Sunday 29 Dec 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সৈয়দ হাফিজুর রহমানের দুঃসাহসিক বীরত্বগাঁথা

রাতিন রহমান
৩০ আগস্ট ২০২৩ ১৫:২৫

একাত্তরে পুরো সময়টা জুড়ে যেমন রয়েছে বেদনাবিধুর যন্ত্রণার উপাখ্যান, তেমনি আছে দুঃসাহসিক বীরত্বগাঁথা। ঢাকা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জন্য রাজধানী শহর এবং কৌশলগত কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় এখানে পাকিস্তানি সেনারা ছিল খুবই তৎপর, তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ছিল নিশ্ছিদ্র। কিন্তু সেই গিজগিজে পাকিস্তানি সেনায় ভরা ঢাকা শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্পটেই ‘হিট এন্ড রান’ কৌশলে উপুর্যপরি হামলা চালিয়েছিল আরবান গেরিলাদের দল। কি অচিন্তনীয় সাহস তারা দেখিয়েছিল, ঝুঁকি তারা নিয়েছিলেন, তা আজও অনেকের ভাবনার অতীত।

বিজ্ঞাপন

দুই নম্বর সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল খালেদ মোশাররফের নির্দেশে গেরিলা ওয়ারফেয়ারের কিংবদন্তী মেজর এটিএম হায়দার ১৭ জন তরুণকে গেরিলাযুদ্ধের ট্রেনিং দিয়ে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন। তার নির্দেশনা ছিলো হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বিদেশী সাংবাদিক ও অতিথিরা থাকাকালীন ঢাকা শহরের পরিস্থিতি যে শান্ত নয় এবং এখানে যুদ্ধ চলছে তা বোঝানোর জন্য শহরের আশে-পাশে কিছু গ্রেনেড ও গুলি ছুড়তে হবে। কিন্তু দুঃসাহসী এই তরুণেরা ঢাকায় এসে ৯ জুন তারিখে সরাসরি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে গ্রেনেড হামলা করে। সন্ধ্যায় বিবিসির খবর থেকে খালেদ মোশাররফ এই অপারেশনের কথা জানতে পেরে বলেন, ‘দিজ অল আর ক্র্যাক পিপল! বললাম, ঢাকার বাইরে বিস্ফোরণ ঘটাতে আর ওরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালেই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এসেছে। ’ তিনিই প্রথম এই দলটিকে ‘ক্র্যাক’ আখ্যা দেন; যা থেকে পরবর্তীতে মুক্তিসেনাদের এই প্লাটুনটি ‘ক্র্যাক প্লাটুন’ নামে পরিচিত হয়।

বিজ্ঞাপন

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে একাত্তরের জুন থেকে আগস্ট এই তিন মাস রীতিমত দিশেহারা করে তোলে এই ব্রেইভহার্টের দল। বাধ্য হয়েই কাপুরুষ পাকিস্তানিরা বেছে নেয় ষড়যন্ত্র আর কূটকৌশল, কাজে লাগায় তাদের পালিত নরপিশাচ জল্লাদ আলবদর ও রাজাকারদের, আগস্টের ২৯ থেকে ৩১ এই তিনদিন ধরে একের পর এক গেরিলাদের ‘হাইড আউট’ প্রকাশ হয়ে যায় ও ‘কিংস পিনেরা’ ধরা পড়ে। যে আরবান গেরিলারা ধরা পড়েন, তাদের ৭ জনকে আর কখনই খুঁজে পাওয়া যায়নি। জানা যায় অবর্ণনীয় অত্যাচার শেষে নির্মমভাবে তাদের হত্যা করেছে আলবদর ও পাকিস্তানি সেনারা।

সৈয়দ হাফিজুর রহমান বেহালা বাজাতেন, আলতাফ মাহমুদের সাথে তার পরিচয়টাও সেইসূত্রেই। ষাটের দশকের শুরুতে খুলনায় ‘ললিতকলা’ নামে একটা গানের স্কুল খুলেছিলেন হাফিজ। সেটি খুব একটা না জমায় জীবিকার তাগিদে গেলেন করাচী। সেখানে বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক দেবু ভট্টাচার্যের সাথে কাজ করতে করতেই পরিচয় ঘটে দেবুর এক গুনী শিষ্যের সাথে, পূর্ব বাংলায় যার পরিচিতি জনে জনে জানে, সুরকার আলতাফ মাহমুদ। যার বিষাদমাখা সুরারোপে আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা একুশের গানটি অমরত্ব লাভ করেছে বাঙ্গালী মানসপটে। ঈশ্বর ওদের জন্মতিথি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে লিখলেও, সেদিনের সেই পরিচয়ক্ষণে নির্ধারিত করে দিয়েছিল ওদের অভিন্ন অন্তিমতিথি।

হাফিজকে আলতাফ মাহমুদের ছায়াসঙ্গী বলা হতো। একাত্তরের যুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য নতুন গান প্রয়োজন। নতুন গান করার বিষয়ে আলোচনার জন্য তিনি একদিন হাফিজকে সাথে নিয়ে চলেন গেলেন গণসংগীত শিল্পী আব্দুল লতিফের বাসায়, তিন গানের জগতের মানুষ সুর-স্বর-স্বরলিপি সমন্বয়ে মুক্তিযুদ্ধকে চাঙ্গা রাখতে অনেকক্ষণ সময় নিয়ে বৈঠক করলেন। কেবল সেখানেই নয়, বৈঠক চলতো ৩৭০ আউটার সার্কুলার রোডের বাসাতেও, আব্দুল লতিফ সাহেব ও আলতাফ মাহমুদ দুজন মিলে ঘন্টার পর ঘন্টা পার করে দিতেন, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্যে গান লিখবার তাড়নায় ক্লান্তির কথা তাদের মাথায়ই আসতো না। বেহালার সাথে সাথে প্রয়োজনে গেরিলা অপারেশনেও সমান পারদর্শিতা দেখিয়েছেন এই সাহসী যোদ্ধা। ৩০ অগাস্ট পাক সেনাদের হাতে তারা দুইজন একসাথে ধরা পড়েন। অস্ত্র আর মুক্তিবাহিনীর খোঁজ পেতে পাকিস্তানিরা এমনই অত্যাচার চালিয়েছিল যে হাফিজের চোখ কোটর থেকে ছিটকে বেরিয়ে গিয়েছিল। তবুও তথ্য তো দূরে থাক, মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের বিষয়ে একটা টুঁ শব্দও করেননি এই অমিত সাহসী বীর! টর্চার সেলেই ৩১ আগস্ট রাতে মৃত্যুবরন করেন তিনি।

তথ্য কৃতজ্ঞতা:
১। ব্রেইভ অফ হার্ট: হাবিবুল আলম বীর প্রতীক
৩। সুরের বরপুত্র আলতাফ মাহমুদ: দিনু বিল্লাহ

সারাবাংলা/এসবিডিই

ফিচার মুক্তিযুদ্ধ রাতিন রহমান সৈয়দ হাফিজুর রহমানের দুঃসাহসিক বীরত্বগাঁথা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর