আবার দার্জিলিং-পর্ব ২
৯ এপ্রিল ২০২১ ১০:০০ | আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০২১ ০৯:১৮
“লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান, দিস ইজ ইয়োর ক্যাপ্টেন স্পিকিং। উই আর ল্যান্ডিং অ্যাট নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট উইদিন টেন মিনিটস্। প্লিজ কিপ ইউর সিটবেল্ট ফাসেন্ড অ্যান্ড অবসার্ভ দ্য নো স্মোকিং সাইন।”
২০১০ সালের ২৫শে নভেম্বর। জেট এয়ারওয়েজের বোয়িং ৭৩৭ এর 9W273 ফ্লাইটটা মাটি থেকে পঁয়ত্রিশ হাজার ফুট উচ্চতায় আমাদের উড়িয়ে নিয়ে চলেছে ঢাকা থেকে কলকাতা। ক্যাপ্টেনের ঘোষণা শোনামাত্রই বহ্নি আর আমার দু’জনেরই দাঁত বের হয়ে গেল। বাহ্, এত দ্রুত কলকাতা চলে আসা যায়! মজার ব্যাপার হল ঢাকায় যখন আমরা প্লেনটিতে উঠি তখন বাজে বিকেল সাড়ে পাঁচটা। কলকাতাতে যখন নামব তখন সেখানেও বিকেল সাড়ে পাঁচটা। বলা যায় আমরা সায়েন্স ফিকশনের মত একটা হাইপার ডাইভ দিয়ে ঢাকা থেকে কলকাতা চলে এসেছি। ব্যাপারটা চিন্তা করে বেশ মজা লাগল।
কলকাতা এয়ারপোর্টের পোশাকি নাম বিখ্যাত নেতা সুভাষ চন্দ্র বোস এর নামে। যদিও দমদম এয়ারপোর্ট নামেই এটা বেশি পরিচিত। সুনীলের বইয়ে পড়েছি কিভাবে এই দমদম নামটা এসেছে। পরে আরেকদিন সেটার গল্প করা যাবে। এখন যে বিশাল ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনালটা দমদম এয়ারপোর্ট গেলে দেখা যায়, সেসময় তখন সেটার কাজ চলছিল। আমার মনে আছে, তখন ছিল ছোট্ট একটা ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনাল, আর তার চেয়েও ছোট একটা ইমিগ্রেশন। এত ছোট রুম দেখে আমরা বেশ অবাক হয়েছিলাম। আর এখন অবাক হই নতুন টার্মিনালের বিশালত্ব আর পরিচ্ছন্নতা দেখে। আমাদের প্ল্যান হল, আজকের দিনটা কলকাতায় কোন হোটেলে থাকা। আগামীকাল রাতে আমাদের নিউ জলপাইগুড়ির ট্রেন। অনেক চেষ্টা করেও আমরা কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের টিকিট পাইনি। মাহফুজ ভাই চেষ্টা করেছিলেন, লাভ হয়নি। তবে যে ট্রেনটা আমরা পেয়েছি তার মতে সেটাও খারাপ না। সেটার নাম কাঞ্চনকন্যা। একটা ট্রেনের এত সুন্দর নাম হতে পারে, ভাবা যায়? যাই হোক, রাত আটটা ত্রিশ মিনিটে এই স্বর্ণ-কন্যার আঁচল ধরে শিয়ালদা স্টেশন থেকে আমরা যাত্রা করব। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে পৌঁছাবো পরের দিন সকাল সাড়ে সাতটায়। এই পুরোটা সময় ঘুমানো ছাড়া আর কী করব ভাবছিলাম। ঢাকা থেকে বহ্নি আমাকে একটা ডায়েরি কিনে দিয়েছে। আমার প্রথম দার্জিলিং যাত্রার মুহুর্তগুলো যেন আমি ডায়েরি বন্দি করে রাখি। ভাবলাম, ঘুম না এলে কিছুটা লেখালেখি করা যেতে পারে।
প্লেন থেকে নেমে ইমিগ্রেশন শেষ হতে একেবারেই সময় লাগলনা। বের হয়ে একটা প্রিপেইড ট্যাক্সি নিয়ে রওনা দিলাম মার্কুইস স্ট্রিটের উদ্দেশ্যে। আমাদের গন্তব্য মির্জা গালিব স্ট্রিটের হোটেল গুলশান প্যালেস। সস্তার মধ্যে হোটেলটা খারাপ না। ট্রিপ অ্যাডভাইজরের (Tripadvisor.com) রেটিং যদিও খুব একটা ভাল বলছিল না। কিন্তু এক রাতেরই তো মামলা, তাই আর বেশি খুঁতখুঁত করলাম না। কোন রকমে রাতটা কাটিয়ে সকালে একটু এদিক সেদিক ঘুরলাম। রাতে আবার ট্রেন আছে, তাই বেশি ক্লান্ত হওয়া যাবে না। দুপুরে লাঞ্চ করলাম বিখ্যাত কস্তুরী হোটেলে। কলকাতায় গেছে এবং এই রেস্টুরেন্টে খায়নি এমন বাংলাদেশি বোধহয় খুঁজে পাওয়া যাবে না।
দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে এল। আমরা বাক্স প্যাটরা নিয়ে একটা ট্যাক্সি ডেকে দৌড়োলাম শিয়ালদার উদ্দেশ্যে। কলকাতায় মোট তিনটি রেল স্টেশন। হাওড়াটা নিউমার্কেট থেকে বেশ দূরে। তবে শিয়ালদা একেবারেই কাছে। দশ মিনিটও লাগল না পৌঁছোতে। আর অন্য রেলস্টেশনটা চীৎপুরে, নাম হল ‘কলকাতা স্টেশন’, যেটাতে ঢাকা থেকে মৈত্রী এক্সপ্রেস গিয়ে থামে। ট্রেনে আমাদের কামরাটা হল টু-টিয়ার। অর্থাৎ দু’দিকের দেয়ালে উপরে দু’টো আর নিচে দু’টো করে সিট। বহ্নি উপরে সিট পেয়েছে, আমি সেই একই দিকের দেয়ালে সিট পেয়েছি নিচে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেনটা একটা বড় হুইসেল দিয়ে নড়ে উঠল। বহ্নি পা ঝুলিয়ে উপর থেকে বসে ছিল। আমরা একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হেসে ফেললাম। এতদিনের স্বপ্ন শেষ পর্যন্ত পূরণ হচ্ছে। আমাদের ঐতিহাসিক দার্জিলিং জার্নি অবশেষে হুইসেল বাজিয়ে শুরু হল।
জীবনের ছোট ছোট চাওয়া যখন একটু একটু করে পুরণ হতে থাকে, তার চেয়ে আনন্দের মনে হয় আর কিছুই হয় না। একবারে হঠাৎ সবকিছু পেয়ে গেলে সেটাতে তৃপ্তি আসে কি? আমার তো মনে হয় না। আমরা একটু একটু করে টাকা জমিয়েছিলাম। একটু একটু করে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। ঢাকা কলেজের উল্টো দিকের মার্কেট থেকে গরম কাপড় কেনা, প্লেনের টিকিটের টাকা জোগাড় করা, পাহাড়ে বেড়ানোর উপযোগী জুতো কেনা, একটা নতুন ব্যাগ কেনা। এসব করতে আমরা সময় নিয়েছি এবং এতে তৃপ্তিও পেয়েছিলাম অনেক। যাত্রার দিন যতই এগিয়ে আসছিল, বুকের ভেতর টাকডুম টাকডুম ঢোলের আওয়াজটা ততই জোরে শোরে টের পাচ্ছিলাম। এগারো মাসের অপেক্ষার পর অবশেষে আমরা দু’জন এখন দার্জিলিংয়ের ট্রেনে।
আমাদের সাথে এক বাঙালি পরিবার যাচ্ছিল কলকাতা থেকে। গল্পে গল্পে বেশ জমে গেল তাদের সাথে। রাত বারটার দিকে বাতি নিভিয়ে ঘুমিয়ে গেল সবাই। আমি কম্বলটা টেনে নিলাম। বেশ ঠান্ডা লাগছে, কারণ এসির বাতাস কন্ট্রোল করার কোন উপায় নেই। প্রথম দিককার উত্তেজনা কমে গিয়ে এখন রাজ্যের চিন্তা ভর করছে মাথায়। দার্জিলিংয়ে আমাদের হোটেল বুকিং হয়েছে ‘হোটেল বেলেভিউ’-তে। সকাল সাড়ে সাতটায় নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছে আমরা ব্রেকফাস্ট করব, আশা করি নাস্তা খাওয়ার মত হোটেল টোটেল আশপাশেই পাওয়া যাবে। না পাওয়া গেলেও ক্ষতি নেই। আমরা দু’জন জার্নিতে দিব্বি চকোলেট খেয়েই কাটিয়ে দিতে পারি। এটা আমাদের পুরনো অভ্যাস। সে জন্য বেশ অনেকগুলো বাউন্টি আর স্নিকার্স ব্যাগে আছে। চিন্তা হচ্ছে শেয়ার্ড জিপে যাওয়া নিয়ে। শুনেছি ট্রেন থেকে নেমেই জিপ ধরতে না পারলে পরে নাকি জিপ পাওয়া কঠিন। কথাটা কতটা সত্য জানি না, কারণ এবারই প্রথম যাচ্ছি। সেক্ষেত্রে ব্রেকফাস্ট না করে আগে জিপ ধরাই কি ভাল হবে? একেবারে দার্জিলিং গিয়েই কি খাওয়া দাওয়া করব? এই সব চিন্তা করতে করতে কখন ঘুমিয়ে গেছি জানি না।
গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। আমার পাশের সিটের ভদ্রলোক হা করে ঘুমোচ্ছেন। বহ্নিও ঘুমুচ্ছে। সবাই গভীর ঘুমে। ‘কামরায় গাড়ী ভরা ঘুম, রজনী নিঝুম’ কথাটা কোথায় শুনেছি জানি না, কিন্তু মনে হল ঠিক এই সময়টার কথা চিন্তা করেই লেখা হয়েছিল সেটা। পর্দা সরিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। তাকিয়েই হতভম্ব হয়ে গেলাম। আজকে কি পূর্ণিমা? হতে পারে। বাইরে দেখলাম ধূ-ধূ জনমানবহীন একটা বিশাল ঘাসে ছাওয়া অঞ্চল। দূরে দেখা যাচ্ছে একটা বিশাল বড় গাছ। পুরো ছবিটা ঠিক যেন ডিজনীর অ্যানিমেশন ফিল্মের একটা স্ন্যাপশট। ফিনকি দেয়া জ্যোৎস্নার ভেতর দিয়ে আমাদের কাঞ্চনকন্যা ছুটে চলেছে। তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে অনেক দূরে।
ট্রেন আধা ঘন্টা লেটে পৌঁছালো নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন। শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, ডুয়ার্স এই নামগুলো কত যে পড়েছি গল্পের বইয়ে, শেষ পর্যন্ত এখানে পা দিতে পেরেছি এই আনন্দেই মন ভরপুর হয়ে গেল। কিন্তু আনন্দটা বেশিক্ষণ টিকল না। পৌঁছানোর পরেই একটা হুড়োহুড়ি দেখলাম। হুড়োহুড়িটা আর কিছুই না, শেয়ার্ড জিপ ধরার কম্পিটিশন। এখন শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি থেকে দার্জিলিং যাবার জন্য দরকারের চাইতেও বেশি গাড়ি সবসময় মজুদ থাকে। কিন্তু সেই ২০১০ সালে যাত্রীর তুলনায় গাড়ি এত পর্যাপ্ত ছিলনা। এখানে আরেকটা বিষয় বলে রাখা ভাল, স্টেশন থেকে সব গাড়িই যে দার্জিলিং যায় তা কিন্তু নয়। কিছু গাড়ি কালিম্পং যায়, কিছু যায় সিকিমের রাজধানী গ্যাংটক-এ। আরো অন্যান্য জায়গা তো আছেই। তাই যাত্রী বেশি হলে দার্জিলিংয়ের গাড়ি পাওয়া নিয়ে একটু টানা হেঁচড়া হওয়াটাই সে সময় স্বাভাবিক ছিল। পয়সা যাদের বেশি তারা শেয়ার্ড জিপ টিপের ধার ধারেনা। তারা একটা ট্যাক্সি রিজার্ভ করেই চলে যেতে পারে। কিন্তু আমাকে হিসেব করে চলতে হবে। ট্যাক্সি রিজার্ভ করে এখনই একগাদা টাকা খরচ করার কোন মানেই হয় না। যাই হোক, এরকম দৌড়োদৌড়ি দেখে ব্রেকফাস্ট খাওয়া আমাদের মাথায় উঠল। ব্যাগ ট্যাগ নিয়ে আমরাও দৌড়োলাম জিপ-স্ট্যান্ড এর দিকে। দৌড়োতে দৌড়োতে হঠাৎ মনে পড়ল, আমি একটা অত্যন্ত দরকারি ব্যাপার দিব্বি ভুলে বসে আছি। সেটা হল, এখান থেকে কলকাতায় ফেরার টিকিট কাটা। ঢাকা থেকে আমি শুধু কলকাতা-জলপাইগুড়ির টিকিটই কেটেছিলাম। ফেরার টিকিটটা কি কারণে যেন কাটা হয়নি। কেন যে কাটা হয়নি সেটা এখন আর মনে পড়ছেনা। তবে এটা মনে আছে যে, ভেবেছিলাম দার্জিলিং স্টেশন থেকেই সেটার ব্যবস্থা করব। কিন্তু এখন এখানে এসে এতসব লোকজনের হুল্লোড় দেখে মাথায় একটা নতুন চিন্তা ঢুকল।
ভেবে দেখলাম, এই লোকগুলোও তো কিছুদিন পরে কলকাতায় ব্যাক করবে। আমি দার্জিলিংয়ে বেড়িয়ে টেড়িয়ে ক’দিন পরে টিকিট কাটতে গিয়ে যদি দেখি তা পাচ্ছিনা, তাহলে তো খাব মহা ধরা। এদিকে কলকাতা থেকে আমাদের ঢাকায় ফেরার প্লেনের টিকিটও কাটা আছে। সময়মতো যদি কলকাতা যেতে না পারি, তাহলে তো প্লেনও মিস করব। সর্বনাশ! সুতরাং যেদিক থেকে দৌড় শুরু করেছিলাম, সেদিকে ঘুরে দিলাম উল্টো দৌড়। আমিও দৌড়োচ্ছি, বহ্নিও সমান তালে দৌড়োচ্ছে। আবার স্টেশন। এবার টিকিট কাউন্টার খোঁজো। ফর্ম ফিলআপ কর। পাসপোর্ট দেখাও। ফরেন কোটায় রিটার্ন টিকিট কাটলাম ঝামেলা কমানোর জন্য। এবং এই করতে করতে পেরিয়ে গেল প্রায় এক ঘন্টা। টিকিট হাতে নিয়ে আবার লাগেজ টেনে দৌড়োলাম ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের দিকে। সামনেই দাঁড়িয়ে আছে একটা লাল হলুদ জীপ। জানালার পাশে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রেখেছে, সেখানে লেখা ‘দার্জিলিং’। ততক্ষণে আমাদের জিব বেরিয়ে গেছে। ঠান্ডার মধ্যেও ঘেমে নেয়ে গেছি পুরো। মহানন্দে জিপটায় পা রাখতে যাব, এমন সময় ড্রাইভার বলল গাড়ি যাবেনা। কে-হে-হে-নো-হো-হো? হাহাকারের মত প্রশ্নটা বেরিয়ে এল বুকের ভেতর থেকে। শুনলাম দার্জিলিং এ আজকে ‘বন্দ্’। মানে দোকানপাট থেকে শুরু করে গাড়িঘোড়া চলাচল সব বন্ধ। কোন গাড়ি পাহাড় থেকে নামছেও না, পাহাড়ে যাচ্ছেও না। ল্যাম্পপোস্টের মত হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। এখন তাহলে কি হবে? কোথায় যাব আমরা??
(…চলবে)
সারাবাংলা/এসএসএস