শরৎ আলোর কমলবনে এলো শারদীয় দুর্গোৎসব
১ অক্টোবর ২০১৯ ১৩:৫৭ | আপডেট: ১ অক্টোবর ২০১৯ ১৪:০৫
শরৎ মানেই পরিষ্কার নীল আকাশে ভেসে চলা সাদা সাদা পেঁজা তুলোর মেঘ। ভোরে ঘাসের ডগায় জমতে থাকা শিশিরবিন্দুর মধ্যে সাদা শাড়িতে কমলা আঁচল বিছিয়ে শিউলি ফুলের সজ্জা। সেই সঙ্গে বাংলায় শরৎ মানেই ঢ্যাম কুড় কুড় ঢাকের তালে আলতা রাঙা পায়ে শারদীয় বার্তা নিয়ে দেবী দূর্গার আগমন। রবি ঠাকুরের কথায়,
‘শরত-আলোর কমলবনে
বাহির হয়ে বিহার করে যে ছিল মোর মনে মনে॥
তারি সোনার কাঁকন বাজে আজি প্রভাতকিরণ-মাঝে,
হাওয়ায় কাঁপে আঁচলখানি- ছড়ায় ছায়া ক্ষণে ক্ষণে॥’
বাংলার অন্যতম বড় এই উৎসবে প্রকৃতিও যেন সেজে ওঠে অন্যন্য উপায়ে। শরৎ মানেই যেন আকাশ আর মাটির মেলবন্ধন। ঘন সবুজ কাশের বনে আকাশের কয়েক টুকরো মেঘ যেন উড়ে এসে কাশফুল হয়ে ফুটে থাকে। আশ্বিনের শুক্লপক্ষে দেবী আসেন দশভূজা রূপে, সিংহের পিঠে অধিষ্ঠান হয়ে। হিন্দু ধর্মমতে, দুর্গতি বা সংকট থেকে রক্ষা করার জন্য তিনি দুর্গা। অন্য মতানুসারে দুর্গম নামের অসুরকে বধের কারণে তাঁকে দূর্গা নামে ডাকা হয়।
তিনি শিবের স্ত্রী পার্বতী, কালীর অন্য রূপ। বাংলা মঙ্গলকাব্যগুলিতে কার্তিক ও গণেশের জননী, শিবকন্যা পার্বতী সপরিবারে বাবার বাড়ি আসেন এই সময়ে। তার অবস্থানের এই দশদিন ঘটা করে দুর্গাপূজা পালিত হয়। চারপাশে পরিবার পরিজন নিয়ে স্মিত হাসির দেবীর পায়ের নীচে বিকটাকার অসুর। দেবীর দশ হাতে দশরকম অস্ত্র। তিনিই তো নারী শক্তি। তাই দেবী দূর্গার বন্দনা মানে যেন নারী শক্তিরই বন্দনা।
ধরে নেওয়া হয়, খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ বা ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বাংলায় দুর্গোৎসবের সূচনা হয়। জনশ্রুতি আছে, রাজশাহীর তাহিরপুরের রাজা কংসনারায়ণ প্রথম মহা আড়ম্বরে শারদীয়া দুর্গাপূজার সূচনা করেছিলেন। বাংলার অন্যতম বড় এই উৎসবে প্রকৃতির সঙ্গে মিল রেখে সেজে ওঠে উৎসবমুখর বাঙালি। আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও এখনও মেয়েরা পরেন রঙ-বেরঙের শাড়ি আর ছেলেরা পাঞ্জাবি-ধুতি বা ফতুয়া।
সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠ দিন অর্থাৎ ষষ্ঠী থেকে শুরু করে দশমী পর্যন্ত হয়ে থাকে দুর্গোৎসব। এই পাঁচ দিন যথাক্রমে দূর্গা ষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাঅষ্টমী, মহানবমী ও বিজয়া দশমী নামে পরিচিত। উৎসবের এই কদিন, ধর্মীয় আচারের পাশাপাশি চলে একেকদিন একেক রকম রান্না, খাওয়া আর সাজগোজ।
পাঁচদিনে পাঁচরকম সাজের উপলক্ষ পাওয়ায় একেকদিন একেক রকম সাজ বেছে নেন অনেকেই। আশ্বিনের বাতাসে হালকা ঠান্ডার আমেজ চলে আসলেও এখনও বেশ গরম। বিশেষত ভ্যাঁপসা আবহাওয়ায় ঘাম হয় অনেকের। তাই সাজগোজ এবং মেকআপে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন জরুরি। তাছাড়া পূজার এই পাঁচদিন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের পাশাপাশি চলে মন্ডপে মন্ডপে ঘোরাঘুরি আর দাওয়াত রক্ষা করা।
এই রোদ, এই বৃষ্টির এই সময়ে কিছুটা গরমও থাকে। তাই পোশাকে গুরুত্ব দিন সুতি, সিল্ক, লিনেনের মতো আরামদায়ক কাপড়। কিন্তু উৎসবের রঙে রঙিন হতে ভুলবেন না যেন। ষষ্ঠীর স্নিগ্ধ সাজে যদি বাড়ির বাইরে না বের হন তাহলে কাশফুলের সাদাই নাহয় বেছে নিলেন। সঙ্গে একদম সাধারণ মেকআপ। চাইলে দু’একটা হালকা গয়না।
অনেকেই ভাবেন, হালকা রঙে বা সুতি শাড়িতে বুঝি উৎসব ব্যাপারটা ফুটে ওঠে না। সাধারণ একটা সুতি শাড়িতেও উৎসবের আমেজ আসবে যদি গয়না বা ব্লাউজে আনা যায় বৈচিত্র্য। সঙ্গে একটা এলো খোঁপা বা হালকা কার্ল করে ছেড়ে দেওয়া চুল। সেই এলো খোঁপায় ফুলের ব্যবহারেই এনে দেবে ভিন্ন মাত্রা।
অষ্টমীর উৎসবমুখর সাজে বেছে নিতে পারেন শিউলির বোঁটার রঙের পোশাক। গাঢ় কমলা রঙেই জমে উঠবে উৎসব। শাড়িই হতে হবে তা না, বেছে নিতে পারেন কুর্তা কিংবা টপস। ভিন্নতা আনতে শুধু হাতে কয়েক গাছি চুড়ি। মালা কিংবা দুল ছাড়াই স্মার্ট সাজ।
নবমীর দিন মনের মতো সেজে বের হওয়াই যায় নিমন্ত্রণে কিংবা ঘুরতে। ভারি গয়না, চুলে ফুল, নাকে নথ আর কপালের টিপে জমে উঠবে উৎসব।
দশমীতে বাজতে থাকে বিষণ্ণতার সুর। এইদিনই যে বাপের বাড়ি ছেড়ে কৈলাস পর্বতে স্বামীর বাড়ির উদ্দেশ্যে ফিরে যান দেবী। দুর্গোৎসবের সমাপনীর এই দিনে কষ্টের মধ্যেও চলে আনন্দোৎসব। অনেকেই এইদিন লালপেড়ে সাদা শাড়ি পরেন। সধবা নারীদের সিঁদুর খেলা বিজয়া দশমীর উৎসবে যোগ করে ভিন্ন মাত্রা। সুতি, গরদ কিংবা জামদানি শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে খোঁপায় সাদা ফুল, সোনার গয়না আর আলতা, সিঁদুরে মনভোলানো বাঙালি নারীর রূপ।
পূজার সাজে প্রকৃতির সঙ্গে মিল রেখে স্বাভাবিক ও সতেজ ভাব বজায় রাখুন। মেকআপ যতটুকু না করলেই নয়, ততটুকুই করুন। কারণ, পূজোর এই সময় প্রচুর কাজ ও ঘোরাঘুরিতে বারবার মেকআপ ঠিক করার সময় নাও মিলতে পারে। পার্লারে যেয়ে মেকআপ করার সুযোগ পাবেন না অনেকেই। তাই চেষ্টা করুন হালকা মেকআপে স্নিগ্ধ ভাব বজায় রাখতে। যেহেতু এখনও বেশ গরম তাই মেকআপের আগে প্রাইমার লাগাতে ভুলবেন না। প্রাইমার মেকআপকে অনেকক্ষণ ধরে রাখবে।
এরপর বেইজ হিসেবে ত্বকের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে ফাউন্ডেশন, সেটিং পাউডার দিন। চোখে নীচে, ঠোঁটের চারপাশে বা নাকের পাশে প্রয়োজনে কনসিলার লাগান। এতে ত্বক আরও বেশি নিখুঁত দেখাবে।
কন্ট্যুরিং করতে না চাইলে বা না পারলে ব্রোঞ্জার দিয়ে কপোলের হাড়ের নীচে, চূলের গোঁড়া ঘেঁষে কপালের চারদিকে, নাকের দুইপাশে ও চিবুকের নীচে ব্রোঞ্জার দিয়ে মুখে ধারালো ভাব আনুন। হালকা গোলাপি বা পিচ ব্ল্যাশঅনে ফুটিয়ে তুলুন গালের রক্তিম আভা। শাড়ির সঙ্গে চোখে গাঢ় করে কাজল আর মাশকারাতেই ভালো লাগবে। তবে রাতের সাজে চোখে রঙিন আইশ্যাডো মানিয়ে যাবে দারুণ। লিপস্টিক বেছে নিন পোশাকের রঙ অনুযায়ী।
দূর্গা পূজা শুধু সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উৎসব নয়, বাংলার ঐতিহ্যের মিশেলে এই উৎসব সার্বজনীন। তাই তো ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পূজামন্ডপ আর পূজা ঘিরে চলা মেলায় ভিড় জমে বাঙালির। নানা রুপে, নানা সাজে শারদীয়া দুর্গোৎসব তাই বাঙালির জীবনের অন্যতম আনন্দের উপলক্ষ।
মডেল- ডা. সঙ্গিতা হালদার, পূজা এবং সারিকা সাবা
ছবি – আবদুল্লাহ আল মামুন এরিন