Sunday 29 Dec 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

গ্যানিজ ও ভোগে ক্র্যাক প্লাটুনের তাণ্ডব!

রহমান রা’আদ
১ নভেম্বর ২০২৩ ১৭:৪৯ | আপডেট: ৪ নভেম্বর ২০২৩ ১৭:৫১

একাত্তরের ৯ জুলাই ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলাদের ইন্টারকন্টিনেন্টালে দুর্ধষ অপারেশনের পর ঢাকা শহরে পাকিস্তানী সেনারা স্বাভাবিকভাবেই ছিল চরম সতর্ক অবস্থায়। বহির্বিশ্বকে ঢাকার পরিস্থিতি ঠিকঠাক আছে এমনটাই জানাতে চেয়েছিল পাকিস্তানী সামরিক জান্তা সরকার, কিন্তু ঢাকার আরবান গেরিলা দলের ইন্টারকন্টিনেন্টালে হামলা তাদের সেই প্রচেষ্টায় ছিল প্রবল এক আঘাত। কিন্তু পাকিস্তানীরা হয়তো ভাবতেও পারেনি ইন্টারকন্টিনেন্টালে হামলা ছিল স্রেফ শুরু মাত্র! কারণ ঠিক দিন দশেকের মাথায় আরো একবার গেরিলাদের হামলায় পর্যদুস্ত হলো পাকিস্তানীদের ঢাকা স্বাভাবিক রাখবার মেকি অর্থহীন প্রচেষ্টা। ঢাকার অভিজাত বিপণী কেন্দ্র ‘গ্যানিজ ও অভিজাত দোকান ‘ভোগ’-এ আবারো আচমকা হামলায় শোরগোল পড়ে যায় ঢাকা জুড়ে। গ্রেনেড নিক্ষেপ ও ব্রাশফায়ারে হতাহত হয় বেশ কিছু পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত পুলিশ। নিষ্ঠুরতা আর বর্বরতায় সাক্ষাৎ পিশাচ ছিল এরা।

বিজ্ঞাপন

বিচ্ছু হিসেবে পরিচিত ক্র্যাক প্লাটুনের আরবান গেরিলাদের দুটো স্বতন্ত্র গ্রুপ এই হামলা চালিয়েছিল। গ্যানিজ ও ভোগ-এ আক্রমণে অংশ নিয়েছিলেন মায়া (মোফাজ্জ্বল হোসেন চৌধুরী), মানু ও গাজী (গোলাম গাজী দস্তগীর)। একটা স্টেনগান, কয়েকটা গ্রেনেড-৩৬ এবং ফসফরাস বোমা নিয়ে ৯০ সিসি হোণ্ডা মোটরবাইকে চেপে এই তিনজনের অপারেশনে ব্যাকআপ হিসেবে ছিল আরেকটি দল। কাভার দেবার জন্য একটা টয়োয়া গাড়িতে ছিলেন সামাদ, উলফত ও জুয়েল। ১৮ জুলাই বিকেলবেলা নির্ধারিত হয় অপারেশনের দিনক্ষণ।

বিজ্ঞাপন

এই অপারেশনের মূল লক্ষ্য ছিল শত্রু আক্রান্ত ঢাকা শহরে যে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে না সেটা আরেকবার সাড়া ফেলে জানিয়ে দেয়া। আর আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল নগরীতে যে গেরিলাদের সদর্প উপস্থিতি আছে, সেটা সরাসরি জানিয়ে দেয়া। যেন পাকিস্তানী জান্তা সরকারকে তাচ্ছিল্যভরে জানানো যে, ‘ দ্যাখো, তোমাদের নাকের ডগায় পুরোদমে বহাল তবিয়তে ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছি, পারলে ঠ্যাকাও! পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নতুন আমদানী করা পুলিশ সদস্যদের নরকে পাঠানোও ছিল অন্যতম উদ্দেশ্য!

অপারেশনের জন্য প্রথম রেকিওয়ার্ক করা হয়েছিল ১৭ জুলাই। ১৮ জুলাই সব ঠিকঠাক সিগন্যাল পাবার পর মানু, মায়া ও গাজী তাদের ৯০ সিসি হোন্ডা মোটরবাইকে করে রওয়ানা হলেন। এক অবাঙ্গালীর কাছ থেকে আনা গাড়িটা ড্রাইভ করছিলেন মানু, গাজী ছিলেন পেছনের সিটে এবং মায়া ছিলেন দুজনের মাঝখানে। স্টেনগানটা ছিল গাজীর কাছে, ম্যাগাজিন খোলা ভাঁজ করা অবস্থায় লম্বালম্বিভাবে স্টেনটা বুকের মধ্যে নিয়ে মায়ার পিঠের সাথে সেঁটে বসেছিলেন তিনি— যেন বাইরে থেকে দেখে অস্ত্রটা বোঝা না যায়। মায়ার হাতে ছিল তিনটা ফসফরাস বোমা ও দুটো গ্রেনেড।

অপারেশন স্পটে এসে আরেকবার রেকি করলেন তারা। দেখতে পেলেন অন্যান্য দিনের মতই সেদিনও চারজন পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ অটোমেটিক রাইফেল হাতে গ্যানিজের দেয়াল ঘেঁষে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছে। রেকি করে তারা চলে গেলেন জিন্নাহ অ্যাভিনিউর দিকে। আবার ঘুরে এলেন দ্বিতীয় দফা রেকির জন্য। এবার তারা পর্যবেক্ষণ করলেন রাস্তার লোকজন ও যানবাহন চলাচল পরিস্থিতি। একইসাথে অপারেশন সাহায্যকারী কাভার স্কোয়াডের অবস্থানটাও দেখে নিলেন। সব ঠিকঠাক, এবার শুধু চূড়ান্ত আক্রমণের অপেক্ষা।

দ্বিতীয়বার রেকির চক্কর দেবার সময়ই চলন্ত অবস্থায় মায়া ও গাজী মুখে বেঁধে নিলেন কালো রুমাল। হোন্ডা এসে থামলো গ্যানিজের সামনের ফুটপাতের পাশে। থামতেই গাজী লাফিয়ে পড়লেন। গ্যানিজের তখন শুধু মেইন গেইটটি খোলা। এক ছুটে গাজী চলে গেলেন দরজার দিকে, ছুটতে ছুটতেই স্টেনগানে ফিট করলেন ম্যাগাজিন। ঠিক তার পেছনেই ছিলেন মায়া। চিৎকার করে সামনে বসে থাকা পুলিশগুলোকে বলে উঠলেন, ‘হ্যান্ডস আপ’!

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হতভম্ব হয়ে গেল পুলিশগুলো। গ্যানিজের ভেতরে রয়েছে ১২/১৩ জন লোক। তারা কেউ হাত না তুলেই এদিকওদিক লুকোবার চেষ্টা করছে। কয়েকজন মেঝেতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে চিৎকার করছে, ‘মুকুত সে বাঁচাও’! দোকানের দারোয়ান, ম্যানেজার সবাই লুকিয়ে ছিল ঠিক দরজার ওপাশে কাউন্টারের কাছে। এরমধ্যেই ম্যানেজার কোমরে হাত দিল পিস্তল বের করার জন্য। মাত্র দেড় মিনিটের মধ্যেই ঘটে যাচ্ছে এতো কিছু।

গাজী দেখলেন আর এক মুহুর্ত দেরি করলে সব ভন্ডুল হয়ে যাবে, কারণ গ্যানিজের সামনে দুজন কালো মুখোশধারী দেখে রাস্তায় চলাচলকারী সবাই ছুটে পালাতে শুরু করেছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই অতিরিক্ত পুলিশ বা পাকিস্তানী সেনারা চলে আসবে। আর দেরি করলেন না গাজী, বিদ্যুতগতিতে দোকানের মধ্যে ছুটে গিয়ে হতভম্ব ভাব কাটিয়ে উঠে গুলি করতে উদ্যত পুলিশ চারজনের দিকে চোখের পলকে ব্রাশ ফায়ার করলেন, স্টেনগানের পুরো ম্যাগাজিনের ৩০টা বুলেট খালি হলো পুলিশ চারজনের উপর।

ঠিক একইমুহুর্তে মায়াও প্রথমে ছুঁড়েছেন একটা গ্রেনেড-৩৬ এবং সাথে সাথে একটা ফসফরাস বোমা। প্রচন্ড বিস্ফোরণের সাথে সাথে আগুন ধরে গেল, গাজীর স্টেনের ম্যাগাজিন ততক্ষণে নিঃশেষ, ভেতর থেকে ভেসে আসছে হার্মাদ পুলিশদের আর্তনাদ ও গোঙ্গানী। দ্রুতপায়ে বাইরে এসে দুজন দেখতে পেলেন রাস্তা একদম খালি, ইতোমধ্যেই বায়তুল মোকাররমের আশেপাশের সমস্ত দোকানের শাটার বন্ধ করা শুরু হয়েছে, শুধু হোন্ডা বাইকের উপর বসে আছেন মানু। কাভার দেবার জন্য প্রস্তুত গাড়ীটি দাঁড়িয়ে আছেন আড়াআড়িভাবে, জানালা থেকে বেরিয়ে আছে স্টেনগানের নল।

সেখান থেকে এক মুহুর্তে বাইকে উঠে গায়েব হলো গেরিলারা, গন্তব্য আরেক অভিজাত অবাঙ্গালীদের দোকান ‘ভোগ’! চলন্ত অবস্থাতেই একটা ফসফরাস বোমা ‘টিন আউট’ করে গাজীর হাতে দিলেন মায়া, ছুঁড়ে মারতে হবে ভোগে। গাজীর বুকের ভেতর দুড়দাড় বাড়ি মারছে রীতিমত, একটু বেশি ঝাঁকুনি লাগলেই বিস্ফোরিত হতে পারে পিন আউট করা ফসফরাস বোমাটা। ভোগের সামনে আসার পর দেখা গেল এক কর্মচারী আপ্রাণ চেষ্টায় দোকানের শাটার ফেলছে, আর মাত্র এক হাত পরিমাণ খোলা আছে শাটারটি। মুহুর্তের মধ্যে গাজী ফসফরাস বোমাটা ছুঁড়ে মারলেন সেই আধখোলা শাটারের ভেতর, প্রচন্ড বিস্ফোরণে আগুন ধরে গেল ভোগে!

তথ্যসূত্র:
১। সাক্ষাৎকার- গোলাম গাজী দস্তগীর
২। স্বাধীনতা সংগ্রাম ঢাকায় গেরিলা অপারেশন/হেদায়েত হোসেন মোরশেদ

লেখক: একটিভিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

গ্যানিজ ও ভোগে ক্র্যাক প্লাটুনের তাণ্ডব! রহমান রা'আদ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর