প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদের মৃত্যুবার্ষিকী আজ
১২ আগস্ট ২০২১ ১২:৩৫
হুমায়ুন আজাদ। বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বর নক্ষত্রের নাম। ভাষা নিয়ে যেমন তার রয়েছে বিস্তর গবেষণা, তেমনি রয়েছে শিশুতোষ গ্রন্থ, উপন্যাস, কবিতার বই, গল্পগ্রন্থ, সাক্ষাৎকারমূলক বই, গবেষণাধর্মী বই ইত্যাদি। তাইতো তাকে একাধারে বলা যায়, ভাষাবিজ্ঞানী, ঔপন্যাসিক, সাহিত্যিক, গল্পকার, সমালোচক, গবেষক, কবি ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার। বহুমাত্রিক এই লেখকের মৃত্যুবার্ষিকী আজ।
হুমায়ুন আজাদের জন্ম ১৯৪৭ সালের ২৮ এপ্রিল তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বিক্রমপুরের কামারগাঁওয়ে যা বর্তমানে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলায়। জন্মের সময় তার নাম রাখা হয় হুমায়ুন কবীর যা ১৯৮৮ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর পরিবর্তন করে বর্তমান নাম ধারণ করেন।
ছোটবেলা থেকেই হুমায়ুন আজাদ ছিলেন মেধাবী। ম্যাট্রিকুলেশন শেষে উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকা কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন বাংলা বিভাগে। সেখান থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। এরপর যোগ দেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরবর্তীতে তিনি স্কটল্যান্ডের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৭৮ সালে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
হুমায়ুন আজাদের সাহিত্যচর্চার হাতেখড়ি ছোটবেলাতেই। দৈনিক ইত্তেফাকের শিশুপাতায় শৈশবেই বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় তার। তবে কবিতার মাধ্যমে সাহিত্যচর্চার শুরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ‘সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’ এর মতো কবিতা তাকে পাঠকদের খুব কাছে নিয়ে যায়।
“আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।
নষ্টদের দানবমুঠোতে ধরা পড়বে মানবিক
সব সংঘ-পরিষদ; চলে যাবে, অত্যন্ত উল্লাসে
চ’লে যাবে এই সমাজ-সভ্যতা-সমস্ত দলিল
নষ্টদের অধিকারে ধুয়েমুছে, যে-রকম রাষ্ট্র
আর রাষ্ট্রযন্ত্র দিকে দিকে চলে গেছে নষ্টদের
অধিকারে। চ’লে যাবে শহর বন্দর ধানক্ষেত
কালো মেঘ লাল শাড়ি শাদা চাঁদ পাখির পালক
মন্দির মসজিদ গির্জা সিনেগগ পবিত্র প্যাগোডা।”
হুমায়ুন আজাদ তার লেখায় প্রথার বিরুদ্ধে গিয়ে প্রচলিত সমাজ কাঠামোর কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। অনিয়ম, শোষণের বিরুদ্ধে কথা বলেছে তার কলম। এসবের বিরুদ্ধে পাঠককে সচেতন করার কাজটি করেছেন খুব সহজেই। বাংলা সাহিত্যেও আনতে চেয়েছেন নতুনত্ব। তাই তিনি প্রথাবিরোধী লেখক হিসেবেও পরিচিত।
রাজনৈতিক লেখালেখিও করেছেন হুমায়ুন আজাদ। আশির দশকের শেষের দিকে বাংলাদেশের সমসাময়িক প্রেক্ষাপট ও রাজনীতি নিয়ে কথা বলা শুরু করেন। সাপ্তাহিক ‘খবরের কাগজ’ পত্রিকায় নিবন্ধও লেখেন তিনি। তার প্রকাশিত ‘আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম’ গ্রন্থটি মূলত রাষ্ট্রযন্ত্রের ধারাবাহিক সমালোচনা।
ভাষার ওপর অধিক দখল থাকা এই সাহিত্যিকের ভাষাবিজ্ঞানের বইগুলো বাংলা সাহিত্যের জন্য সম্পদ হয়ে আছে এবং থাকবে। এছাড়াও তার রয়েছে ২২ টি আলোচনা ও প্রবন্ধমূলক গ্রন্থ, ১৩ টি উপন্যাসের বই, ৬ টি সাক্ষাৎকারমূলক বই। জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পর বেশকয়েকটি কাব্যগ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে গুণী এই লেখকের। সবমিলিয়ে তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৭০ টিরও বেশি। তার রচিত কিশোরসাহিত্য ‘আব্বুকে মনে পড়ে’ বইটি ২০০৩ সালে জাপানি ভাষায় অনুদিত হয়েছে।
মেধাবী এই সাহিত্যিক তার সাহিত্যকর্মের জন্য যেমন আলোচিত হয়েছেন, তেমনি হয়েছেন সমালোচিতও। ১৯৯২ সালে গবেষণাধর্মী গ্রন্থ ‘নারী’ সমালোচকদের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। হুমায়ুন আজাদের আলোচিত গবেষণামূলক কাজ হিসেবে স্বীকৃত সে বইটি বাংলাদেশে পাঁচ বছর নিষিদ্ধ ছিল।
হুমায়ুন আজাদের গবেষণার বিষয় ছিলো বাংলা ভাষার সর্বনামীয়করণ। এটি ১৯৮৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বই আকারে প্রকাশিত হয়।
ভাষাবিজ্ঞান আর সাহিত্যকর্মে অবদানের জন্য হুমায়ুন আজাদকে ১৮৮৬ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। মৃত্যুর পর ২০১২ সালে তাকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করা হয়।
২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে সন্ত্রাসীরা তাকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে। সুস্থ হয়ে ওই বছরের আগস্টে গবেষণার জন্য জার্মানি যান হুমায়ুন আজাদ। সেখানে ১২ আগস্ট নিজের ফ্ল্যাট থেকে তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।
সারাবাংলা/এসএসএস