Saturday 11 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিশ্ব সংস্কৃতি দিবস: বৈচিত্র্যেই সৌন্দর্য


২১ মে ২০১৮ ১১:০৭ | আপডেট: ২১ মে ২০১৮ ১৩:২৯

।।জান্নাতুল মাওয়া।।

সন্ধ্যায় ঘরে ধূপ জ্বালানো, উলুধ্বনি দেওয়া-আমাদের সাধারণ মানুষদের যে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে এগুলো হিন্দুধর্মের আচার-অনুষ্ঠানের অংশ। কিন্তু ২০০৮ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবির গ্র্যান্ড জায়েদ মসজিদে গিয়ে মোটামুটি একটা ধাক্কাই খেলাম। দেখলাম আরব বিশ্বের অন্যতম ধনী এ দেশটিতে সন্ধ্যা হবার সাথেসাথেই মসজিদে ঢোকার মুখে ধূপ জ্বালানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কোনোমতে ধাক্কা সামলে গেলাম দুবাইয়ের পাশের এক ঐতিহ্যবাহী গ্রামে। গিয়ে দেখি, আরব নারীরা আনন্দউৎসবের মুহূর্তে ঠিক বাঙালি হিন্দু নারীদের মতো করেই উলুধ্বনি দেয়! আমার বিস্ময় তখন প্রায় আকাশ ছুঁয়েছে। পরে জানলাম, যে বিষয়টিকে আমরা এতকাল ধর্মের বৈশিষ্ট্য হিসেবে জেনে এসেছি সেটা পৃথিবীর অন্য  এক প্রান্তে, অন্য এক ধর্মের সংস্কৃতির অংশ।

বিজ্ঞাপন

সম্প্রতি থাইল্যান্ডের ব্যাংককে গিয়ে দেখি সব গাড়িতেই ফুলের মালা ঝুলছে। বিমানবন্দর থেকে আমাকে নেয়ার জন্যে যে গাড়িটি এসেছে তার চালক হিজাব পরা এক মুসলিম নারী। আমাদের গাড়ি যখন বিমানবন্দর থেকে হোটেলের দিকে ছুটছে ততক্ষণে আকাশে ভোরের আভা। কিছুক্ষণ পরে দেখি, নারীচালক পথের পাশে গাড়ি থামিয়ে একটি মালা কিনলেন, এরপর সেই মালায় চুমু দিয়ে গাড়ির রিয়ারভিউ মিররে ঝুলিয়ে দিলেন। তখনই কিছু আর জিজ্ঞেস করলাম না। দুবাইয়ের ঘটনায় আমার খুব শিক্ষা হয়েছে। পরে জেনেছি থাই গাড়িচালকরা যে ধর্মেরই হোন না কেন তারা ‘মায়ে  ইয়ানাং’ নামে ভ্রমণদেবীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে গাড়িতে সবসময় ফুল-মালা রাখেন।

সংস্কৃতি ব্যাপারটাই এমন। বছরের পর বছর এটি মানুষ থেকে মানুষে প্রবাহিত হয়। কখনো কখনো ধর্মের গণ্ডিকে ছাড়িয়ে যায় একটি নির্দিষ্ট সংস্কৃতির আচার আচরণ আর কাজ। আবার অনেক সময় অন্য অঞ্চল থেকে চলে আসা একটি ধর্মও একটি অন্য ভূমির সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে। অর্থাৎ ধর্ম, ভাষা, অঞ্চল ও নৃতাত্ত্বিক ভিত্তির ওপরে মূলত গড়ে ওঠে  সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য।

বিজ্ঞাপন

ধর্মীয় আচার আর সংস্কৃতির মাঝে সুক্ষ  রেখা টানা মাঝে মাঝে দারুণ কঠিন হয়ে পড়ে এইসব কারণেই।  আর তাই আমাদের দেশে প্রতিবারই পয়লা বৈশাখ এলে শুরু হয় অবধারিত তর্ক বিতর্ক।  আরও অনেক বিষয়েই আমরা তর্ক করি, মারামারি করি এমনকি মাঝে মাঝে কারও সঙ্গে দ্বিমত হলে  তাদেরকে মেরে ফেলতেও দ্বিধা করিনা। আমাদের এই মারমুখি আচরণের পেছনে রয়েছে আমাদের অজ্ঞতাপ্রসূত আচরণ। বৈচিত্র্য সম্পর্কে আমরা প্রচণ্ড অজ্ঞ বলেই ভিন্নমত গ্রহণ করতে আমাদের দারুণ কষ্ট।

আমাদের দেশে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য তেমন প্রবলভাবে নেই। এখানে ৯৮ ভাগ মানুষ বাংলায় কথা বলে, ৯০ ভাগ মানুষ ধর্মীয় বিশ্বাসের দিক থেকে মুসলিম। দেশের ৮০ ভাগ অঞ্চলই সমতল এবং এদের খাদ্যাভাসে তেমন কোন বড় পার্থক্য নেই। সবমিলিয়ে আমাদের দেশের মানুষের বিপুল সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের মধ্যে বেড়ে ওঠার সুযোগ খুবই কম। সাংস্কৃতিক এই বৈচিত্র্যহীনতার মাঝে বেড়ে ওঠার ফলে  আমাদের দেশে যে অল্পসংখ্যক ভিন্নধর্মের মানুষ আছেন তাদেরকেও আমরা অনেকেই ঠিক আমাদের বলে ভাবতে পারিনা। প্রায়ই গালি দিয়ে এই ‘মালাউন’দের ভারত পাঠিয়ে দেওয়ার ইচ্ছাপ্রকাশ করি। অর্থাৎ আমাদের মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা একটি ধারণা- এই মানুষগুলো এই দেশের না। এদের মুল দেশ ভারত। আর বাকি যে দুইভাগ  নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী রয়েছে তাদের ব্যাপারে আমাদের ধারণাতো আরো ভয়াবহ। পাহাড় বা আধা সমতলের এই ছেলেমেয়েরা যখন আমাদের সঙ্গে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসে আমাদের অনেকেই তাদেরকে ‘চিঙ্কু’  বলে বিমলানন্দ পাই। তাদের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে একইসাথে আমাদের মধ্যে রয়েছে বিপুল ঘৃণা এবং ব্যাপক আগ্রহ। অনেকে অতি কৌতূহলের বশে হাসতে হাসতেই তাদেরকে সরাসরি জিজ্ঞেস করি, তারা কি আজ সাপের মাংস বা কেঁচো ভাজি  দিয়ে ভাত খেয়ে এসেছে কি না।

অজ্ঞতার কারণেই আমরা সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ব্যাপারটিকে উপভোগ করতে না পেরে ভয় পাই। ঘরের ছোট শিশুটি যেমন প্রবল আগ্রহে ঘরে আসা নতুন অতিথির দিকে তাকিয়ে থাকে কিন্তু কাছে যায় না, বা কাছে গেলেও অতিথিকে কামড়ে দিয়ে আসে আমাদের অবস্থাও সেই শিশুদের মত। কথা হলো, আমরা আর কতদিন শিশুকালে থাকবো। বা এই শিশু অবস্থায় থাকাটা কি উচিৎ হবে কি না।

এমন একটা পৃথিবীতে থাকি যেটাকে আমরা আদর করে বলি গ্লোবাল ভিলেজ। তথ্য ও  যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতির ফলে আমাদের মাঝে এখন আর আগের মতো সেই দুরত্ব নেই। পড়াশোনা, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা উদ্দেশে আজকের মানুষ পৃথিবী চষে বেড়াচ্ছেন নিমেষেই। হয়তো আপনি বসে আছেন বাংলাদেশে, কাজ করছেন ইউরোপে বসে থাকা আপনার ব্যবসায়িক অংশিদার অথবা ঊর্ধ্বতনের সঙ্গে। কাজের খাতিরেই আপনাকে জানতে হবে নানা দেশের মানুষের সঙ্গে কথা বলার, কাজ করার কায়দা কানুন, তাদের পছন্দ অপছন্দ। পড়াশোনা করতে যাচ্ছেন পৃথিবীর অন্য প্রান্তে; আপনাকে সেই দেশটিতে টিকে থাকার জন্যে সেখানকার খাবারে, আচারে অভ্যস্ত হতে হবে। সবচেয়ে যেটা গুরুত্বপূর্ণ-সেটা হলো সেই দেশটির যে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য তার সঙ্গে আপনাকে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। যখন আপনি সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে মেনে নিতে পারেন না তখন নানা ধরণের বিড়ম্বনার স্বীকার হতে হয়। মনে করুন আপনার ভিনদেশি ঊর্ধ্বতন বা ব্যবসায়িক বন্ধুর সঙ্গে খেতে বসেছেন। সে মেনু দেখে অর্ডার করলো এমন কিছু যা আপনি কখনোই খান নি। অথবা আপনার ধর্মীয় আচার ওই খাবারটি খাওয়া সমর্থন করে না। কিন্তু তার খাওয়া দেখে আপনি না খেয়ে যদি উঠে যান সেটি হবে খুব দৃষ্টিকটু।

সামগ্রিক উন্নয়নের সঙ্গে এই বৈচিত্র্য মানিয়ে নেয়ার ব্যাপারটা বেশ ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য একইসঙ্গে দ্বন্ধ ও যুদ্ধের জন্য যেমন দায়ী তেমনি যদি এই বৈচিত্র্যকে উদযাপন করা যায় তাহলে এটিই হয়ে উঠতে পারে উন্নয়নের নিয়ামক। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ নিজেদের মধ্যকার জাতিগত দ্বন্ধের ফলে বছরের  পর বছর যুদ্ধ বিগ্রহের মধ্যে জড়িয়ে আছে। যার ফলে পৃথিবীতে এরা পরিচিত হয়ে উঠছে পিছিয়ে পড়া দেশ হিসেবে। অন্যদিকে কানাডা, আমেরিকা, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ডসহ বিশ্বের উন্নত বেশ কয়েকটি দেশে জাতিগত বৈচিত্র্য থাকার পরেও তারা উন্নত দেশ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। অর্থনীতিবিদ কামরুল আশরাফ এবং ওদোদ গ্যালোর তাদের ‘কালচারাল ডাইভারসিটি, জিওগ্রাফিক্যাল আইসোলেশন অ্যান্ড দ্য অরিজিন অফ দ্য ওয়েলথ অফ ন্যাশনস’ নামে একটি গবেষণাপত্রে বলেন, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য উন্নয়নকে তরান্বিত করে অন্যদিকে এর অনুপস্থিতি উন্নয়নের গতি শ্লথ করে দেয়। টেকসই উন্নয়নে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য উদযাপন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চাইলে সবসময়ই আমরা ব্যক্তিগতভাবেও এই উদযাপনটা করতে পারি কোন না কোনভাবে। অন্যদেশ আর ভিন্ন সংস্কৃতিকে জানার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো নানা দেশের বই পড়া আর চলচ্চিত্র উপভোগ করা। আমরা ভিনদেশি  সঙ্গীত বা নাচ উপভোগ করতে পারি ইউটিউবে। এছাড়া আশেপাশের ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষদের সঙ্গে বন্ধুতা গড়া, রেস্তোরাঁয় অন্যদেশের ভিন্ন স্বাদের খাবার খাওয়া, বিভিন্ন জাতির ঐতিহ্যবাহী উৎসবগুলোতে অংশ নেয়া বা অন্য ধর্মের উপাসনালয় গুলো ঘুরে দেখা, জাদুঘরে ঘোরা এসব ছোট ছোট নানান মাধ্যমে আমরা সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে উদযাপন করতে পারি।

মোটাদাগে এই পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৬১ ভাগ এশিয়ান, ১৩ ভাগ আফ্রিকান,৫ ভাগ উত্তর আমেরিকান, ৮ ভাগ মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকান, ১২ ভাগ ইউরোপিয়ান ও ১ ভাগ ওশেনিয়ান। এদের মধ্যেও রয়েছে হাজার রকমের সংস্কৃতি। ভাষাগত দিক থেকে ২২ ভাগ মান্দারিন ভাষায় কথা বলে,  ৯ ভাগ ইংরেজি, ৮ ভাগ হিন্দি, ৭ ভাগ স্প্যানিশ, ৪ ভাগ বাংলা, ৪ ভাগ আরবি, ৩ ভাগ রুশ, ৩ ভাগ পর্তুগীজ ভাষাভাষী মানুষ রয়েছেন। এছাড়াও রয়েছে হাজারখানেক ছোট ছোট ভাষাভাষী জনগোষ্ঠি। ধর্মের দিক থেকে ৩২ ভাগ  খ্রিস্টান, ১৯ ভাগ মুসলিম, ১৩ ভাগ হিন্দু, ১২ ভাগ প্রাকৃত ধর্ম, ৬ ভাগ বৌদ্ধ, ১ ভাগ ইহুদি আর বাকি ১৫ ভাগ লোক কোন ধর্ম বিশ্বাস করেন না। আবার এদের মধ্যেও রয়েছে হাজার হাজার বিচিত্র সব বিভাগ ও  বৈচিত্র্য। তাই এই অবধারিত বৈচিত্র্যগুলোকে এড়িয়ে না গিয়ে, দাবিয়ে না রেখে, ভয় না পেয়ে আনন্দের সাথে উপভোগ করলে মানুষ হয়ে জন্মাবার আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে ধরা দেবে।

জান্নাতুল মাওয়া: নিউজরুম এডিটর, সারাবাংলা.নেট এবং আন্তঃধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সংলাপকর্মী

সারাবাংলা/ এসবি/ এমএম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর