Saturday 04 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ভ্যাম্পায়ারের গলায় ঘণ্টা বাঁধার চ্যালেঞ্জ


২০ এপ্রিল ২০২৩ ১৪:৩৩ | আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০২৩ ১৪:৩৭

মুনাফাভিত্তিক এই সমাজ আমাদের ভাবনাকে এমনভাবে গঠন করে দিয়েছে যে মুনাফার বাইরে আমরা সহজে চিন্তাই করতে পারি না। মহামতী কার্ল মার্কস মন্তব্য করেছিলেন, পুঁজিবাদ আমাদের সামাজিক জীবন ও ব্যক্তিজীবনকে এমনভাবে পাল্টে দেয় যে, তার বাইরে গিয়ে আমরা খুব কম মানুষই ভাবতে পারি। অর্থাৎ পুঁজিবাদের শক্তিমত্তা নিয়ে তিনি ওয়াকিবহাল ছিলেন। সেই শক্তির ধরন কেমন? অবশ্যই নেতিবাচক শক্তি। মার্কস বলছেন, “Capital is dead labour which, vampire-like, lives only by sucking living labour, and lives the more, the more labour it sucks.”

বিজ্ঞাপন

‘পুঁজি’ বইয়ের প্রথম বালামে মার্কস বলছেন, পুঁজি হল রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ার, নিজে নিস্তেজ, কিন্তু সে বেঁচে থাকার রসদ জোগাড় করে জীবন্ত শ্রমকে শোষণের মধ্য দিয়ে। যত বেশি শোষণ, তত বেশি তার আয়ু। শ্রমিক কাজ করলেই কেবল এই শোষণের পথ প্রশস্ত হয়, কিন্তু শ্রমিক যদি কাজ না করে, বিক্রয়যোগ্য সময়টি যদি সে নিজের জন্য ব্যয় করে তাহলে পুঁজিপতি বঞ্চিত হয়। মার্কস আমাদের সতর্ক করে দেন, পুঁজিপতি হল পুঁজিরই ব্যক্তিরূপ। তার আত্মা পুঁজিরই আত্মা।

বিজ্ঞাপন

২০২০ সালে যখন গোটা পৃথিবীতে নয়া করোনা মহামারী ছড়িয়ে পড়ল, তখন বাংলাদেশও আতঙ্কগ্রস্ত হয়, প্রথমত শারীরিক মৃত্যুর ভয়ে, দ্বিতীয়ত অর্থনৈতিক মৃত্যুর ভয়ে। শ্রমিকরা যদি কাজ না করে তাহলে তো পুঁজিপতিদের মৃত্যুঘন্টা বেজে যাবে। নয়া করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর শঙ্কা আধাআধি, কিন্তু শ্রমিক কাজে এসে শ্রম বিক্রি না করলে বিদ্যমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ‘মৃত্যু’ অনিবার্য। আর এই কারণেই তখন দেখা গেল পোশাক শ্রমিকদের কয়েক দফায় অনেকটা জোর করেই গ্রাম থেকে শহরের কারখানায় আনা হল। যখন কার্যত সকল কিছু বন্ধ ছিল, তখন এই শ্রমিকদের কাজে আনানোর ঘটনাটি ছিল চোখে পড়ার মতো। ওটা করা ছাড়া পুঁজিপতিদের সামনে আর কোনো পথও খোলা ছিল না। শ্রমিকবান্ধব রাষ্ট্র না হওয়ায় শ্রমিকরাও বেশিদিন শ্রম বিক্রি না করে বসে থাকার কথাও চিন্তা করতে পারছিলেন না। কাজেই তারা খুব ভালোভাবেই সেসময় করোনা ভাইরাসকে শহর থেকে গ্রামে, গ্রাম থেকে শহরে ছড়িয়ে দিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখেন। আর এর দায় রাষ্ট্র ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায় সহজাতভাবেই এড়িয়ে যায়।

প্রথমে যে শঙ্কা ছিল অনেক মানুষ মারা যাবে, রাস্তায় রাস্তায় মৃতদেহ পড়ে থাকবে, অতোটা খারাপ না হলেও, পরিস্থিতি যে নিয়ন্ত্রণে ছিল না- তা জোর দিয়েই বলা যায়। কারণ সেসময় অনেক বয়স্ক মানুষ ছাড়াও যাদেরই শারীরিক জটিলতা ছিল তারা মারা যান। সরকারি হিসেব আর বেসরকারি হিসেব বলে এক অদ্ভুত ধাঁধার কারণে সঠিক সংখ্যা বলা মুশকিল, তবে বাংলাদেশে ইউরোপের তুলনায় মৃতের সংখ্যা ছিলো অনেক কম। অন্যদিকে, ভারতের কেরালা বা ভিয়েতনামে দুই একজন ছাড়া কেউই মরেনি, কারণ তাদের প্রস্তুতি ছিল। বাংলাদেশে সেই প্রস্তুতি ছিল না বলে মানুষ মরেছে। রাষ্ট্রের সুপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা না থাকায় সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ বাধ্য হয়ে লকডাউন অমান্য করে বাইরে বেরিয়ে আসে শ্রম বিক্রি করতে। তারা রিক্সা, ভ্যান চালাতে শুরু করে, অনেকে ভিক্ষাবৃত্তিও বেছে নেন। অনেক মধ্যবিত্ত শহর ছেড়ে যায়। পরিবারকে পাঠিয়ে দেয় গ্রামে। মধ্যবিত্তের এই সংকট যে দুই বছরে দূর হয়ে আবার আগের স্থিতাবস্থায় ফিরে গেছে তা নয়। বরং পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। মহামারী শেষ হতে না হতেই বিশ্ব পড়ে রুশ-ইউক্রেন ওরফে পশ্চিমা বনাম রাশিয়া যুদ্ধের মুখে। মহামারী আর যুদ্ধ মনে হয় ইতিহাসের যুগলবন্দী ব্যাপার, যা বারবার ফিরে আসে। এ প্রসঙ্গে আলবেয়ার কামুর বিখ্যাত উপন্যাস ‘লা পেস্ত’ বা ‘মারী’ উপন্যাস থেকে কয়েকটি লাইন পড়া যেতে পারে। ১৯৪৭ সালে কামু লিখছেন, “পৃথিবীতে এ পর্যন্ত যতবার যুদ্ধ লেগেছে, প্লেগের মহামারিও বোধহয় ততবারই ঘটেছে। তবুও যুদ্ধ আর মহামারির মুখে মানুষ এখনও প্রতিবারই নতুন করে বিমূঢ় হয় আর নিজেকে অসহায় বোধ করে।” (দেবীপদ ভট্টাচার্যের অনুবাদ)

মহামারী ও যুদ্ধের ভেতর কোনো অন্তর্গত সম্পর্ক নেই, তবে প্রভাব বিস্তারকারী এক জটিল সম্পর্ক তো অবশ্যই রয়েছে। দেখা গেছে, প্রাচীনকাল থেকে এখনও পর্যন্ত যুদ্ধকালে সেনাবাহিনী ও স্থানীয় বাসিন্দারা যেভাবে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় দল বেঁধে নড়াচড়া করে, স্থানান্তরিত হয়, তাতে সংক্রামক রোগ-জীবাণু দ্রুত বিস্তার লাভ করে এবং সেটি মহামারীর আকার ধারণ করে। আবার উল্টোটাও হয়, মহামারীতে যে আর্থসামাজিক অবস্থা দাঁড়ায় সেটি যুদ্ধ শুরু করতে ইন্ধন যোগায়। খ্রিস্টপূর্ব এথেন্সের প্লেগ থেকে শুরু করে এর পরবর্তী সময়ে এন্টোনাইন প্লেগ, কালা জ্বর, কলেরা, টাইফয়েড, স্মল পক্স, হলুদ জ্বর, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি রোগগুলো যখন মহামারীর রূপ ধারণ করেছে তখন আগেপিছে বা সেই সময়ে যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই ছিল। কামু শিল্পীর চোখে এই দুটি বিপর্যয়ের সমাপতনকে দেখেছেন, তবে বৈজ্ঞানিক ও ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি পেতে চাইলে ওল্টানো যেতে পারে রেবেকা এম. সিম্যান সম্পাদিত “এপিডেমিকস অ্যান্ড ওয়ার: দ্য ইম্প্যাক্ট অব ডিজিজ অন মেজর কনফ্লিক্টস ইন হিস্টোরি” বইটি। এই বইতে যুদ্ধ ও মহামারীর যুগলবন্দী হওয়ার তৃতীয় আরেকটি কারণের কথাও বলা হয়েছে— সেটি হল, যখন ইচ্ছাকৃতভাবে যুদ্ধের একপক্ষ আরেক পক্ষকে ঘায়েল করার জন্য জীবাণু বোমা ব্যবহার করে।

কারণ যেটাই হোক, এ দফাতেও দেখা গেল মহামারী আর যুদ্ধ এলো প্রায় হাত ধরাধরি করে এবং তাতে নাভিশ্বাস উঠল আম জনতার। কারণ দুনিয়ায় যুদ্ধ শুরু হলে বরাদ্দ চলে যায় সামরিক খাতে, মানবিক খাত থেকেই সেই অর্থ সরানো হয়। বেড়ে যায় তেলের দাম, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য। আন্তর্জাতিক অস্থিরতার প্রভাব পড়ে জাতীয় অর্থনীতিতে। স্থানীয় দুর্নীতি ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অভাব থাকলে জাতীয় অর্থনীতি ধুঁকতে শুরু করে। দেশে ডলারের সংকট দেখা দেয়, এতে করে আমদানি নির্ভর ব্যবসা পড়ে হুমকির মুখে। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে হয় আকাশচুম্বী। এরই ভেতর নীরবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চলে ছাঁটাই প্রক্রিয়া। কম লোকবল দিয়ে কাজ চালিয়ে নিতে পারলে পুঁজিপতিদের তো লাভ দ্বিগুণ। সেই চেষ্টাই তারা করেন। দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বলতে গেলে তলানিতে এসে ঠেকে। গণমাধ্যমেই আমরা দেখতে পাই, একবেলা খাবার কমিয়ে দিয়েছে দরিদ্র জনগোষ্ঠী। খাবারের তালিকা থেকে বাদ যাচ্ছে আমিষ। অনেকে সন্তানকে শহরের স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ভর্তি করাচ্ছেন গ্রামের কমদামী স্কুলে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উপর এ যেন মরার উপর খাড়ার ঘা।

করোনার দাপট কমলে পরিস্থিতি কিছুটা সহনীয় হবে বলে যে আশায় বুক বেঁধেছিল মানুষ, সেই আশার গুড়ে বালি ও পিঁপড়ে। অগোছাল পরিকল্পনার সঙ্গে দুর্নীতি মিলে মানুষের জীবন আরও দুর্বিসহ হয়ে পড়েছে মহামারীর দুই বছর পর। তবে তাতে কি পুঁজির কিছু এল গেলো? সে ঠিকই মনোযোগ দিয়েছে ভ্যাকসিন তৈরি ও বিক্রিতে। হাত সেনিটাইজ করার লিকুইড, সাবান, মুখোশ ইত্যাদির বাজারও ছিল রমরমা। যদিও তাতে কিছুটা ভাটা পড়েছে। কারণ মানুষ করোনা নয়, বর্তমানে বেশি চিন্তিত খাদ্য কেনা নিয়ে। চিকিৎসা ও শিক্ষার মতো বিষয় তো বাদই দিলাম। তারা প্রতিদিনের বেঁচে থাকার সংগ্রাম করতে করতেই হাঁপিয়ে উঠছেন। ‘দিন আনি দিন খাই’ অবস্থা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর। ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার অবকাশ তাদের নেই।

কথায় বলে, যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ। আমরা এমন এক সময়ে এসে পড়েছি, যখন ফেলে আসা দিন তো খারাপ গেছেই, আসছে দিন আরও খারাপ। আমরা ক্রমশ যেন ডিস্টোপিয়াতে প্রবেশ করছি। অনেকটা লার্স ভন ত্রিয়ের নির্মিত ‘এপিডেমিডক’ (১৯৮৭) ছবির মতো। ছবির শেষে যেমন দেখা যায় এক নারীকে সম্মোহন করা হচ্ছে, ধীরে ধীরে তার ভেতর থেকে মহামারীর স্মৃতি বেরিয়ে আসতে থাকে, এমনকি প্লেগের জীবাণু ফুটে উঠতে থাকে তার শরীরে এবং এক পর্যায়ে তীব্র যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে সে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়। ভন ত্রিয়ের এই ছবিতে ইউরোপের মৃত্যুযাত্রাকেই হয় তো চিহ্নিত করেছেন, তবে এই যাত্রায় তিনি যেভাবে সম্মোহনকে যুক্ত করেছেন সেটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কামুর উপন্যাসেও আমরা যেমন প্লেগকে দেখি হিটলারের নাৎসিবাদের সমান্তরাল করে দেখাতে, তেমনি ডেনমার্কের পরিচালক ত্রিয়েরও তার ছবির কাহিনি টেনে নিয়ে যান জার্মানিতে। অর্থাৎ কামু থেকে ত্রিয়ের, প্রত্যেকেই সচেতনভাবে প্লেগ তথা মহামারীকে মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন। মানুষের তৈরি করা বিপর্যয় অজানা কারণে সৃষ্ট মহামারীর চেয়ে কম ভয়ংকর নয়। এবং এই দুই ক্ষেত্রেই মানুষ বড্ড অসহায়। মৃত্যুদর্শন যেন অনিবার্য হয়ে ওঠে তাতে। মৃত্যু অবধারিত, কিন্তু অস্বাভাবিক মৃত্যু কারোই কাম্য নয়।

বর্তমান বিশ্বের দশা জিন্দালাশের মতো। সদ্য মহামারী কাটিয়ে ওঠা ধুঁকতে থাকা বিশ্ব যেভাবে ইউক্রেন ও রাশিয়াকে সামনে রেখে প্রক্সি-ওয়ারে মেতে উঠল, তাতে মনে হয় আমরাও মহামারীর চেয়ে কম কিছু নই। কিংবা পৃথিবীর জন্য আমরা মানুষরাও প্লেগের মতোই। নিজেদের তো ধ্বংস করছিই, পরিবেশকেও ধ্বংস করছি নির্দ্বিধায়। যতটা অবলীলায় আমরা মানুষ হত্যা করছি, ঠিক ততোটা সাবলীল ভঙ্গিতেই পৃথিবীর জল-স্থল-বায়ুকে বিনষ্ট করছি। আর এসব আমরা করছি এক অদৃশ্য সম্মোহনী টানে। এক অপার মোহের ঘোরে হানাহানি, কাড়াকাড়ি করতে করতে আমরা নিজেদের ভবিষ্যৎকে ফেলে দিচ্ছি হুমকির মুখে। ভ্যাম্পায়ারদের কিন্তু সম্মোহনী শক্তি থাকে, এই শক্তির দ্বারা তারা সাধারণ মানুষের রক্ত চোষে। কার্ল মার্কস বর্ণিত ভ্যাম্পায়াররা যে বাস্তবতা তৈরি করে রেখেছে গোটা বিশ্বে, সেটারও কিন্তু প্রবল রকম সম্মোহনী আকর্ষণ রয়েছে। নয় তো পুঁজিবাদের নামে, জাতীয়তাবাদের মতো নানাবিধ ভাবাদর্শের নামে, ধর্মের নামে, বর্ণের নামে এত মানুষ নিজেদের জান কোরবান করে অপরের খুনের দরিয়া রচনা করে কেন? কেন মৃত্যুকে সামনে রেখেও মানুষ অনবরত মুনাফার জপমালা জপতে থাকে, আত্মঘাতী জানার পরও? এসব প্রশ্নের পরও আরও একটি প্রশ্ন থেকে যায়, তা হল— দুনিয়ার বুকে জেঁকে বসা রক্তচোষা এসব ভ্যাম্পায়ারদের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে বা কারা?

সারাবাংলা/এসবিডিই

ঈদসংখ্যা ২০২৩ নিবন্ধ বিধান রিবেরু ভ্যাম্পায়ারের গলায় ঘন্টা বাঁধার চ্যালেঞ্জ সাহিত্য

বিজ্ঞাপন

না ফেরার দেশে অঞ্জনা
৪ জানুয়ারি ২০২৫ ০১:৫৪

এই তাসকিনকে সমীহ করবেন যে কেউ
৪ জানুয়ারি ২০২৫ ০১:৪৭

আরো

সম্পর্কিত খবর