আমাদের ‘বালি দ্বীপ’
২৫ আগস্ট ২০১৯ ১৩:৪৪ | আপডেট: ২৫ আগস্ট ২০১৯ ১৫:২৬
ঢাকা থেকে রওনা করেছি বাসে। রাতের অন্ধকারের সঙ্গে কাটাকুটি খেলা শেষে গাড়ি থামে পটুয়াখালীর গলাচিপায়। বাস থেকে নেমে নদী পাড় হই। ফোনে সহযোগিদের আমাদের উপস্থিতি সম্পর্কে জানিয়ে দিই। সহযোগিরা আমাদের পেট ভরে খেয়ে নিতে বললেন। সামনে দরিয়া, অকুল পাথার।
ধান, নদী, খাল- এই তিন মিলে বরিশাল। ভাতঘরে ঢুকে আমরা নদীর মাছ আর ভাত চাইলাম। আমাদের সামনে এলো বাটা, চিংড়ি ও শিং মাছ। সঙ্গে সবজি আর ডাল। খাবার পরে দই মিষ্টি খেলাম।
এবার আমরা মোটর সাইকেলে চেপে বসলাম। গন্তব্য পানপট্টি। পাশা ভাই আগেই ট্রলার ঠিক করে রেখেছিলেন। আমরা ট্রলারে উঠলাম। দিনটি ছিল ১৪ এপ্রিল, পহেলা বৈশাখ। আমরা তখন তেতুলিয়া নদীতে ভাসছি। আর কয়েক ঘন্টা বাদে দেখা মিলবে বঙ্গোপসাগরের।
ট্রলার অনেকক্ষণ চলার পর মাঝি ভাই বললেন, এবার নদীতে গোসল দেন। আমরা ঝাঁপিয়ে পড়লাম জলে। স্নান শেষে ট্রলার আবার চলতে শুরু করলো। এবার পেলাম রাঙাবালি বাজার। কোস্টাল বেল্টের বাজার কেমন হয় তা দেখতে ট্রলার থামিয়ে গেলাম বাজারে। অনেক তরমুজ দেখলাম বাজারে। ঢাকার মেহমান বলে একজন বিক্রেতা আমাদের পাঁচটি তরমুজ ফ্রি দিলেন।
বাজারে দই মিষ্টি খেলাম। এই মজাদার মিষ্টি এসেছে বাহেরচর থেকে। এরপর চা খেলাম। সেখানে আমাদের কোনো টাকা গুনতে হয়নি। তাদের অতিথিপরায়ণ মনোভাব আমাদের মুগ্ধ করলো।
বাজার থেকে যখন বের হই তখন সন্ধ্যা। মাঝি ভাই বললেন, রাতের খাবার হবে হাঁসের গোস্ত। আমি বললাম, আরও কিছুদূর যাই আমরা। তিনি বললেন, আরেকটু গেলেই দরিয়া। এই জায়গাটি খোলামেলা। রান্না করতে সুবিধা হবে। লোকজনও আছে অনেক। রাতে নিরাপদে থাকা যাবে।
ফলে চর তুফানিয়ায় রাত্রিযাপন আপাতত করা হলো না। আমাদের অবশ্য নূনতম ভয়ও ছিল না। কিন্তু মাঝিদলের কেউ আমাদের সঙ্গী হলেন না। আমরা বুঝলাম, এইদিকে শুধু ডাকাতের ভয়ঙ্কর গল্পই শোনা যায়। বাস্তবে ওসব কিছু নেই বললেই চলে।
রাত হয়ে গেছে। হাতে সময়ও আছে। আমরা পাড়াটি ঘুরে দেখার কথা ভাবলাম। তবে দূরে যাওয়ার কোথাও না। কাছাকাছি আছে ছোট বড় অনেক লঞ্চ ও ট্রলার দেখলাম। সবগুলোতেই তরমুজ বোঝাই করা। আশেপাশের লোকজন আমাদের ডেকে নিয়ে গল্প করলেন। চা, বিস্কুট খেতে দিলেন। হাসি গল্পে ভাল সময় পার করলাম।
ভোর হয়ে গেছে। শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশ। মাঝি ভাই চা, বিস্কুট খেতে দিলেন। তারপর ট্রলার ছেড়ে দিলেন। সকালে নদীপথের যাত্রা নরম এবং মসৃণ। স্নিগ্ধ মায়াময় মুগ্ধতা। ঘন্টাখানেক পর একটি বাক পেলাম। তারপর যা দেখলাম, চোখ ছানাবড়া। সমুদ্রের সাদা ঢেউ আর সবুজ বনে অনেকগুলো দ্বীপ। একেবারে দাগহীন নির্ভেজাল সুন্দর। এ যেন দেশে বসেই বিদেশ দেখার মতো!
ট্রলার চলছে। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। চর তুফানিয়ায় ট্রলার থামলো। চরের চারদিকে মিহি দানার চিনির মতো সাদা সৈকত। সৈকত জুড়ে আছে লাখে লাখ লাল কাঁকড়া। দেখে আনন্দের সীমা থাকে না।
সৈকতে নেমে কাঁকড়ার দলগুলোকে কোনোরকম বিরক্ত না করে শুধু ছবি তুললাম। এবার আমরা ঝাউবনে গেলাম। ঝাউবনের নীচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চকচকে সাদা বালিকুঞ্জ। এক অদ্ভুত অনুভূতি হলো। পুরো বন ঘুরে এসে দাঁড়ালাম চরের দক্ষিণ সৈকতে। সাদা বালি, লাল কাঁকড়ার দৌড়ঝাঁপ, সাগরের ঢেউ আর স্নিগ্ধ বাতাস। এসব দেখে মনের সব ক্লান্তি নিমিষেই দূর হয়ে গেল।
যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম তার দক্ষিণে আর কোনো দেশ নেই। একদম শেষে এন্টার্কটিকা। শুধু ডানে শ্রীলংকা ওবাঁয়ে মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া। সমুদ্র সৈকতে আমরা শরীরটা একটু ভিজিয়ে নিলাম। কব্জি ভরা জল মুখে মাখলাম। সমুদ্রের নীল জল। মনে প্রশান্তি এনে দিল।
এবারের ভ্রমণে আমরা তিন বন্ধু। সোহেল, শাকের এবং আমি। সমুদ্র দেখে আমরা জোয়ার-ভাটা নিয়েও ব্যাপক আলোচনা চালিয়ে গেলাম ক’টা দিন।
একবার সাগরের বেশ কিছুটা দূরে আমাদের চোখ পড়লো। বালির ঢিবির মতো কিছু একটা দেখতে পেলাম। মাঝি ভাইকে ওখানে নৌকা নিয়ে যেতে বললাম। তিনি সাগরের জোয়ারের ভয় দেখালেন। আমরা তাকে জোর করে নিয়ে গেলাম। ঘন্টাখানেক লাগলো পৌঁছাতে। সেখানে গিয়ে দেখলাম চকচকে নতুনের মতো একটি দ্বীপ। এ যেন সাগরের নিজস্ব খেয়ালে তৈরি উঠোন বাড়ি। দৈর্ঘ্যে এক কিলোমিটার ওপ্রস্থে আধা কিলোমিটার হবে।
দ্বীপের ধবধবে সাদা বালি, লাগোয়া নীল জলরাশি, সিগাল পাখির মুক্ত ওড়াউড়ি আর মিষ্টি বাতাস। অনেক রোদ, কিন্তু গায়ে লাগছে না। এই সৌন্দর্য বর্ণনার ভাষা পাওয়া আসলেই কঠিন।
আমরা সাগরের নীল জলে স্নান সারলাম শেষবারের মতো। তারপর সমুদ্রপথে ও পরে তেতুলিয়া হয়ে ফেরার পথ ধরলাম।
ছবি- লেখক
সারাবাংলা/টিসি