Wednesday 01 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নিউইয়র্কের টেনেমেন্ট মিউজিয়াম : বিভিন্নতার ইতিহাস


৩১ জুলাই ২০১৮ ১১:৪৬ | আপডেট: ৩১ জুলাই ২০১৮ ১১:৪৮

টেনেমেন্ট হাউজের বাইরের দৃশ্য

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।।

নিরেট বেড়ানোর জন্য ঢাকার বাইরে বা বিদেশে যাওয়া হয় কম। মুলত পেশা সংশ্লিষ্ট কাজেই যেতে হয়, যাওয়া হয়। তবে পরিবার নিয়ে যে একেবারে যাইনা তাও নয়। ফিরে এসে ভ্রমণ নিয়ে লেখার কথা আর মনে থাকেনা ব্যস্ততার কারণে।

মাত্র কিছুদিন হয় ফিরেছি আমেরিকা থেকে। ওয়াশিংটনে দেখা বন্ধুদের কথা, আর নিউইয়র্কের দেখা আত্মীয়, বন্ধু আর বাঙালিদের মুখ মনে পড়ছে বেশ। ওয়াশিংটনের জীবন যতটা কর্পোরেট, নিউইয়র্কে বাংলাদেশিদের জীবন চর্চা তার চেয়েও বেশি আঞ্চলিক। আমাদের বিভাজিত রাজনীতি সেখানেও উত্তাপ ছড়ায়, যেকোন কিছুতে দুই দল হয়ে হল্লা করা চলছেই। তবে আমাদের রাজনীতি সেদেশে নিয়ে গিয়ে কি উদ্ধার করছে তারাই বলতে পারবেন যারা রাজনীতিটা সেখানে করছেন।

রাজনীতি ছাড়াও দেশীয় উপাদানের আরেক উপস্থিতি হলো সমিতি চর্চা। বাংলাদেশের সব জেলা, উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন নিয়ে সমিতি আছে, বিভেদ আছে, কুৎসা আছে, ঝগড়াঝাটি আছে। সব আছে, নেই কেবল আমেরিকার মুল স্রোতে নিজস্বতা তৈরীর উদ্যম ও প্রতিজ্ঞা। হয়তো কিছু কিছু ব্যাক্তি ও পরিবার সেই চেষ্টা করছেন, কিন্তু তার সংখ্যা নগন্য।

অভিবাসীদের দেশ আমেরিকা। গত ২০০ বছরে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে নানা জাতিগোষ্ঠী এসে দেশটিতে এসে বসত গড়েছে। আর নিউইয়র্ক হলো অভিবাসীদের রাজধানী। বাংলার জনপদ থেকে আসা আমাদের মানুষগুলোও এক সক্রিয় অভিবাসী গোষ্ঠী। চায়না টাউন আমেরিকার যেকোনো বড় নগরীর এক পরিচিত নাম। তেমনি নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস হয়ে উঠেছে এক বাংলাদেশ জনপদ। জ্যাকসন হাইটসের ডাইভার্সিটি প্লাজায় কয়েক মিনিট দাঁড়ালে চোখ পড়বে অসংখ্য পরিচিত মুখ, কথাও হবে গুলিস্তান স্টাইলে।

বিজ্ঞাপন

তবে এবার আমেরিকায় যেটি মনে রাখবার মতো হয়েছে তা হল, টেনেমেন্ট মিউজিয়ামের সন্ধান পাওয়া। সাধারণ কোন জাদুঘর নয়, কিছু পরিবারের স্মৃতি ধরে রেখে সমগ্র অভিবাসীর প্রতি মার্কিন সমাজের মমত্ববোধ প্রকাশের প্রতীক এই টেনেমেন্ট এপার্টমেন্ট মিউজিয়াম। কিছু ছোট যেমন অনেক বড় তাৎপর্য বহন করে, এই এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সটিও তাই।

ম্যানহ্যাটানের অর্চার্ড রোডে ১৮৬৩ সালে গড়ে ওঠা এই কমপ্লেক্সে গেলে চোখে পড়বে ১৮৭০ সালের সেলুন যেটি পরিচালনা করত জার্মান অভিবাসীরা, কিংবা ইহুদী পোশাক শ্রমিকের কোন ঘর। ঠিক যেমনটি ছিল, তেমন করে আজও আছে অটোমান সাম্রাজ্য থেকে আসা ১৪ বছরের ভিক্টোরিয়া কনফিনোর ঘরটি।

টেনেমেন্ট মিউজিয়াম

এক ছাদের নীচে নানা দেশের অভিবাসীদের জীবন দেখতে হলে যেতে হবে সেই মিউজিয়ামে যেখানে দুই বোন – বাবা মায়ের সাথে নতুন এক দেশে এসে নিজের স্বপ্নের ভুবন গড়েছিল। ১৯৪৫-এ ফ্রান্কফোর্ট -এর বাস্তুচ্যুত মানুষের ঠিকানা যেমন হয়ে উঠেছিল এই এপার্টমেন্ট, তেমনি পুয়ের্তো রিকান সায়েজ-ভেলেজ পরিবারের ঠিকানাও হয়ে উঠল এটি কোন এক সময়। এই পরিবারের সদস্যরা ১৯৬৪ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত এখানে থেকেছে। তাদের কন্যাদের শোবার ঘর, তাদের প্রথম টেলিভিশন আর তাদের সাজানো ডাইনিং টেবিল একজন পর্যটককে সহজেই তাদের করে নেয়। কন্যাদের পড়ার টেবিলে নানা ধরণের বই, রং পেন্সিল, কলমের সাথে এখনো আছে তাদের ব্যবহার করা ছোট্ট জুয়েলারির কৌটা। প্রথম টেলিভিশন কেনার পর সেটিকে ধরে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার মায়ের ছবি বুঝিয়ে দেয় কষ্ট করে কোন কিছু অর্জনের আনন্দ। অনুরোধ করলে তাদের বাবার গানের যন্ত্রে এখনো বাজানো হয় সেসময়ের কোন সুর।

বিজ্ঞাপন

টেনেমেন্ট মিউজিয়াম

এক চিনা পরিবারের উপস্থিতি এই ভবনে যোগ করেছে নতুন এক ইতিহাস। চিন থেকে হংকং হয়ে আসা ওয়াং পরিবার আমেরিকার পোশাক শিল্পের অংশ হয়ে আছে। এই পরিবারটি ও তার বংশধরেরা এখানে থেকেছে ১৯৬৮ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত। এই ঘরেরই এক অংশ এখনো আছে মিসেস ওয়াং-এর পোশাক কারখানাটির রেপ্লিকা, সেসময়ের ডিজাইনার্স চয়েস ক্যাটালগ। আর যারা ছিল এই কমপ্লেক্সে তাদের পরিবারের কমপক্ষে একজন সদস্য কাজ করেছে এই পোশাক কারখানায়।

টেনেমেন্ট মিউজিয়াম

ওয়াং পরিবারের চার সন্তানের মধ্যে ছেলে দুটি জন্ম নিয়েছে আমেরিকা আসার পর। তাদের এপার্টমেন্টে গেলে ৭০-এর আমেরিকার আঁচ পাওয়া যায় – নীল-সাদা লিনোলিয়াম মেঝে, টাইপরাইটার, নীল বিছানার পাশে জানালায় অরগাঞ্জা পর্দা, সন্তানদের স্কুল থেকে পাওয়া নানা ট্রফি।

রেপ্লিকা করা ছোট পোশাক কারখানায় এখনো আছে সেই আসল রাইস কুকার আর চায়ের সরঞ্জাম, সেই সময়ের সেলাই মেশিন, তখনকার ব্যবহৃত কাপড়, ডিস্কো স্যুট। আছে একটি নোটিশ বোর্ড যেখানে এখনো ঝুলছে, পোশাক শ্রমিক ইউনিয়নের বুলেটিন। সবই এখন অতীত, কিন্তু মিসেস ওয়াং এখনো স্মরণীয় আমেরিকার পোশাক শ্রমিক ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে।

টেনেমেন্ট মিউজিয়াম

টেনেমেন্ট হাউজ আমেরিকায় আসা অভিবাসীদের শিখিয়েছিল কিভাবে অজানা মানুষ একে অন্যের প্রতিবেশি হয়ে আপনজন হয়ে উঠতে পারে। জনসমাজে চলিষ্ণুতাই যে আসল কথা, তার ধাক্কায় সব আতঙ্ক চুরমার হয়ে যায় সেকথা অভিবাসীদের চাইতে আর কে বেশি বোঝে? টেনেমেন্ট হাউজে গেলে সেই সত্য উপলব্ধি করা যায়। কত দেশের মানুষ এসেছে, চলে গেছে, কতভাবে জীবন ধারণ করেছে, তার ছোট্ট পৃথিবী টেনেমন্ট হাউজ। সবাই যে শুধু খাওয়া-পরা এবং বেঁচে থাকার সুবিধার্থেই এসেছিল তা নয়। ঘুরতে এসেও অনেকে আর ফেরেনি নিজ নিজ দেশে। এরা প্রত্যেকে বিভিন্ন দেশ আর জনপদ থেকে ভিন্ন মানুষ, কিন্তু তারা হয়ে উঠেছিল একে অন্যের সুখ দু:খের সাথী।

ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষরা সেখানে মুশকিল বোধ করেনি কখনো। সেই বিভিন্নতাকে কি করে এক করে রেখেছিল একটি সমাজ, জানতে হলে যেতে হবে টেনেমেন্ট মিউজিয়াম।

লেখক- এডিটর ইন চিফ, সারাবাংলা.নেট, দৈনিক সারাবাংলা ও জিটিভি

সারাবাংলা/আরএফ

অভিবাসী ইতিহাস টেনেমেন্ট মিউজিয়াম টেনেমেন্ট হাউজ নিউইয়র্ক ভ্রমণ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর