Thursday 16 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সাংবাদিকদের ‘ঝিঙে’ চিন্তা বনাম জনস্বাস্থ্য

সৈকত আব্দুল্লাহ
৮ নভেম্বর ২০২২ ১৬:৫৪ | আপডেট: ৮ নভেম্বর ২০২২ ১৯:৩২

সম্প্রতি দেশের অন্যতম সেরা নিউজ চ্যানেল একাত্তর টেলিভিশনের আলোচিত ও সমালোচিত একটি আলোচনা অনুষ্ঠান দেখেছি। দেখেছি বলতে অনুষ্ঠানটি ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা সমালোচনা দেখেই অনুষ্ঠানটি খুঁজে দেখা। অনুষ্ঠানে সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টির কী সাংঘাতিক অবৈজ্ঞানিক যুক্তি- ‘বেগুন নিয়ে কেন, পাশের খেতে তো ঝিঙে ছিলো!’ তার মতে, ‘সায়েন্টিফিক রিপোর্টস’ জার্নালে প্রকাশিত জনস্বাস্থ্য বিষয়ক একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা নিবন্ধের ফল গণমাধ্যমে বা দেশের জনগণের সামনে নিয়ে এসে ফৌজদারি অপরাধ করেছেন গবেষক!

বিজ্ঞাপন

জার্নালটির প্রকাশক ন্যাচার পোর্টফোলিও। উইকিপিডিয়াতে ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর দেখাচ্ছে ৪.৯৯৬ (২০২১)। সুতরাং, এখানে প্রকাশিত গবেষণাপত্রের মান উপলব্ধি করতে বেগ পেতে হয় না। বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. জাকির হোসেনের নেতৃত্বে বাকৃবির এক দল গবেষক বেগুনে লেড, ক্যাডমিয়াম, নিকেল প্রভৃতি ভারী ধাতুর উপস্থিতি সনাক্ত করেছেন, যেগুলো মানবদেহে বিরূপ প্রভাব ফেলতে সক্ষম। গবেষণার জন্য জামালপুরের ইসলামপুর ও মেলান্দহ উপজেলার ২০টি স্পট থেকে ৮০টি বেগুন ও ৬০টি শীর্ষ মাটির নমুনা সংগ্রহ করেন তারা। ন্যাচারের ওয়েবসাইটে ঢুঁ মেরে গবেষণা নিবন্ধটি পড়লাম। নিবন্ধে গবেষক দল জানিয়েছে, লেড ও ক্যাডমিয়াম যথাক্রমে ৭৫% ও ১০% বেগুন স্যাম্পলে ফাও/হু এর যৌথ অনুমোদিত মাত্রা অতিক্রম করেছে। আর নিকেলের পরিমাণ অনুমোদিত মাত্রার মধ্যেই রয়েছে। সব স্যাম্পলেই লেড ও নিকেল এবং ৪০% স্যাম্পলে ক্যাডমিয়াম পাওয়া গেছে। অবশ্য রান্নার পর বেগুনে ধাতুগুলোর পরিমাণ নিয়ে কোনো কাজ হয়নি। নানা দিক বিবেচনা করেই নিবন্ধে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে বলা হয়। সাংবাদিক ভাট্টি গবেষণা নিবন্ধের এই সাধারণ কথাও জানেন না। এটাকে তার ‘ভেইগ কথাবার্তা’ মনে হয়েছে বলে তিনি উন্মুক্ত অনুষ্ঠানে বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. জাকির হোসেনের মুখের ওপর বলে দিয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

এই তিনজন সাংবাদিকের চিন্তার পরিধি নিয়ে বিশদ আলোচনায় না গিয়ে আমরা এতটকু আশা তো করতেই পারি যে গবেষণার এই ফল আমাদের নীতিনির্ধারকদের ভাবাবে। আতঙ্কিত না হয়ে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে একে গ্রহণ করতে হবে আমাদের। আমরা অবশ্যই চাইবো না দীর্ঘদিন ধরে বিরামহীনভাবে ক্ষতিকর বেগুন খেয়ে মানুষের স্নায়ুতন্ত্রে জটিলতা আসুক। লিভার, ফুসফুস, কিডনি, হৃৎপিণ্ড রোগাক্রান্ত হোক বা মরণব্যাধি ক্যান্সার হোক কারো। ভারী ধাতব দূষণ ও মানবস্বাস্থ্যে তার ক্ষতিকর প্রভাব অস্বীকার বা এড়িয়ে চলার অর্থ জনস্বাস্থ্যে বিপর্যয় ডেকে আনা। যে ভারী ধাতুগুলোর উপস্থিতি ধরা পড়েছে স্থান দুটির বেগুনে, সেগুলোর ক্যান্সার ও নানা রোগ সৃষ্টির বৈজ্ঞানিক প্রমাণিত সক্ষমতাকে বিবেচনায় নিয়েই দূষণ রোধে কাজ করতে হবে।

শুধু জামালপুরের বেগুন নয়, যে হারে গত কয়েক দশকে ভারী ধাতব দূষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে দেশের অন্যান্য স্থানে সন্তোষজনক ফল পাওয়ার সম্ভাবনা জোরালো নয়। বিশেষত শিল্পবর্জ্যর নিকটস্থ মাটিতে চাষ করা ফসলে ভারী ধাতু আশঙ্কাজনক মাত্রায় থাকার সম্ভাবনাই বেশি। নানা গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বিভিন্ন সবজি যেমর- আলু, মূলা, ঢেড়স, ফুলকপি ভারী ধাতব দূষণপ্রবণ। তাই এসব সবজিতে ভারী ধাতব পদার্থের পরিমাণ নির্ণয় ও তার ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে গবেষণা করা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। এখন রাষ্ট্রের কর্তব্য হলো, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে এ সংশ্লিষ্ট গবেষণার কাজে অর্থায়ন বাড়ানো। এমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র অবশ্যই নিশ্চিত করবে দীর্ঘদিন যেন এই বেগুন অবিরাম গ্রহণ না করে দেশের জনগণ। এবং রাষ্ট্র একইসঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে নিশ্চিত করবে যেন ইসলামপুর ও মেলান্দহ উপজেলা সহ পুরো দেশে খাদ্য শৃঙ্খলে ভারী ধাতুগুলো দূষিত মাত্রায় উপস্থিত না থাকে।

গবেষকগণ প্রথমে প্রধান শস্য বা সবজির উপর কাজ করবেন, এটাই স্বাভাবিক। তাই ভবিষ্যতে কেবল বেগুন নয় ঝিঙে নিয়েও কাজ হবে। আর কোনো প্রধান সবজি বা শস্যে ভারী ধাতুর উপস্থিতি ধরা পড়া মাত্রই সেটা খাদ্য তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে বিষয়টি অত সরল নয়। প্রধান একটি সবজি নিয়ে এমন এক্সপেরিমেন্ট সম্ভবও নয়। বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে আছে বেগুন এবং তা পরিহারে একটি বড় জনগোষ্ঠীর পুষ্টি নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। কারণ এতে শুধু ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান নেই, সঙ্গে কপার, জিঙ্ক, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ ইত্যাদি পুষ্টি উপাদানও বিদ্যমান। বেগুনের দাম যদি পড়ে যায় তার জন্য বিজ্ঞানীরা দায়ী- মাসুদা ভাট্টিদের এমন অবান্তর কথাবার্তা। জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতির যদি কোনো ক্ষতি হয় তার জন্য দায়ী তাদের চিন্তার অধীনতা, ঝুঁকি বাড়াবে সেটাই; গবেষকের গবেষণার ফল নয়।

কিন্তু কেন মাটি থেকে উদ্ভূত সবজিতে বিষাক্ত পদার্থ জমা হচ্ছে? নিবন্ধে গবেষক দল মনে করেন, দূষিত পানি, রাসায়নিক সার, ধাতব কীটনাশক থেকে ভারী ধাতুগুলো মাটিতে আসতে পারে। উদ্ভিদ মূল রোম দিয়ে মাটি থেকে খনিজ লবণ শোষণ করার সময় এসব ভারী ধাতুও শোষণ করে নেয়। শিল্পকারখানাগুলো গ্যালন গ্যালন রাসায়নিক বর্জ্য খাল-বিল, নদীতে ছেড়ে দিচ্ছে আর এই দূষিত পানিই আবার সেচে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিভিন্ন উৎস হতে উৎসারিত ভারী ধাতব বস্তুগুলো শেষ পর্যন্ত মাটিতে জমা হয়ে খাদ্যশৃঙ্খলে প্রবেশ করে আমাদের খাদ্যকে বিষাক্ত করে তুলছে।

গবেষকগণ বছরের পর বছর এই কারণগুলোর কথা বলছেন, অথচ দেশের সরকারের পক্ষ থেকেই ক্রমবর্ধমান পরিবেশ দূষণকে অস্বীকার করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এতে তাদের কী হীন স্বার্থ রক্ষা পায় তা তারাই ভালো জানেন। কিন্তু আমরা জানি, এতে দেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে; দেশের অর্থনীতিও ক্রমে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, গণমাধ্যমের একটি অংশও একই কাজ করছে। দেশের ক্রমবর্ধমান পরিবেশ দূষণের বৈজ্ঞানিক প্রমাণিত বিষয়টিকেও তারা অস্বীকার করতে পারেন। শুধু অস্বীকার নয়, গবেষক ও গবেষণার প্রতি শিষ্টাচার বহির্ভূত আচরণ করে রীতিমতো অবমাননা করতে পারেন। গবেষণা, জার্নাল- এসব সাধারণ বিষয় না জেনে একজন সাংবাদিক এক বিজ্ঞানীকে অসম্মানজনকভাবে জেরা করতে পারেন।

অনুষ্ঠানটিতে দেখলাম, গবেষক বারবার জার্নালের নাম বলেন অথচ পুনরায় জার্নালের নাম জানতে চান সাংবাদিক। এতে বোঝা যায় সুপরিচিত ও প্রসিদ্ধ ‘সায়েন্টিফিক রিপোর্টস’ জার্নালের নামই কখনো শোনেননি তিনি। মিথিলা ফারজানার মতে, জার্নাল নয়, আর্টিকেলটি পাবলিক করার আগে আরও নানামাধ্যমে মূল্যায়িত হয়ে আসতে হতো। গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশের ক্ষেত্রে গবেষণা-জার্নালের চেয়েও বড় মাধ্যমের খোঁজ পেয়েছেন সাংবাদিকরা। ভাট্টি তো গবেষকের কাছ থেকে বেগুন চাষীদের ক্ষতিপূরণও নিতে চান। টিভি চ্যানেলে লাইভে এসে সাংবাদিকের এমন মনুষ্যত্ব-বর্জিত আচরণ অভূতপূর্ব। যেন তারা বোঝাতে চান, দেশে ক্রমবর্ধমান পরিবেশ দূষণকে অস্বীকার করাই সর্বোত্তম পন্থা। তাই খাদ্যে ভারী ধাতুর উপস্থিতি অস্বীকার করাই শ্রেয়।

ভাবনাটা যেন এমন- জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়ুক, তাতে আমার কী! আমার অত্যাধুনিক চিকিৎসার জন্য তো আমেরিকা-ইউরোপ-সিঙ্গাপুর আছে। তুমি না হয় নানা জটিল রোগে ভুগে ধুঁকে ধুঁকে মরো! কী সঙ্কীর্ণ ও অমানবিক ভাবনা তাদের! স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে তারা। চিন্তার অধীনতা মানুষকে কী হীন, কী নির্লজ্জ, কী বিপজ্জনক করে তুলতে পারে তার স্মারক হয়ে থাকবে একাত্তর টিভির সেই অনুষ্ঠানের ভিডিওটি। অপসাংবাদিকতায় ডুবে থাকা অধীন চিন্তার মানুষগুলো একটি দেশের জন্য কতটা ক্ষতিকর হতে পারে, ভাবতেই গা শিউরে উঠে। তারা ক্ষুদ্র স্বার্থে বিকিয়ে দিয়েছে তাদের মননশীলতা। নিজেদের হীন স্বার্থ বজায় রাখতে গিয়ে জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ আলোচনায় তারা বিজ্ঞানভিত্তিক সত্য অস্বীকার করতে পারেন অবলীলায়; অবলীলায় ভয়ানক দূষণ পরিস্থিতি এড়িয়ে যেতে চান।

মিথিলাদের মতে, বেগুনে ভারী ধাতব দূষণ অবস্থা সরকারের পাবলিক করার দরকার নেই। যেন এটা ‘পাবলিক কোনো কনসার্নই নয়!’ খাদ্যশৃঙ্খলে ভারী ধাতব দূষণের ফলে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা যেখানে হুমকিতে পড়তে পারে সেই জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও জনগণের জানার দরকার নেই! আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে গবেষণার মূল্যায়ন প্রত্যাশার ধারে কাছে তো নেই-ই, গণমাধ্যমেও তার মূল্যায়ন প্রশংসনীয় নয়, বরং আমাদের দেখতে হলো অবমূল্যায়ন, অপমান।

লেখক: শিক্ষার্থী, প্লান্ট বায়োটেকনোলজি শাখায় এমএস পরীক্ষার ফল প্রত্যাশী, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

টপ নিউজ মুক্তমত সাংবাদিকদের ‘ঝিঙে’ চিন্তা বনাম জনস্বাস্থ্য সৈকত আব্দুল্লাহ