পলাশীর অজানা কাহিনী
২৩ জুন ২০২৪ ১২:১০
বাংলার ইতিহাসে একটি নিন্দিত চরিত্র মীরজাফর। সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে তার বিশ্বাসঘাতকতা ও নিঃস্পৃহতার কারণে বাংলার নবাবের করুণ পরাজয় হয়। তার সৈনিকরা দারুমূর্তির মতো দাঁড়িয়েছিল। তারা একটু তৎপর হলে ইংরেজদের তিন হাজার সৈনিকের ছোট্ট একটি বাহিনী দাঁড়াতেই পারত না। ইতিহাসের আলোকে পলাশীযুদ্ধে কী ভূমিকায় ছিল মীর জাফর, অনুসন্ধান করে দেখা যাক।
দিল্লি থেকে আসা এক ভবঘুরে ভাগ্যান্বেষী যুবক মীর জাফর আলী খান পরবর্তীতে ইতিহাসে মীর জাফর হিসেবে পরিচিতি পান। সে আমলে এসব ভবঘুরে তুর্কিদের প্রশ্রয় দেওয়া হত না। তারপরও মহানুভব নবাব সুজাউদ্দিন তার সৈন্যবাহিনীতে তাকে চাকরি দেন একেবারে নিম্নপদস্থ সৈনিক হিসেবে। তারপর নিজ গুণেই সে উপরের দিকে উঠতে থাকে। বিশেষ করে বাঁকিবাজার থেকে অস্ট্রিয়দের হটিয়ে দিয়ে দারুণ সাফল্য দেখায়। পদোন্নতি পেয়ে হয় জমাদার। বেতন বেড়ে হল ১০০ টাকা। তার দিকে চোখ পড়ে বিহারের সুবেদার মির্জা মোহম্মদ আলির। তিনি তার বৈমাত্রীয় বোন শাহখানুমের সঙ্গে তার সাদী দেন।
সুজাউদ্দিনের পুত্র সরফরাজউদ্দিন নবাব হলে সুজার নিয়োগপ্রাপ্ত অমাত্যরা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। এদের নাটের গুরু ছিলেন হাজী মির্জা আহম্মদ। যে কিনা মির্জা মোহম্মদ আলির বড় ভাই। হাজী ও অন্যান্য আমত্যের ইন্ধনে বিহারের সুবেদার বিদ্রোহ করে বসে। অজুহাত তার নাতির বিয়ে। এতে অসীমবিক্রমে লড়ে তার বৈমাত্রীয় বোনের স্বামী মীর জাফর। ক্ষমতায় আরওহণ করে মির্জা মোহম্মদ আলি হয়ে যান আলিবর্দি। সম্পর্ক ও দক্ষতার যোগফল হিসেবে সেই যুবক সুবেদার এক লাফে হয়ে যান মীরবক্সি। মীরবক্সি মানে প্রধান সেনাপতি। এসব ১৭৪০ সালের ঘটনা।
এরপর প্রায় ১২ বছর আলিবর্দিকে মারাঠাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়। এই যুদ্ধে তার সঙ্গে ছায়ার মতো ছিলেন মীর জাফর। তার স্বীকৃতি হিসেবে তাকে উড়িষ্যার সুবেদার বা ছোট নবাবও করা হয়। এর মধ্যে তার সৈন্য বিভাগের দুর্নীতি ধরা পড়ে। একবার আতাউল্লার সাথে আঁতাত করে আলিবর্দিকে ক্ষমতাচ্যুত করার অভিযোগ ওঠে। তাই আলিবর্দির আস্থা সরে যায় তার উপর থেকে। অন্যান্য রাজপুরুষের মতো মীর জাফরের শরাব আর নারীর প্রতি আকর্ষণ ছিল। সমকামেরও অভিযোগ আছে।
যাই হোক, ১৭৫৬ সালে আলিবর্দির মৃত্যুর পর তার নাতি সিরাজউদ্দৌলা নবাব হন। ২১ বছরের টগবগে যুবক সিরাজ স্বভাবগতভাবে সাহসী ও দুর্বিনীত। তিনি ক্ষমতায় বসেই পুরনো অমাত্যদের চক্র ভাঙতে শুরু করলেন। একরকম অপমান করেই তাদের বিদায় করতে থাকেন। প্রধান সেনাপতির পদ থেকে মীর জাফরকে সরিয়ে দিয়ে সাধারণ একজন সৈনিককে সে পদে বসান। অজ্ঞাতকুলশীল মোহনলালকে কুর্নিশ করার জন্য মীর জাফরকে বাধ্য করেন। এই নিয়ে মীর জাফরের সঙ্গে সিরাজের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। মীর জাফর ও অন্যান্য অমাত্যদের মনে এই ধারণা ছিল, আলিবর্দি পরিবারের উত্থান তো তাদেরই হাতে। সুজার সঙ্গে বেইমানি করে যাকে বসালাম, তার নাতি এতো স্পর্ধা দেখায় কী করে!
অমাত্যদের ক্ষোভ কাজে লাগায় ইংরেজরা। সিরাজও তা বুঝতে পারে। কোন ষড়যন্ত্রে যেন মীর জাফর অংশ নিতে না পারে, সেজন্য তাকে রাজধানীর বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ইংরেজদের একটা চালের কারণে আবার তাকে মুর্শিদাবাদ আনা হয়। তখন থেকে শুরু হয় মূল ষড়যন্ত্র। রাজধানীতে এসে মীর জাফর দেখা করতে যান নবাবের সঙ্গে। নবাব তাকে গালমন্দ করে বের করে দেন। তাকে কর্মচ্যুত করা হয়। এদিকে খবর রটে যায় যেকোনো সময় মীর জাফরকে গ্রেফতার করা হবে। মীর জাফর তার আত্মরক্ষার জন্য সৈন্যবাহিনী সংগ্রহ করতে শুরু করেন।
এদিকে সিরাজ যেদিন সকালে স্থির করলেন মীর জাফরকে গ্রেফতার করবেন, সেদিনই খবর এলো ইংরেজরা ধেয়ে আসছে যুদ্ধ করার জন্য। তিনি দেখলেন পুরনো সব অমাত্যরা দরবার ছেড়ে চলে গেছে। তার পরিবার ও দরবারের সবচেয়ে পুরনো লোক মীর জাফর। ওকে চটালে আখেরে তারই ক্ষতি। সে যুদ্ধের ময়দানে থাকলে সৈনিকদের মনোবল বাড়বে। রাজগৃহে ঐক্য থাকবে। তাই তিনি মীর জাফরকে গ্রেফতারের বদলে তোষণের নীতিতে গেলেন। ৬৬ বছরের বৃদ্ধ মীর জাফর জানালেন যুদ্ধ করার মতো শারীরিক সামর্থ্য তার নেই। সিরাজ শিবিরে থেকে কেবল সৈন্য পরিচালনার অনুরোধ করলেন। মীর জাফর তিন শর্তে যুদ্ধে যেতে রাজি হলেন-
১. তিনি আর নবাবের চাকরি করবেন না।
২. তিনি তার কাছে হাজিরা দেবেন না।
৩. তিনি ফৌজে মনসব নেবেন না।
এই তিন শর্ত দেখলেই বোঝা যায়, মীর জাফর নামকাওয়াস্তে যুদ্ধে যেতে রাজি হয়েছিলেন। যুদ্ধের সকল দায়-দায়িত্ব ছিল প্রধান সেনাপতি হাজী আব্দুল হাদী খানের উপর। মীর জাফর প্রধান সেনাপতি ছিলেন না।
যুদ্ধের শেষ পর্যায় যখন নবাবের ৫০ হাজার সৈন্যের বিশাল দল ইংরেজদের ৩ হাজার সৈন্যের ছোট্ট বাহিনীর সঙ্গে পেরে উঠতে পারছিল না, নবাব হাজির হন মীর জাফরের শিবিরে। তখন দু’জনের কথোপকথন একটু শোনা যাক। এই কথোপকথন ’কাসিদ’ উপন্যাস থেকে নেওয়া।
‘মীর মদনের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া মাত্র নবাব মাথায় হাত রেখে খাটিয়ায় বসে পড়লেন। তিনি মীরজাফর আর মোহনলালকে তাঁবুতে ডেকে পাঠালেন। কিন্তু মীরজাফর আসতে রাজি নন। একাধিকবার দূত পাঠানোর পর তিনি এলেন। সঙ্গে পুত্র মীরণ আর ভাগ্নে খাদেম হোসেন খান।
মীরজাফর নবাবের তাঁবুতে ঢোকা মাত্র ভয়-অস্থির তরুণ নবাব তার মাথার পাগড়ি খুলে মীরজাফরের পায়ের কাছে রাখলেন, আমি আমার আগে করা সকল অপকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আমাদের মধ্যে যে আত্মীয়তার বন্ধন আছে, আর আলিবর্দি খাঁর সমস্থানীয় বলে যে ভরসা আমি করি, আপনি আমার অতীতের খারাপ ব্যবহারগুলো ভুলে গিয়ে, সৈয়দ বংশোচিত মহত্ত ও কৃতজ্ঞতা নিয়ে আত্মীয়দের সঙ্গে ব্যবহার করুন। আপনার নিকট আত্মসমর্পণ করলাম। আমার জীবন ও সম্মান রক্ষা করুন।
মীরজাফর মনে মনে হাসল। এই নবাব কিশোরকাল থেকে নানার সাথে বিভিন্ন রণাঙ্গনে ঘুরে ঘুরে কিভাবে সেনাপতিদের বশে রাখতে হয় সেটা ভাল করেই শিখেছে। বর্ধমানে যখন আলিবর্দি বর্গিদের দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন, তখন তিনি সিরাজকে নিয়ে সেনাপতি গোলাম মুস্তফার তাঁবুতে গিয়ে এভাবেই কাকুতি মিনতি করেছিলেন। পরে ভাস্কর পণ্ডিতকে হত্যার সময় মনকরার শিবিরে একই কাণ্ড করেছিলেন। কিন্তু এতো ভাল মানুষ আলিবর্দির গোলাম মুস্তফার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে বেশি সময় লাগেনি। হত্যা করতেও। তাই বিপদে পড়লে এদের এক রূপ, বিপদ কাটলে ভিন্ন। কিন্তু তিনি মনের ভাব প্রকাশ না করে ভিন্ন কথা বললেন।
– নবাব, এসব কথা ছাড়ুন। আমি এখানে এসেছি আপনার জন্য লড়াই করতে। এখন বলুন আমি কী করব। আপনি আদেশ করুন।
– আপনি ইংরেজ শিবিরে আপনার অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে আক্রমণ করুন।
– এটা অসম্ভব। যুদ্ধের কৌশলের বিরুদ্ধে।
– মীর মদন, বাহাদুর আলী খানরা পারলে আপনি পারবেন না কেন?
– কারণ অভিজ্ঞতা। এদের অভিজ্ঞতা কম। আমি কুড়ি বছর ধরে যুদ্ধ করছি। না হয় এক ডজন বড় বড় যুদ্ধে ছিলাম। প্রত্যেক যুদ্ধেই এমন সব কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণের মুহুর্ত এসেছে। যে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে সেই জিতেছে। মণিহারীর যুদ্ধে শওকত জঙ্গের গোলন্দাজ প্রধান শ্যামসুন্দর যখন আহত হয়ে শিবিরে ফিরে আসে, তখন শওকত কারগুজার খাঁ’কে বাধ্য করেন অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে এগিয়ে যেতে। কারগুজার খাঁ’র মত ছিল না। ফলাফল হলো শওকত নিজেও প্রাণ দিলেন, পূর্ণিয়াও হারালেন। কিন্তু তিনি তা না করে মণিহারীর পথ দখল করে একমাস বসে রইলে আমরা পিছু হটতে বাধ্য হতাম। তাই হৈ চৈ করে কিছু করা ঠিক নয়।
– তাহলে আপনার পরামর্শ?
– এখন আর যুদ্ধ করার মতো সময় ও পরিস্থিতি নেই। আজকের মতো যুদ্ধ স্থগিত করুন। সৈন্যদলকে শিবিরে ফিরে আসতে বলুন। কাল আশা করি কামানের গোলাগুলো শুকিয়ে যাবে। আপনার বাহিনী গোলন্দাজ আক্রমণ শুরু করলেই আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ব।
– কিন্তু এরা যদি রাতের বেলা আক্রমণ করে বসে?
– তার জন্য চিন্তা নেই। আমি চারদিক থেকে শত্রুদের ঘিরে রাখব।
– আপনি আশ্বস্ত করছেন?
– জি। আপনি মোহনলালকে এখনই ফিরে আসার খবর পাঠান।’
পলাশী যুদ্ধে মীর জাফরের ভূমিকা নিয়ে এক ইংরেজ সেনাপতি স্ক্রাফটন লিখেছেন, আমাদের সাফল্যে মীর জাফরের অবদান কতটা সামান্য তা হয়ত তিনি নিজেই জানেন। কিংবা আমাদের হাতে সমস্ত চলে আসা সত্ত্বেও আমাদের বিনম্র ব্যবহারে তিনি হয়ত মুসলমান হিসেবে অবাক হয়ে গেছেন। তাই বিশ্বাস করতে পারছেন না যে আমরা তাকে এত উচ্চপদে বসাতে চাইছি। অনেক চেষ্টা করে মি. ওয়াটস ও আমি শেষ পর্যন্ত তাকে নবাবের গদিতে বসাতে সমর্থ হয়েছি।
পলাশীযুদ্ধে মীর জাফরের ভূমিকা নিয়ে চমৎকার কথা লিখেছেন ঐতিহাসিক সুশীল চৌধুরী, ইংরেজরা শেষ পর্যন্ত মীর জাফরের ওপর সম্পূর্ণ ভরসা রাখতে পারছিল না। সম্ভবত তার উদ্দেশ্য ছিল নিজেকে সম্পূর্ণ উন্মোচন না করে বেড়ার ধারে অপেক্ষা করা এবং যে দল শেষ পর্যন্ত জয়ী হবে তার সঙ্গে যোগ দেওয়া।
সূত্র:
১. পলাশীর অজানা কাহিনী, সুশীল চৌধুরী, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ২০১৬
২. পলাশীর ষড়যন্ত্র ও সেকালের সমাজ, রজতকান্ত রায়, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ২০১৭
৩. কাসিদ, জয়দীপ দে, দে পাবলিকেশন্স, ঢাকা, ২০২০
৪. বাঙ্গালার ইতিহাস, কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়, দে’জ পাবলিশিং, কলিকাতা, ২০০৩
সারাবাংলা/এসবিডিই