ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট— ভ্যাকসিন নেওয়ার পরও কমছে না উদ্বেগ
২৫ আগস্ট ২০২১ ১৮:৪৪ | আপডেট: ২৩ মে ২০২২ ১০:৪৯
মহামারি করোনাভাইরাস অণুজীবের বিরুদ্ধে মানবকূলের যুদ্ধে এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী কার্যকর অস্ত্র একটাই— ‘কোভিড ভ্যাকসিন’। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ‘কোভিড-১৯’-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে মানুষ উদ্ভাবন করেছে ভিন্ন নামে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভ্যাকসিন। এতে আপাতদৃষ্টিতে লাভ হয়েছে মানবজাতিরই— একের পর এক আরও বেশি কার্যকর, সংশোধিত ভ্যাকসিনের দেখা মিলছে। সঙ্গে সঙ্গে রূপ বদলাচ্ছে হালে সর্বাধিক আলোচিত অণুজীবটিও। ডেল্টা, ডেল্টা প্লাস, সার্স-কভ২, ল্যাম্বডা, কাপ্পা— একের পর এক আবিষ্কৃত হচ্ছে করোনার ভ্যারিয়েন্ট। এগুলোর একটি আবার একটি আরেকটির চাইতে বেশি ভয়াবহ রূপে দেখা দিচ্ছে।
করোনা মহামারির শুরু থেকে প্রচলিত ধারণা ছিল ভ্যাকসিন গ্রহণ মানেই ভাইরাস থেকে সুরক্ষা। কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু গবেষণা একেবারেই বদলে দিচ্ছে দৃশ্যপট। কিছু গবেষণায় এমন তথ্যও উঠে আসছে, করোনাভাইরাসের কিছু ভ্যারিয়েন্টের কারণে ভ্যাকসিনগ্রহীতারাই আছেন অপেক্ষাকৃত বেশি বিপদে। এর কারণ হিসেবে উঠে এসেছে ভারত থেকে ছড়িয়ে পড়া ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের নাম। এই ভ্যারিয়েন্টের নাকি ভ্যাকসিনগ্রহীতাদের করোনায় আক্রান্ত করার হার যারা ভ্যাকসিন নেননি, তাদের চেয়ে বেশি!
সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) বরাতে একটি খবর প্রকাশ করেছে ব্লুমবার্গ অনলাইন। প্রতিবেদনটিতে বিভিন্ন গবেষণা ও উপাত্তের বরাতে দেখানো হয়েছে, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কারণে ভ্যাকসিন নেওয়ার পরও কমছে না উদ্বেগ।
এ বিষয়ে সিডিসি’র বরাতে একটি কেস স্টাডি তুলে ধরেছে ব্লুমবার্গ অনলাইন। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ৪ জুলাই ছুটির দিন উদযাপনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের ছোট বিচ শহরে ডান্স ফ্লোর ও বাড়ির পার্টিতে হাজারও মানুষ একত্রিত হন। তাদের মধ্যে অনেকেরই ভ্যাকসিন নেওয়া ছিল, আবার অনেকেই ছিলেন যারা ভ্যাকসিন নেননি। গবেষণায় বলা হয়, সেই ঘটনার পর থেকেই ম্যাসাচুসেটসে করোনা মহামারি নতুন রূপ নেয়। ওই দিনে আক্রান্ত ৪৬৯ জনের মধ্যে চার-তৃতীয়াংশেরই ভ্যাকসিন নেওয়া ছিল।
সিডিসি’র কেস স্টাডির লেখকরা জানিয়েছেন, এটি এমন হতে পারে— যারা ভ্যাকসিন নিয়েছেন, তারা সাধারণ মানুষের মতোই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়াচ্ছেন। আবার এমনও হতে পারে— আরও বেশি মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়া হলে, তারা আরও বেশি কোভিড সংক্রমণের জন্য দায়ী থাকবেন। তাই এই একটি গবেষণা দিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে আসা যাবে না।
আরেক গবেষণায় ব্যাপক হারে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পেছনে কিছুটা ভিন্ন চিত্র ও গল্প পাওয়া গেছে। গবেষকরা জানিয়েছেন, জরিপ পরিচালনার সময়, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি, ভ্যাকসিনগ্রহীতার সংখ্যা, এমনকি আবহাওয়ার অবস্থাও গবেষণার ফলাফলকে আরও বেশি জটিল করে তোলে। এবং শেষ পর্যন্ত কোন তথ্যটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তা বের করা কঠিন হয়ে পড়ে।
বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই ১৮ বছরের বেশি বয়সীদের শতভাগ করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনের আওতায় আনার কাজ চলছে। তবে ভ্যাকসিন নেওয়ার পরও অনেকেই এই ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন। আশ্চর্যজনক হলেও ভ্যাকসিন নেওয়া মানুষের মধ্যে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার হার অনেক বেশি। তবে কতদিন পর পর তারা আক্রান্ত হচ্ছেন তা এখনো স্পষ্ট নয়। আবার তারা অন্যদের মধ্যে এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটাচ্ছেন কি না, সেটিও নিশ্চিত নয়। ভ্যাকসিন ভাইরাসের বিরুদ্ধে শক্তিশালী সুরক্ষা দেয়— এটি এখন পর্যন্ত প্রমাণিত। তবে উদ্বেগের বিষয় হলো— ভ্যাকসিন নেওয়ার পরও অনেকেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গুরুতর অসুস্থ হচ্ছেন, যা আগে মানুষ ভাবেনি।
গবেষকরা বলছেন, প্রাথমিক পর্যায়ে ‘ভ্যাকসিন নেওয়া মানুষরাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন’ শৗর্ষক বিষয়টি নিয়ে পুরোপুরি নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যাবে না। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট উত্তরের জন্য ব্যাপক গবেষণা প্রয়োজন। দরকার নীতিনির্ধারক ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানের কর্তাদের পরিকল্পনা প্রণয়ন। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের অনেকে মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা নিয়ে নিয়ে করা আদেশের পুনর্বিবেচনা করছেন বা অফিস চালু করার সিদ্ধান্তকে পিছিয়ে দিচ্ছেন। আবার অনেকেই এর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সবকিছু মিলিয়ে চলমান পরিস্থিতি অনেকটাই গোলমেলে।
সিডিসির সাবেক পরিচালক এবং ‘রিজলভ টু সেভ লাইভস’-এর প্রধান টম ফ্রিডেন বলেন, নতুন এই ভাইরাসের বিষয়ে আমরা যা জানি এবং যা জানি না— সে সম্পর্কে এখনই কোনো স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর সময় আসেনি। আমরা কিছু বিষয় নিশ্চিতভাবে জানি, কিছু বিষয় পুরোপুরি জানি না। ভ্যাকসিন এই ভাইরাস থেকে কতটা সুরক্ষা দিচ্ছে কিংবা কতদিন পর্যন্ত ভ্যাকসিন এই সুরক্ষা দেবে— এটি এখনো একটি কঠিন প্রশ্ন এবং এর সমাধান করা প্রয়োজন।
টম ফ্রিডেন আরও বলেন, ভ্যাকসিন নেওয়া মানেই যে পুরোপুরি সুরক্ষিত, তা কিন্তু নয়। এটি জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়। কে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ, তা জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের জানতে হবে। জনগণের কখন বুস্টার ডোজের প্রয়োজন হবে সে কারণেই কেবল নয়, বরং ভাইরাসের নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণের মধ্যে সবকিছু আবার খুলে দিলে পরিস্থিতি কেমন হতে পারে— এসব বিষয়েও ধারণা নিতে সাহায্য করবে এসব তথ্য।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্রমণ বিশেষজ্ঞ মনিকা গান্ধী বলেন, এটি স্পষ্ট যে এখন অনেক বেশি সংক্রমণ হচ্ছে। আমরা সবাই এমন কাউকে জানি যে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু আমাদের কোনো সুনির্দিষ্ট ক্লিনিক্যাল ডাটা নেই।
নিউইয়র্কে সম্প্রতি সংক্রমণ বেড়ে যাওয়া নিয়ে সিডিসি পরিচালিত নতুন এক গবেষণা থেকে জানা গেছে, মে মাসের পর থেকে করোনার সংক্রমণ অনেক বেড়ে গেছে। আর এর ৪ শতাংশই জুলাইয়ের মাঝামাঝিতে সংক্রমণ হয়েছে। যদিও জনস্বাস্থ্যের বিধিনিষেধ শিথিল করা ও নতুন ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট করোনা পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করতে পারে বলে গবেষকরা আগেই সতর্ক করেছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডোতে করা সিডিসি’র আরেক গবেষণায় জানা যায়, মেসা এলাকায় সংক্রমণের হার ৭ শতাংশ, যা অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি (৫ শতাংশ)। প্রতিবেদনে বলা হয়, সেখানে অনেক বেশি ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ হয়েছে। মেসা’র রোগীদের বয়স ও ভ্যাকসিন দেওয়ার হার কম হওয়ায় বিষয়টি এখানে ভূমিকা রাখতে পারে।
ইসরাইলের বাইরে এক গবেষণায় দেখা গেছে, ভ্যাকসিন দেওয়ার কয়েক মাস পর থেকে শরীরে এর কার্যকারিতা কমতে থাকে। এমনকি তারা করোনা আক্রান্ত হলে হাসপাতালে ভর্তিরও প্রয়োজন হতে পারে। তবে এটিকে এখনো প্রাথমিক তথ্য বলা যায়। কারণ, এ ধরনের ঘটনা অনেক বেশি ঘটেনি। কিন্তু আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই কিছু মানুষের বুস্টার ডোজের প্রয়োজন হতে পারে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কিছু অঙ্গরাজ্যে একই সময়ে সংক্রমণের হার বাড়তে দেখা গেছে। কিন্তু ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে এটা বলা কঠিন হয়ে যাচ্ছে যে ভ্যাকসিন গ্রহণের কয়েক মাস পর যেকোনো ধরনের ভ্যারিয়েন্টের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে নাকি কেবল ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা কমছে। ফলাফল দু’রকমই হতে পারে বলে আশঙ্কা গবেষকদের। আবার ভ্যাকসিন নেওয়ার পর মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে যে পরিবর্তন, তাও এখানে প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ অনেকেই ভ্যাকসিন নেওয়ার পর সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন ও ভ্রমণে বের হচ্ছেন।
ব্লুমবার্গ অনলাইনের প্রতিবেদনে এসব গবেষণা থেকে কিছু বিষয় স্পষ্ট করা হয়েছে। এতে জানানো হয়েছে, ভ্যাকসিন নেওয়ার পর করোনা আক্রান্ত হলেও তাদের শরীরে এই ভাইরাসের মাত্রা কম থাকে। এ কারণে ভ্যাকসিনগ্রহীতাদের হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজন খুব কম হয়। ভ্যাকসিনগ্রহীতাদের মধ্যে মৃত্যুর হারও কম। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে প্রাপ্তবয়স্কদের একটি বড় অংশকে (৩০ শতাংশ) এখনো ভ্যাকসিন দেওয়া হয়নি। এ কারণে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দেশটিকে অনেক বেশি সংক্রমণের দিকে ঠেলে দিতে পারে। ফ্রিডেন জানান, বড় বিষয় হলো— ভ্যাকসিন মানুষের শরীরে কাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্রে সাম্প্রতিক সময়ে বেশি সংক্রমণের কারণ হলো কম ভ্যাকসিন নেওয়া।
যেকোনো ধরনের ভাইরাসের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সংক্রমণ হওয়া স্বাভাবিক ঘটনা। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে দেখা গেছে, কোনো ভ্যাকসিনই কোনো ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে ১০০ শতাংশ কার্যকর হয় না। ভাইরাস যত বেশি ছড়াবে, তত বেশি সংক্রমণ হবে। আর ভ্যাকসিনগুলোকে বিভিন্ন গবেষণা ও প্রাপ্ত তথ্য প্রয়োগের মাধ্যমে নিঁখুত করতে হয়, যেটি সময়সাপেক্ষ একটি বিষয়।
তবে কোভিড ভাইরাস নিয়ে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক প্রশ্ন উঠছে। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কারণে কি সংক্রমণ বেশি হচ্ছে? নাকি ভাইরাসের বিরুদ্ধে সক্ষমতা কমে যাওয়া বা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার কারণে বেশি সংক্রমণ ছড়াচ্ছে? ভ্যাকসিন নেওয়ার পরও কি কেউ ভাইরাসে গুরুতর অসুস্থ হতে পারে? অথবা অনেক বেশি মাত্রার এই সংক্রমণ কতটাই বা স্বাভাবিক?
‘রিজলভ টু সেভ লাইভস’-এর প্রধান টম ফ্রিডেন বলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব প্রশ্নেরই জবাব মিলবে। কিন্তু এখনও অনেক তথ্য-উপাত্ত অসম্পূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। কিন্তু করোনা সংক্রমণ আর মহামারি তো বাস্তব বিষয়। সাধারণত এসব ক্ষেত্রে আমাদের অসম্পূর্ণ তথ্যের ভিত্তিতে জনস্বাস্থ্যের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কিন্তু এখানে এমন অনেক কিছুই আছে যা আমরা জানি না। তাই সব প্রশ্নের তাৎক্ষণিক উত্তর না খুঁজে পরিস্থিতি বুঝে এগিয়ে যাওয়াই হবে ভালো সমাধান।
সারাবাংলা/এসএসএস/এসবিডিই/টিআর