি সংগ্রহ করলাম । এত চমৎকার লিখেছেন সত্যি অনবদ্য এক জীবন্ত ইতিহাস। স্যারের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৩০টিরও বেশি। আরও প্রায় ২০ প্রকাশের অপেক্ষায় আছে।
বইমেলার পরে স্যারের সাথে বেশ কিছুদিন যোগাযোগ হয়নি। একদিন ফোনে জানলাম স্যার খুব অসুস্থ। ওপাশ থেকে নাসরিন আপা বলল, রশীদ তোমার স্যার করোনা পজিটিভ হাসপাতালে ভর্তি, দোয়া করিও বাবা। শুনে মন খারাপ হলো। মে মাসের ৯ তারিখ ২০২১ সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে দেখলাম আহমদ মমতাজ স্যার না ফেরার দেশে চলে গেছেন। আকাশ যেন মাথায় ভেঙে পড়ল। আমাদের চট্টলার বাতিঘর নিভে গেল। হু হু করে কাঁদতে লাগলাম। গুণী মানুষগুলো যদি এভাবে একে এক চলে যায়, আমরা কার কাছ থেকে জ্ঞান আহরণ করব। আমাদের ইতিহাসের পিপাসা কে নিবারিত করবে।
লেখালেখির ব্যাপারে যার কাছ থেকে পরামর্শ অনুপ্রেরণা উৎসাহ পেতাম খ্যাতিমান ইতিহাসজ্ঞ মমতাজ স্যার নেই ভাবতে কষ্ট হচ্ছে। লেখালেখির জন্য স্যারের মতো আর কেউ উৎসাহ বা অনুপ্রেরণা দিবে না। কত স্বপ্ন ছিল বুকের ভিতর আমার একটা লোকজ সংস্কৃতির বই হবে স্যার পান্ডুলিপি দেখে ভূমিকা লিখে দিবেন। আহা এত তাড়াতাড়ি কেন চলে গেলেন মমতাজ স্যার। যে মানুষটি স্বপ্নের ফেরিওয়ালার মতো ইতিহাস ফেরি করে বেড়াতেন যার জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে ছিল ইতিহাস, গবেষণা লেখালেখি নিজের শিকড় নিয়ে কাজ করার প্রবল বাসনা সবকিছু যেন থমকে গেল।
আমার অনুভূতিতে মমতাজ স্যার ছিলেন, একজন সদালাপী হাস্যোজ্জ্বল নিরহংকারী প্রাণবন্ত এক ভালোমানুষের মডেল। যার পা থেকে আপাদমস্তক পর্যন্ত প্রজ্ঞা ও পান্ডিত্য এক জীবন্ত ইতিহাসের কারিগর। যিনি প্রতিনিয়ত বইয়ের দুনিয়ায় ডুবে থাকতে ভালোবাসতেন লিখতে ভালোবাসতেন। অনেক লেখক সাংবাদিক কবি সৃষ্টি করার কারিগর । মমতাজ স্যার শিশুদের মতো খুব সহজে মানুষের সাথে মিশতেন। শিশুদের খুব ভালোবাসতেন। বাংলা একাডেমিতে তার সহকর্মী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কাছে ছিলেন বেশ জনপ্রিয় সকলে তাকে পছন্দ করতেন, সম্মান করতেন। কখনও কারো সাথে কটুবাক্য বলতেন না। স্পষ্টবাদী মানুষটি চোখের সামনে অন্যায় দেখলে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতেন। সাড়ে তিন হাত মাটির কুঠুরিতে চলে গেলে বুঝা যায়, মানুষের ভালোবাসা, ভালো কর্মটি যেন জলজোছনার মতো জলছবি হয়ে ভেসে বেড়ায় মানুষের হৃদয়ে। জানি না আমার প্রিয় গুরুজি, প্রিয় আহমদ মমতাজ স্যার মাটির কুঠুরিতে কেমন আছেন। বিশ্বাস হয় না তিনি বেঁচে নেই।
আমার কাছে আজও মনে হয় তিনি কাঁধে বইয়ের ব্যাগ ঝুলিয়ে মাথায় ক্যাপ পরে বাংলা একাডেমির মাঠে প্রকৃতি বিছিয়ে দেওয়া সবুজ গালিচায় পায়চারি করছেন। বাংলা একাডেমির দোতলায় কাঠের চেয়ারে বসে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে লিখছেন। চোখের সামনে যেন ভেসে ওঠে স্যারের হাসিমাখা প্রিয় মুখখানি। ডাক দিয়ে বলছেন, রশীদ এনাম কী পড়ছ, কী লিখতেছ, আগামী বইমেলায় কি বই করছ? তন্দ্রাবিলাসে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি- মমতাজ স্যার যেন বিড়বিড় করে আমার প্রিয় লেখক আহমদ ছফার কবিতার চরণগুলি পাঠ করছেন-
“আমার কথা কইবে পাখি করুণ করুণ ভাষে
আমার দুঃখ রইবে লেখা শিশির ভেজা ঘাসে
আমার গান গাইবে দুঃখে পথ হারানো হাওয়া
আমার নাম বলবে মুখে মেঘের আসা-যাওয়া
ইন্দ্রধনু লিখবে লিখন কেমন ভালোবাসে
দীঘল নদী করবে রোদন সমাধিটির পাশে।”
স্যারের একজন ভক্ত-পাঠক এবং চট্টগ্রাম সমিতির জীবন সদস্য হিসেবে আমার একটাই চাওয়া- ঢাকাস্থ চট্টগ্রাম সমিতিকে প্রিয় মমতাজ স্যার অনেক দিয়েছেন যার ঋণ কখনও টাকা দিয়ে পরিশোধ করতে পারার কথা না। এবার তাকে দেওয়ার পালা, তার স্মৃতি ধরে রাখার আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। চট্টগ্রাম সমিতি পরিবারের কাছে আমার সবিনয় নিবেদন, চট্টগ্রাম সমিতির বর্তমান পাঠাগারটি আহমদ মমতাজ স্যারের নামে নামকরণ করা হোক। চট্টগ্রামে মমতাজ স্যারের নামে একটি পাঠাগার স্থাপন করার জোর দাবি জানাই। স্যারের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখক: লেখক ও প্রাবন্ধিক
সারাবাংলা/এসবিডিই
রশীদ এনাম লেখক ও গবেষক আহমদ মমতাজ স্যার এক অনন্য বাতিঘর সংস্কৃতি সাহিত্য