পালকি চলে!
৩ আগস্ট ২০২১ ২০:২৯
“পালকি চলে! পালকি চলে! গগন তলে আগুন জ্বলে!
স্তব্ধ গাঁয়ে আদুল গাঁয়ে যাচ্ছে কারা রুদ্র সারা!…”
সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের “পালকির গান” কবিতাটি গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য পালকির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বাঙালির ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন বাহক পালকি। দূর-দূরান্তের পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য পালকি ছিল প্রাচীনকালে জনপ্রিয় মাধ্যম। তবে বিয়ের উৎসবে পালকির কদর ছিল সবচেয়ে বেশি।
একটা সময় ছিল, যখন গ্রাম বাংলা এমনকি শহরের বিয়ের অনুষ্ঠানগুলোতে পালকি চাই-ই চাই। যেন পালকি ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। নতুন বধূকে পালকিতে করে নিয়ে যাওয়াই ছিলো দাম্ভিকের। পালকি যেন ছিল গ্রাম্য মেয়েদের বহুদিনের লালিত প্রেম, প্রীতি আর অমোঘ ভালোবাসার। নারীদের আবেগ অনুভূতির সাথে জড়িত ছিল পালকি। এটি ছাড়া গ্রামের বিয়ে যেন কল্পনা করা যেত না।
পালকি সাধারণত ৩ ধরনের হয়ে থাকত ; সাধারণ পালকি, আয়না পালকি, এবং ময়ূরপঙ্খী পালকি। সাধারণ পালকি ছিলো আয়তাকার। চারদিকে কাঠ দিয়ে আবৃত এবং ছাদ ঢালু। এর দুই দিকে দুটি দরজা থাকত। আয়না পালকিতে আয়না লাগানো থাকত। ময়ূরপঙ্খী ছিল আয়তনে সবচেয়ে বড়। এর ভিতর বসার জন্য পালঙ্কের মতো আসনও করা হত। পালকিগুলোতে পাখি, পুতুল, লতাপাতা ও আকর্ষণীয় নকশা করা থাকত।
চারকোণা বিশিষ্ট পালকি বহন করত ৪ থেকে ৬ জন সুঠাম দেহের পুরুষ। যারা বেয়ারা নামে পরিচিত ছিল। দুরুত্বভেদে বেয়ারাদের হাতে শোভা পেত লাঠি কিংবা দেশীয় অস্ত্র। তারা পালকি নিয়ে ‘হুনহুনা’ ‘হুনহুনা’ ধ্বনিতে তালে তালে পা ফেলে, সুরেলা ছন্দময় ধ্বনিতে গন্তব্যের দিকে ছুঁটে চলত। গ্রামীণ সেই চেনা আকাঁবাকা, মেঠো পথে বেয়ারারা নববধূ নিয়ে বরসহ শ্বশুর বাড়িতে যাওয়া আসা করত। বেয়ারাদের হুনহুনা ধ্বনিতে মুখরিত দৃশ্য দেখতে পথের ধারে জড়ো হত গায়ের বধূসহ মা- চাচী এমনকি উঠতি বয়সের চঞ্চল মেয়েরাও। নবীন-প্রবীণ, তরুণ-তরুণী, বালক-বালিকাদের হৈ হুল্লোড় আর দুষ্টুমিতে এক আনন্দঘন মুহূর্তের সৃষ্টি হত। পালকিতে বসে থাকা নববধূকে দেখে তারাও রাজকুমারেকে নিয়ে কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যেত। পালকি ঘিরে কত হাসি, তামাশা, গল্প সে যেন এক বিমোহিত পরিবেশ। মানব চাকা ব্যবহার করে পালকি চলত ঘন্টার পর ঘন্টা, মাইলের পর মাইল।
সভ্যতার ক্রমবিকাশ, তথ্য প্রযুক্তির যুগ, বিজ্ঞানের আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে গেছে বাঙালি ঐতিহ্যের প্রতীক পালকির প্রচলন। এখন আর আগের মতো পালকির ব্যবহার চোখে পড়ে না। মেয়েরা আর পালকিতে চড়ে বিয়ের স্বপ্ন বোনে না। বিয়েতে পালকির সেই স্থান দখল করে নিয়েছে জাঁকজমক করে সাজানো প্রাইভেট কার।
ইতিহাস বলছে, একসময় অভিজাত শ্রেণীর মানুষ ও রাজাদেরও প্রধান বাহক ছিল পালকি। রকমারি ও বাহারি রূপে ছিল পালকি।কীভাবে এদেশে পালকির ব্যবহার শুরু হয়েছিল তার সঠিক ইতিহাস পাওয়া যায় নি। তবে মোঘল ও পাঠান আমলে বাদশা, সুলতান, বেগম ও শাহজাদীরা পালকিতে যাতায়াত করতেন। মুসলিম সম্প্রদায় মেয়েরা পর্দা রক্ষার জন্য পালকিতে চড়ে অত্যন্ত রক্ষণশীলভাবে বাড়ির বাইরে যাতায়াত করত। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা প্রাচীনকালে তাদের বউ মেয়েদের যাতায়াতের জন্য পালকি ব্যবহার করত। বিলাসী পরিবারগুলোতে নিজস্ব পালকি ও নিজস্ব বেয়ারা থাকত। অন্যদিকে নিম্নবিত্ত পরিবার যাতায়াতের জন্য ভাড়ায় চালিত পালকি ব্যবহার করত। বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা এবং চতুর্দশ শতকের পর্যটক ম্যাগনোলি ভ্রমণের সময় পালকি ব্যবহার করতেন বলে জানা যায়।
ঐতিহাসিকদের গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ি – উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে স্টিমার ও রেলগাড়ি চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পালকির ব্যবহার কমতে থাকে। সড়ক ব্যবস্থার উন্নতির ফলে পায়ে চালিত পালকির কদর কমে যায়। ১৯৩০ এর দশকে শহর অঞ্চলের রিক্সার প্রচলন হওয়ার পর থেকে পালকির ব্যবহার উঠেই গেছে। পালকির বদলে যাতায়াতের জন্য এ ধরনের সহজ যানবাহন বেছে নেয়।
কালক্রমে ঐতিহ্যের বাহক পালকি আজ বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। রাজা নেই, বাদশা নেই, নেই পালকির বেয়ারারা। কোথায় হারিয়ে গেল সেই সময়। এখনকার বধূরা আর পালকিতে চড়ে লাজরাঙ্গা মুখে শ্বশুর বাড়ি যায় না। তবে কেউ কেউ শখের বশে পালকির আয়োজন করে, যাতে বিয়ের অনুষ্ঠানে নতুনত্ব আসে। কেউবা নাটক-সিনেমায় ব্যবহার করার জন্য পালকির খোঁজ করেন। তবে আগের মত পালকির সেই আমেজ আর চোখে ধরা দেয় না। কিন্তু এখনো কোথাও কোথাও পালকির মেলে। বিশেষ করে প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসের লোক ও কারুমেলায় বর-কনের বিয়ে অনুষ্ঠানে প্রকৃত পালকির অনুরূপ ককসিড দিয়ে বানানো পালকি দেখা যায়।
গ্রামবাংলার এ প্রাচীন বাহন পালকি সংরক্ষণ করতে হবে। না হলে এ ঐতিহ্যময়ী পালকি স্থান নিবে জাদুঘর কিংবা বইয়ের পাতায়। সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যেদিন আমাদের নতুন প্রজন্মকে পালকি দেখতে লোকশিল্প জাদুঘরে যেতে হবে, কৃত্রিমভাবে সাজানো পালকি দেখার জন্য।
লেখক: তামান্না আক্তার, শিক্ষার্থী
সারাবাংলা/এসএসএস