Saturday 04 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘হু হু হাকিম’


৩০ মে ২০১৯ ২২:২৪ | আপডেট: ১ জুন ২০১৯ ১৮:৫১

আমাদের পেয়ারা ভাই লেখক হিসেবে তার প্রত্যাশিত সাফল্য পেলেন না।
পাওয়ার কথাও না। তিনি সেটা বুঝতে না পারলেও আমরা কিন্তু বুঝেছিলাম সেই শুরুতেই।
নায়ক-নায়িকার বেলায় যেমন দর্শনধারী। লেখালেখিটা তেমনি নামধারী। লেখকের নাম হতে হয় কায়দার। প্রয়োজনে নিজের আসল নামকে ওলট-পালট করতে হয়। ভাঙচুর করতে হয়। তাতেও কায়দা না হলে আশপাশ থেকে নতুন কিছু এনে নামের সঙ্গে জুড়ে দিতে হয়। আর তাতেও যদি কাজ না হয় তাহলে একেবারে পাইলিং থেকে ঝালাই করে নতুন একটা নাম নিয়ে নিতে হয়। এটা দোষের কিছু না। অতীতের অনেক নামিদামি লেখক কাজটা করেছেন। বর্তমানের অনেকে করছেন এবং ভবিষ্যতেও অনেকে করবেন।
কিন্তু আমাদের পেয়ারা ভাই সে পথে হাঁটলেন না। তিনি নিজের আসল নামের সাথে ডাকনাম পেয়ারাটাও বহাল রাখলেন। এবং সেই নামে লেখালেখি করার প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন।
আমরা কতভাবে বারণ করলাম। বোঝালাম।
পেয়ারা নামটা রাখা ঠিক হবে না ভাই। ঝুলে যাবে।
পেয়ারা ভাই আমাদের দিকে গরম চোখে তাকান।
ঝুলে যাবে মানে! পেয়ারা তো ঝুলবেই। লেখালেখি করবো বলে পেয়ারার গাছে ঝোলা তো বন্ধ করতে পারি না। কি পারি?
পেয়ারা ভাই চূড়ান্ত উত্তর দিয়েও আমাদের প্রশ্ন করেন। আমরা তাকে পুনরায় বোঝানোর চেষ্টা করি।
শোনেন ভাই, শাক-সবজি, ফল-মূলওয়ালা নাম নিয়ে কেউ কি বড় লেখক হতে পেরেছে? রবীন্দ্রনাথ থেকে আজ পর্যন্ত? ইতিহাস ঘাটেন। একটা উদহারণ দেখাতে পারবেন না। নট এ সিঙ্গেল ওয়ান।
পেয়ারা ভাই পুরনো সিদ্ধান্তে অবিচল থেকে মাথা নাড়েন।
হয়নি বলে কি হবে না? দেখিস তোদের পেয়ারা ভাই-ই হবে। দুনিয়া চলে যাচ্ছে ভেজিটেরিয়ানদের দখলে। আমার মতো পেয়ারা, আঙ্গুর নামওয়ালারাই ভবিষ্যতে বড় লেখক হবে।
আমরাও পাল্টা মাথা নাড়ি। হবে না ভাই। হবে না।
যদি হতো তাহলে আপনার আগেই পেয়ারা, ডালিম, লেবু এসব নাম নিয়ে অনেকেই বড় কবি-সাহিত্যিক হয়ে যেত। ফলের বাগান ভরে যেত কবি-সাহিত্যিকে।
যুক্তিহীন কথা বলিস নাতো।
পেয়ারা ভাই খ্যাক করে ওঠেন। তিনি আমাদের কথা আমলে নেন না। আমরা তারপরও লেগে থাকি।
শোনেন ভাই, সবকিছুতেই একটা ব্যাপার থাকে। সিনেমার ভিলেনের নাম যদি হয় ‘মাখন’ তাহলে মানায়? মানায় না। দর্শক ভিলেনকে মাখনের মতো নরম দেখতে চায় না। দর্শক চায় ভিলেনের হৃদয় হবে মোস্তাকিমের চাপের মতো আধপোড়া। চোখ থাকবে রক্তজবার মত টকটকা লাল। তাদের নাম হবে রামদা রবি, বুলেট বাবুল, ছরতা জামাল, বীচি বাবর এই টাইপ। মাখন, ছানা, ননী তাদের জন্য না।
পেয়ারা ভাই হালকা খটকা খান।
নামের আবার এত কাহিনী আছে নাকি?
আছে না মানে। অবশ্যই আছে। বৃক্ষ তোমার নাম কী? ফলে পরিচয়। সেই ফলটারও একটা নাম আছে। নাম খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পেয়ারা ভাই।
তো আমাকে তোরা কি করতে বলছিস?
গাছের পেয়ারা গাছেই রেখে দেন। পেয়ারার বদলে নামের সাথে অন্যকিছু জোড়া দেন। এই যেমন অনেকের নাম থাকে না ‘দিগন্ত দীপক’, ‘অশান্ত আকাশ’ কিংবা ‘মরীচিকা মনির’ এই জাতীয় কিছু। লেখকদের ভেজাইল্যা নাম পাঠকের পছন্দ। তারা মনে করে যে লেখকের নাম যত প্যাচের তার গল্পে মোচড় তত বেশি। আর মোচড় হইলো গল্পের প্রাণ।
পেয়ারা ভাই গালে হাত দিয়ে কয়েক মুহূর্ত ভাবেন।
আমার নাম তো হাকিম হোসেন পেয়ারা। পেয়ারায় মোচড় দিলে তো নিচে পইড়া যাবে।
আমরা মাথা নেড়ে বললাম, সেজন্যই তো বলছি, মোচড়টা মারেন। ঝরে যাক।
কিন্তু…
পেয়ার ভাই তার চুলকানো গাল আবারও চুলকান।
আকাশ-বাতাস এইসব তো আমার নামের সাথে যায় নারে।
বাতাস যায় না তো কী হইছে। বাতাসের শব্দ তো যায়। কি যায় না?
বাতাসের শব্দ! পেয়ারা ভাই এবার চূড়ান্ত ধন্দে পড়েন।
আমরা তুমুল বেগে মাথা নাড়ি। অবশ্যই বাতাসের শব্দ। আমরা আপনার জন্য সুন্দর একটা নাম ঠিক করেছি।
নামও ঠিক করে ফেলছিস! কী নাম?
‘হু হু হাকিম’।
‘হু হু হাকিম’!
ইয়েস ‘হু হু হাকিম’। প্রলয়ঙ্করী হু হু শব্দ করে বাংলা সাহিত্যে আপনি আবির্ভূত হবে। আপনার সৃষ্ট হু হু বাতাসে অন্য লেখকদের বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টে-পাল্টে যাবে। তারা ধরা খাওয়া পুঁটি মাছের মতো খাবি খেতে শুরু করবে।
একটানা কথাগুলো বলে আমরাই খাবি খেতে থাকি।
কিন্তু না।
হু হু বাতাস পেয়ারা ভাইয়ের মনকে ঠান্ডা করতে পারে না। তিনি পুরনো অসম্মতির ঢং বজায় রেখে নতুন করে মাথা ঝাঁকান।
না না। এইটা চলবে না। নামের আগে হু হু থাকলে মানুষ উল্টা ভাববো।
উল্টা ভাববো! কী উল্টা ভাববে?
মানুষ ভাববে আমি দুঃখের স্টোরি রাইটার। এইজন্য আমার নাম হু হু হাকিম। মানুষ আমার লেখা পড়বে না। কারণ, জাইনা শুইনা কেউ দুঃখের লেখা পড়তে চায় না। এখন মানুষ খালি ফান চায়। তাছাড়া আরও একটা ব্যাপার আছে।
কথার মধ্যে একটু রহস্য ঢেলে পেয়ারা ভাই আমাদের দিকে তাকান।
আর কী ব্যাপার? আমরা ভ্রুঁ কুঁচকে জানতে চাই।
পেয়ারা ভাই লাজুক ভঙ্গিতে মাথা নাড়েন। পেয়ারা নামটা তোদের কুসুম আপার খুব পছন্দ। সে বলেছে পেয়ারার মধ্যে ফরমালিন নাই। জিনিসটা আমাদের দুইজনের প্রেমের মতো খাঁটি।
আমাদের মধ্যে পেয়ারা ভাইয়ের বন্ধু মোখলেস ভাই ছিলেন। তিনি খ্যাক করে ওঠেন।
ধুর ব্যাটা। প্রেম ধইরা বইসা থাকলে সাহিত্য হইবো না। সাহিত্যে চাই বিরহ। ছ্যাক খাইয়া কইলজারে ঝুরঝুরা না করলে লেখা বাইর হইবো না। ওইসব কুসুম কুসুম প্রেম বাদ।
মোখলেস ভাইয়ের কথার জবাবে উল্টো খ্যাক করেন পেয়ারা ভাই। তিনি বিরহের দিকে গেলেন না। তিনি তার প্রেমিকা কুসুমকেও রাখলেন একই সঙ্গে নিজের পেয়ারা নামটাও রাখলেন। এবং এই বিষয়ে কাঁচা পেয়ারার মতো শক্ত অবস্থানে অটল রইলেন।

বিজ্ঞাপন

আমরা বুঝলাম পেয়ারা ভাই অবস্থান পাল্টাবেন না। তাই তাকে আর ঘাটালাম না। তাকে তার মতো চলতে দিয়ে যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।
ওদিকে পেয়ারা ভাই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তার সাহিত্যকর্ম নিয়ে। ঘোষণা দিলেন, অচিরেই একঝাঁক প্রেমের কবিতা দিয়ে আমাদের চমকে দেবেন তিনি।
আমরা চমকের অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু চমক যে এত দ্রুত উপস্থিত হবে বুঝিনি।

দিন পনেরো পর এক বিকেলে পেয়ারা ভাই আমাদের আড্ডাস্থলে হাজির। তার হাতে এ ফোর সাইজের লুজ কাগজের একটা বান্ডিল।
আমরা অবাক। না, কাগজের বান্ডিল দেখে না। পেয়ারা ভাইয়ের অন্য হাতে ধরা জ্বলন্ত লাইটার দেখে। আমরা একবার কাগজের দিকে, একবার লাইটারের দিকে আর একবার পেয়ারা ভাইয়ের মুখের দিকে তাকাই।
পেয়ারা ভাই বললেন, জ্বালিয়ে দেবো।
বুঝলাম কোনও ঘটনা আছে। পেয়ারা ভাইকে বললাম, জ্বালাবেন ভালো কথা। কিন্তু সকল জ্বালাও-পোড়াওয়ের আগে একটা গরম টাইপ ভাষণ থাকে। আপনার ভাষণটা আগে শুনি।
পেয়ারা ভাই ভাষণ দিলেন না। তার বদলে আমাদের পাশে আসন নিলেন। তারপর বুকের সব চাপা হতাশা উগড়ে দিয়ে হু হু করে উঠলেন।
পেয়ারা ভাইয়ের হু হু ভাব কিছুটা কমলে আসল ঘটনা জানা যায়। সদ্য লেখা কিছু কবিতা নিয়ে এক পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদকের কাছে গিয়েছিলেন তিনি। সাহিত্য সম্পাদক পেয়ারা ভাইয়ের কবিতা পছন্দ না করলেও তার নামটা পছন্দ করেন। নামটা নাকি কৃষি বিজ্ঞানের সাথে যায়। তাই কবিতা-টবিতা না লিখে পেয়ারা ভাইকে পত্রিকার কৃষি পাতায় নিয়মিত লেখার পরামর্শ দেন তিনি। ‘ছাদে কিভাবে বাগান করবেন’, ‘এক মাটিতে দুই ফলন’ এই জাতীয় লেখায় সাহিত্য সম্পাদক পেয়ারা ভাইয়ের সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছেন।
পেয়ারা ভাই পুরো ঘটনা শেষ করতে পারেন না। ছলছল চোখে কবিতার বান্ডিল বুকে চেপে আবারও হু হু করে ওঠেন।

বিজ্ঞাপন

পলাশ মাহবুব রম্যগল্প হু হু হাকিম

বিজ্ঞাপন

না ফেরার দেশে অঞ্জনা
৪ জানুয়ারি ২০২৫ ০১:৫৪

এই তাসকিনকে সমীহ করবেন যে কেউ
৪ জানুয়ারি ২০২৫ ০১:৪৭

আরো

সম্পর্কিত খবর