পাঠ প্রতিক্রিয়ায় ‘সৃষ্টির তরঙ্গ অন্তরঙ্গ’
১৩ মার্চ ২০১৮ ২০:১০ | আপডেট: ১৪ মার্চ ২০১৮ ১৫:৪১
সাহিত্য সমালোচনা নিজেই আলাদা একটা সাহিত্য। কবি-লেখকের সঙ্গে পাঠকের যোগসূত্র গড়ে দিতে যেমন এর ভূমিকা রয়েছে, আবার সময়ের সাথে সাথে টেক্সটকে নতুন চিন্তার আলোকে বিনির্মাণের পথটাও খোলা থেকে যায় এখানে। একজন শিল্পী, একজন সাহিত্যিক যতক্ষণ পর্যন্ত তার সৃষ্টিকে নির্মাণ করেন, ততক্ষণ পর্যন্তই সেটা তার। যে মুহূর্তে সেটার প্রকাশ ঘটে গেল, সেটা হয়ে পড়ল সমগ্র মানুষের। ব্যক্তির সৃষ্টিশীলতা আর তার সৃষ্টির সামগ্রিকতার এই যে দ্বান্দ্বিকতা— এর উপর ভিত্তি করেই ঘটে চিন্তার পুনঃমূল্যায়ন আর নবায়ন। সমালোচনামূলক সাহিত্য ব্যক্তি ও সমষ্টির চিন্তাবিশ্বে মেলবন্ধনের দুরুহ এই কাজটিই করে।
বাংলাদেশের সমকালীন সাহিত্য প্রবণতায় দৃষ্টি দিলে আমরা দেখতে পাব— অসংখ্য বই প্রকাশ হচ্ছে প্রতিবছর। এর মধ্যে এগিয়ে কবিতার বই। উপন্যাস, ছোটগল্প বইয়ের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। তবে সাহিত্য সমালোচনা বা পর্যালোচনার বই খুঁজতে গেলে অনেক তালাস করেও পাওয়া যাবে না। যাও-বা পাওয়া যাবে সেটাও একাডেমিক ঘরানার। সেখানে সৃষ্টির আন্তরিকতা কোথায়? অথচ সজীব-সৃষ্টিশীল সমাজের জন্য সৃষ্টিশীল সাহিত্যের গুণিতক হারে সাহিত্য আলোচনা-সমালোচনারও প্রয়োজন। বাংলাদেশের সমকালের সাহিত্যের এ হালচালের মাঝে ব্যতিক্রমদেরই একজন বলা যেতে পারে অনু হোসেনকে। নিষ্ঠার সঙ্গে সাহিত্য পর্যালোচনার কাজটি করে চলেছেন তিনি। ‘শিল্পের চতুষ্কোণ’ দিয়ে শুরু, সর্বশেষ সংযোজন ‘সৃষ্টির তরঙ্গ অন্তরঙ্গ’। এ বছরের বইমেলায় একেবারে শেষের দিকে আসা বইটির প্রকাশক বেঙ্গল পাবলিকেশন্স।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে খোন্দকার আশরাফ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়কালের ১৩ জন কবি-সাহিত্যিকের সংবেদনা ও সৃষ্টির নন্দনসূত্র ঠাঁই পেয়েছে ২০৮ পৃষ্ঠার বইটিতে। অন্যরা হলেন, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, আহসান হাবীব, আবুল হোসেন, সনজীদা খাতুন, রফিক আজাদ, শহীদ কাদরী, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, সৈয়দ আকরম হোসেন, নির্মলেন্দু গুণ ও আবুল হাসান। লেখক অনু হোসেন সাহিত্য পর্যালোচনার যে কলকব্জাটি বেছে নিয়েছেন সেটা একাত্মবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। কবি-লেখকের আবেগ-সংবেদনার সাথে সৃষ্টির শৈলী বা নন্দনকে একাকার করে তিনি অগ্রসর হন টেক্সটের নতুন পাঠ উন্মোচন করতে করতে। বইটির নামের মধ্যেও এই চিন্তার ফসল। বইয়ের শুরুতে ‘লেখক কথায়’ তিনি পাঠককে সেই সূত্র ধরিয়েও দেনঃ “সচরাচর ‘অন্তরঙ্গ’ শব্দটি বিশেষণ অর্থে অন্তরের সম্পর্ক বা গভীর বন্ধুত্বা বোঝায়। সৃষ্টির তরঙ্গ অন্তরঙ্গ-এ ‘অন্তরঙ্গ’ শব্দটি বিশেষ্য, যার অর্থ ভিতরের অবয়ব বা অভ্যন্তর কাঠামো। লেখক-শিল্পীর সামগ্রিক চেতনার জগৎকে দেখতে চেয়েছি সৃষ্টিশীলতার তরঙ্গ হিসাবে আর এই তরঙ্গিম প্রবাহ যে কাঠামোতে মূর্ত হয়ে ওঠে তারই আরেক নাম রাখতে চেয়েছি ‘অন্তরঙ্গ’।”
বাংলা সাহিত্যের মুখ্য ১৩ জন কবি-লেখকের সাহিত্য-কর্ম নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে প্রাবন্ধিক তাদের মৌল প্রবণতার সন্ধান করেছেন। তাদের সৃষ্টিশীল সত্তার বৈশিষ্ট্য এবং সৃষ্টির নন্দনের বিষয়-আশয়কে একাত্ম করে এ অনুসন্ধান। শরীরের কাঠামো আর চেতনা মিলেই যেমন মানুষ, তেমনি ব্যক্তিমানুষের চিন্তাবিশ্ব আর তার সৃষ্টিশীল কর্ম মিলিয়েই সাহিত্য। লেখকের চিন্তাবিশ্বই যে তার সাহিত্য-শৈলী ও সৌন্দর্যবোধের রূপকল্প নির্মাণে ভূমিকা রাখে— এরই তালাস মিলবে প্রবন্ধগুলোতে।
প্রাবন্ধিক শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দিয়ে। ‘পঁচিশ আসে অতুল ঐশ্বর্যে অমিত শক্তিতে’ শিরোনামের লেখাটিতে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যসৃষ্টি নিয়ে তিনি বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যে ফিরিয়ে আনলেন রূপ ও রুচির দিগন্ত— সৌন্দর্য ও আনন্দের পরাকাষ্ঠা। রূপের প্রসঙ্গে বলা যায় তাঁর সাহিত্যবৈভবে সৃষ্টি হলো অতুল বিন্যাস ও তার বিকাশ আর ব্যাপ্তি। রবীন্দ্রনাথের অনন্যসাধারণ প্রকাশ ক্ষমতার বলেই বাংলা ভাষা প্রাণ পেয়েছে আপন সরোবরে। নিজের ঘরের ভাষাকে তিনি তাঁর বিশ্বাস ও ভাবের অনুগত করতে পেরেছেন। তাঁর অনুভূতি ছিল একান্তই মৌলিক, আর অনুভূতি যেখানে মৌলিক সেখানে প্রকাশরীতির ধারাটি নিজস্ব হতে বাধ্য।’
বাংলার আরেক প্রধান কবি জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে যে মূল্যায়ন করেন সেখানে ব্যক্তিজীবন ও কবিজীবন একাকার। তবে সেখানেই ইতি টানছেন না, জীবনানন্দের কাব্যিক আচ্ছন্নতকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে টেনে আনছেন অপার্থিবতাকে; বলছেন, ‘জীবনানন্দের জীবনটাই কবির জীবন, ব্যক্তিগত জীবনকে এই কবির জীবন থেকে আলাদা করে শনাক্ত করতে শেষ পর্যন্ত জীবননদীর জলে ওই শতবিভোর কবির জীবনই ভেসে উঠবে।’
‘জীবনানন্দ এক আশ্চর্য স্ফুলিঙ্গের ধারা বাংলা কবিতায় ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। অপার্থিত কোনো প্রেরণার অগ্নি থেকে তাঁর এই স্ফুলিঙ্গের প্রবাহ উৎক্ষিপ্ত হয়েছিল। অপার্থিব বলেই তাঁর কবিতা ঘিরে বাঙালি পাঠকের হৃদয়ে এমন অপ্রতিরোধ্য অজ্ঞাত আকর্ষণ।’
বইটির সবচেয়ে সমৃদ্ধ প্রবন্ধ আব্দুল মান্নান সৈয়দকে নিয়ে লেখা ‘আব্দুল মান্নান সৈয়দ : একদা শহরে ঢুকেছিল সুন্দরবনের হরিণ’। ৩৬ পৃষ্ঠার এই প্রবন্ধটিতে লেখক মান্নান সৈয়দের বর্ণাঢ্য জীবন আর তার বিচিত্রগামী সাহিত্য সৃষ্টির প্রবণতাগুলো তুলে এনেছেন। মান্নান সৈয়দের ডায়েরির পাতা ধরে ধরে প্রাবন্ধিক এ কাজটি করেছেন। ফলে মানুষ মান্নান সৈয়দ আর তার সৃষ্টি একবিন্দুতে ধরা পরে পাঠকের চোখে। মান্নান সৈয়দ জীবনব্যাপী লিখেছেন প্রচুর। অগণন বিষয় ও চিন্তা তাঁর মাথা থেকে কলমের ডগায় চলে আসত অনায়াসে। প্রাবন্ধিক কবি-কথাসাহিত্যিক-সমালোচক মান্নান সৈয়দের বিশাল ও বিচিত্রগামী সৃষ্টির উৎসমুখ খুঁজতে গিয়ে তার ডায়েরিতে লেখা আত্ম-উপলব্ধি পাঠকের সামনে তুলে ধরেন : ‘খুঁজে ফিরতে হয় না আমাকে, আমার শিল্পের উপকরণ আমি পেয়ে যাই। এত বেশি পেয়ে যেই যে, রূপ দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারি না। চোখ বুজলেই পাই, চোখ খুললই পাই, হাত বাড়ালেই বন্ধু, পা বাড়ালেই রাস্তা। জীবনের সমস্ত কিছু দিয়েই আমি আমার উপকরণ পাই। আমার উপকরণ অনিঃশেষ। আমিও অনিঃশেষ। আমি নিজের ভেতর সূর্য বহন করে চলেছি। সূর্যের সাতটি রশ্মি আমার শিল্পকাজ।’
বাংলা সাহিত্যের বিরলপ্রজ প্রতিভা সৈয়দ আকরম হোসেনকে নিয়ে লেখা প্রবন্ধ ‘তাঁর প্রদীপের সলতে’। নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধটিতে লেখক সৈয়দ আকরম হোসেনের সাহিত্যসৃষ্টির প্রবণতাগুলো তুলে ধরেছেন। সৈয়দ আকরম হোসেন লিখেছেন কম। ভাষার ক্ষেত্রে তাঁর রয়েছে অভিনব নিরীক্ষা আবার এবকেবারে আটোসাঁটো নিশ্ছিদ্র গদ্য বহু চিন্তার পথ উন্মোচন করে। আকরম হোসেনের সাহিত্য ব্যক্তিত্ব নিয়ে প্রাবন্ধিক তীক্ষ্ণ কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন। এর মধ্য দিয়ে ধরতে চেষ্টা করেন তাঁর সৃষ্টি ও ব্যক্তিত্বের অনবদ্যতাকে। ‘প্রথাগত পথ তাঁর নয়। প্রতিটি সাহিত্য মূল্যায়ন তাঁর অভিনব চিন্তা নিয়ে এগোয়’, অথবা ‘বিষয়কে যুক্তি ও সমাজ-সময় এবং সর্বোপরি নান্দনিক ঐক্যের কার্যকারণে উপস্থাপন করা তার প্রধান লক্ষ্য’, অথবা ‘প্রথাগত ধারণায় অন্যরা যখন শিল্পসাহিত্যে ভাবালুতা ও ভাবাবেগকে নেতিবাচক বলে নানান যুক্তি আরোপে উড়িয়ে দিচ্ছেন সৈয়দ আকরম সেটিরই প্রতিষ্ঠা দিয়ে থাকেন’, অথবা, ‘সৈয়দ আকরমের রচনার গদ্যভঙ্গি সৃষ্টিশীল, বহুস্তরী ব্যঞ্জনা সঞ্চারণমুখী, গতিশীলচিত্রধর্মী’। প্রাবন্ধিকের উপস্থাপনায় সৈয়দ আকরম হোসেনের ব্যক্তিত্ব আর সাহিত্যসৃষ্টি একই সমান্তরালে অগ্রসর হয়।
বাংলাদেশের সমালোচনামূলক সাহিত্য এখনও একাডেমির বৃত্তে আবদ্ধ। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝেই এর চর্চা। বৃহৎ পাঠকের কাছে তা পৌঁছতে পারেনি। এক্ষেত্রে বড় বাধা মনে হয় ভাষারীতি। একাডেমি বা বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব ভাষা-বলয় তৈরি করে রেখেছে। দিনের পর দিন সেই কাঠামোতেই চলছে লেখালেখি। এখানে সৃজনশীলতার চেয়ে ডিগ্রি অর্জনের চাপটাই বেশি। জনসাধারণের ভাষার যে নিয়ত পরিবর্তনশীলতা তার সঙ্গে অনেক সেকেলে একাডেমিক গদ্য। এখানেই পাঠক আর লেখকের মাঝে তৈরি বেশ কয়েক দশকের বিচ্ছিন্নতা। ভাষারীতির ক্ষেত্রে অনু হোসেনের এই বইটি অনেকটাই স্বতন্ত্র। একাডেমিক গদ্যের সঙ্গে, সাংবাদিকতার গদ্য মিশিয়ে একটা বোধগম্য, ঝরঝরে গদ্য পাওয়া যায় বইটিতে।
আলোচক: সাংবাদিক ও কবি