অসুখের পৃথিবীর সুখের খবর
২৯ ডিসেম্বর ২০২০ ২১:৪৯ | আপডেট: ২৩ মে ২০২২ ১২:০৩
২০২০ সাল। জীবন নিয়ে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর আতঙ্কের বছর। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু দেখা এই পৃথিবীর মানুষ এবছর যেসব অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে তা আগের যেকোন মহামারিকে ছাড়িয়ে গেছে। যদিও এখনো মহামারির বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে বিশ্ব, তবে এরমধ্যেও ২০২০ সালে এমন সব ঘটনা ঘটেছে যা চমকে দিয়েছে পৃথিবীর মানুষকে। বায়ুমন্ডলে বিষাক্ত উপাদানের পরিমাণ কমে যাওয়া, নবায়নযোগ্য শক্তিতে রেকর্ড, যুদ্ধ পরিস্থিতির উন্নতি, ডিজিটালাইজেশনসহ নানা ঘটনায়, বিশ্বকে নিয়ে এবং নিজের জীবনকে নিয়ে নতুন করে ভেবে দেখার সুযোগ তৈরি হয়েছে। জেনে নেয়া যাক ২০২০ সালের এমন কিছু খবর।
জীববৈচিত্রে নতুন সতেজতা
ছবি: গেটি ইমেজেস
২০২০ এর করোনা মহামারি পুরো পৃথিবীকে থামিয়ে দিলেও বছরটি প্রকৃতির গতিকে বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ। এবছর প্রকৃতিতে এমন সব পরিবর্তন দেখা গেছে যা ছিল পরিবেশবিদদের জন্য অনেকটা অকল্পনীয়। বছরের প্রথম তিন মাসেই পৃথিবীর আকাশে নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডসহ বিষাক্ত উপাদানের পরিমাণ কমে যেতে দেখেন বিজ্ঞানীরা।
এছাড়া কার্বন নির্গমন কমানোর জন্য অনেক বছর ধরে অনেক বড় বড় পদক্ষেপ দেখা গেছে সারাবিশ্বে। যেখানে কাজের কাজ তেমন একটা হয় নি। তবে করোনার কারণে এবছর রেকর্ডসংখ্যক কার্বন নির্গমন কমে গেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের অ্যাংলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী এবছর ৭ শতাংশ কার্বন নির্গমন কম হয়েছে। বছরের এপ্রিলে দৈনিক কার্বন নির্গমনের হার সবচেয়ে কম ছিলো, যা ১৭ শতাংশ।
এ বছর উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায় বায়ু দূষণ। আগের চেয়ে অনেক বিশুদ্ধ বাতাস পাওয়া গেছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রে। দূষিত পদার্থের উপস্থিতি কমে গেছে ইতালি ও দক্ষিণ কোরিয়ার বাতাসেও।
করোনায় লকডাউনের কারণে ইতালির বাসিন্দা ও বিশ্বের পর্যটকরা যখন ঘরবন্দি, পর্যটন শহর ভেনিস তার রূপ বদলাতে শুরু করে। ভেনিসের খালগুলোর পানি স্বচ্ছ হতে শুরু করে। সেখানে ফিরে আসতে শুরু করে প্রাণীকূল। অনেক জায়গায় লোকালয়ে স্বাচ্ছন্দে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় বন্যপ্রাণীদের।
বাংলাদেশের কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের পানিও ঘোলাটে থেকে নীল হতে দেখা যায়। সৈকতের অনেক কাছে ডলফিনদেরও খেলতে দেখা গেছে।
নবায়নযোগ্য শক্তির সক্ষমতায় রেকর্ড
ছবি: লেজার ইনসাইটস
মহামারির অনেক আগে থেকেই নবায়নযোগ্য শক্তির চাহিদা বিশ্বব্যাপী বাড়ছিলো। তবে মহামারির সময়ে পৃথিবার মানুষ সত্যিকার অর্থেই নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের প্রয়োজন অনুভব করে। বছর শেষে দেখা যায় এ ধরনের শক্তির উৎপাদনও বেড়েছে। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি রিনিউএবলস ২০২০ রিপোর্ট অনুযায়ী, এ বছর বিশ্বে নয়ায়নযোগ্য শক্তির সক্ষমতা ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। মে মাসের রিপোর্টের সঙ্গে ডিসেম্বরের তুলনা করলে দেখা যায় সংস্থাটি ২০২০ সালে নবায়নযোগ্য শক্তির সক্ষমতা ১৮ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে। আগের রিপোর্টে তারা বলেছিলো, মহামারির জন্য দেরিতে নির্মাণকাজ, লকডাউনসহ নানা কারণে গত ২০ বছরের মধ্যে এবছর নবায়নযোগ্য শক্তির সক্ষমতা সবচেয়ে কম হবে। তবে মে এর মাঝামাঝি থেকে নির্মান কাজ ও উৎপাদনের ব্যাপক বৃদ্ধির কারণে নবায়নযোগ্য শক্তির সক্ষমতা বেড়েছে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সবচেযে ভালো ব্যবহার ও ডিজিটালাইজেশন
ছবি: গেটি ইমেজেস
মানুষে মানুষে যোগাযোগের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু, করোনাকালে মানুষ অনেক বেশি উপলব্ধি করেছে যে যোগাযোগ ছাড়াও অনলাইনে অনেক কাজ খুব সহজে করা যায়। যারমাধ্যমে জীবনযাপন আরো সহজ হয়। তাই করোনার সময়ে অনলাইন কেনাকাটা অনেক বেশি বেড়ে যায়।
এছাড়া লকডাউনের সময় বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঘরে বসে অফিস সামলেছেন চাকুরিজীবী ও ব্যবসায়ীরা। এরমাধ্যমে অনেকক্ষেত্রে চাকুরিপ্রার্থী ও মালিকের মধ্যে ভৌগলিক বাধা অতিক্রম করা সম্ভব হচ্ছে, যাতায়াতের সময় কমছে এবং সড়কে যানবাহনও কমছে। এতে করে মানুষের অনেক সময়ে বেঁচে যাচ্ছে যা তারা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে উপভোগ করতে পারে।
ছবি: আইস্টক
স্কুলগুলোতে অনলাইনে ক্লাস হওয়ায় খুব তারাতারি ভার্চ্যুয়াল কার্যক্রম রপ্ত করে নিয়েছিলেন প্রায় সব বয়সী মানুষ। তবে এসময় তথ্যপ্রযুক্তির সক্ষমতার ঘাটতি পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই নজরে আসে। যেমন, কলম্বিয়ায় পাবলিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৫০ ভাগ শিক্ষার্থীর বাড়ি থেকে ক্লাস করার মতো সক্ষমতা ছিলো না। তাদের কারো ইন্টারনেট কানেকশন ছিলো না, কারো আবার কম্পিউটার বা ট্যাব ছিলো না। লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর চিত্র অনেকটা এরকমই। এ চিত্র তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে আরো বেশি বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তাকে নীতি নির্ধারকদের সামনে নিয়ে এসেছে।
সন্ত্রাসবাদ পরিস্থিতির উন্নতি
ছবি: সোহেব গিয়াসি
গ্লোবাল টেরোরিজম ইনডেক্স অনুযায়ী, টানা পাঁচ বছরের মতো বিশ্বে সন্ত্রাসবাদের কারণে মৃত্যুহার কমেছে ২০২০ সালে। ২০১৪ সাল হতে সন্ত্রাসবাদের কারণে মৃত্যুহার ৫৯ শতাংশ কমে এখন ১৩৮২৬। ইনডেক্স শুরুর পর থেকে এবছরই সবচেয়ে বেশি দেশে সন্ত্রাসবাদ পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে যার সংখ্যা ১০৩। মৃত্যুহার কমেছে সবচেয়ে বেশি আফগানিস্তান ও নাইজেরিয়ায়।
সবচেয়ে দ্রুত আবিষ্কার হওয়া করোনাভাইরাস টিকা
ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস বিশ্বে অনেক ক্ষয়ক্ষতির কারণ হলেও, এটি বৈশ্বিক সহযোগিতার এক অভুতপূর্ব নিদর্শন তৈরি করেছে। ২০২০ সালে, বেশ কয়েকটি টিকা শুধুমাত্র আবিস্কারই হয়নি, অনুমোদনও পেয়েছে এবং এ টিকা দেওয়াও শুরু হয়ে গেছে। এক বিজ্ঞানীর ভাষায়, ”গত ১১ মাসে ১০ বছরের কাজ হয়েছে”।
সিনেমা ও নাটকের সহজলভ্যতা
করোনাভাইরাসের লকডাউনের কারণে সিনেমা হলগুলোও বন্ধ হয়ে যায়। অনলাইন স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলোতে গ্রাহক সংখ্যা বেড়ে যায়। এ পরিস্থিতিতে সিনেমা কোম্পানিগুলো বর্তমানে দর্শকদের চাহিদায় থাকা অনলাইন প্ল্যাটফর্মের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। সিনেমা হলের পরিবর্তে তারা অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ’দ্যা হাই নোট’, ’ট্রলস ওয়ার্ল্ড ট্যুর’, ’দ্যা কিং অব স্টেটেন’ ’আইল্যান্ড’, ’স্কুব’ এর মতো সিনেমাগুলো প্রিমিয়ার করে। ‘দ্যা ইনভিসিবল ম্যান’, ‘বার্ডস অব প্রে’ ও ‘এম্মা’ সহ অনেক সিনেমা হলে মুক্তি পেয়েছিলো, কিন্তু করোনাভাইরাস ও অনলাইন প্ল্যাটফর্ম সহজলভ্য হওয়ায় খুব বেশি চলে নি। তাই ২০২০ সাল দর্শকদের জন্য বেশ সহজলভ্য হয়ে যায় নতুন নতুন নাটক ও সিনেমাগুলো।
করোনাকালে ঘরবন্দি অবস্থায় থেকে মানুষ যখন একঘেয়ে হয়ে পড়ছিলো, তখনই যে যার অবস্থান থেকে ছোট ছোট কাজ করে নিজেদের ও কাছের মানুষকে আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এরজন্য কাউকে তার প্রিয়জনকে নিয়ে সুন্দর জায়গায় বেড়াতে যেতে হয়নি, রেস্টুরেন্টে খেতে যেতে হয়নি কিংবা বাড়িতে আত্মীয় বা সহকর্মীদের নিয়ে পার্টি করতে হয়নি। ঘরের ছোট ছোট কাজে আনন্দ খুঁজে নিয়েছে মানুষ।
তাই ২০২০ সালের এই সুন্দর দিকগুলোকে আশার আলো করে নতুন বছরে আবার এগিয়ে যাবে বিশ্ব। একসময় নিশ্চয়ই করোনাও পরাজিত হবে মানুষের কাছে। আর এটি করতে পারলে দেখবো, আমাদের জন্য অপেক্ষায় আছে নতুন এবং সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পৃথিবী।