রশিতে বাঁধা মা মেয়ে: করোনাকালে মধ্যযুগীয় বর্বরতা
২৫ আগস্ট ২০২০ ১৭:৫৫ | আপডেট: ২৫ আগস্ট ২০২০ ২০:০২
কক্সবাজারের চকরিয়ায় ‘গরু চুরির অপরাধে’ বয়স্ক মা ও তরুণী মেয়েকে রশিতে বেঁধে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করা হয়েছে শুক্রবার দুপুরে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, কোমরে রশি বেঁধে প্রকাশ্যে সড়কে ঘোরানো হচ্ছে মা ও মেয়েকে। তারপর সেখান থেকে চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের। সেখানে চেয়ারম্যান ও গ্রাম পুলিশ তাদের আরেক দফা পিটিয়ে অজ্ঞান করে পুলিশে দেয়। নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবসের প্রাক্কালে খবরটা যতবার পড়েছি ততবার প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা দু’জন অসহায় নারীর প্রতিচ্ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠছে।
যখন তাদের এভাবে দিনভর নির্যাতন করা হচ্ছিল তখনও তারা চুরি করেছে কী করেনি তার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এ ক্ষেত্রে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পরিকল্পিতভাবে গরু চুরির অপবাদ দিয়ে তাদের নির্যাতন করিয়েছেন এবং নিজেও করেছেন। প্রকাশ্যে নির্যাতনের শিকার এই মা ও মেয়ের মানসিক অবস্থা উপলব্ধির ভাষা আমার নেই। এ ঘটনায় কেঁচো খুঁড়তে সাপও বেরিয়ে আসছে। কারণ, কোনো মা-মেয়ে-ছেলে ভরদুপুরে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় এসে এভাবে গরু চুরি করতে আসতে পারে, তা আমি কখনো শুনিনি। তাছাড়া কোনো গরু চোর মা বোনকে সাথে নিয়ে চুরি করতে আসে তাও শুনিনি। এখানে অন্য কোন কাহিনী আছে।
এলাকাবাসীর ধারণা, মেয়েটি চেয়ারম্যানকে বিয়ে করতে রাজী না হওয়ায় গরু চুরির অপবাদ দিয়ে নির্যাতন চালানো হয়েছে। এমনকি তদন্ত না করেই চেয়ারম্যানের অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ নির্যাতিতদের যেভাবে গ্রেফতার করেছে, সেটিও ছিল স্পষ্টত আইনের লঙ্ঘন। অপরাধকর্মে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ক্ষমতাবানদের যোগসাজশ যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে এ ঘটনা আমরা আগেও দেখেছি। তাছাড়া এই ধরণের বর্বরোচিত ঘটনা যখন ক্ষমতাবানদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে হয়ে থাকে, সেখানে সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। মধ্যযুগে কোনো কোনো সমাজে যখন বলপ্রয়োগ ছিল সংকট সমাধানের প্রধান উপায় তখন এভাবে দড়ি বেঁধে, পিটিয়ে মানুষ মারা হতো।
একটা সময় ছিল নারীকে নির্যাতন করা যে অপরাধের পর্যায়ে পড়ে, সেটাই অনেকে জানত না। তখন নির্যাতিত নারীর পাশে দাঁড়ানোর কোনো সুযোগ ছিল না। চকরিয়ার ঘটনা আমাদের সেই সময়টার কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, জাতীয় সংসদের স্পিকার নারী। দু’টি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও নারী। তবুও দিনকে দিন দেশে নারী নির্যাতনের হার ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। বিগত বছরগুলির তুলনায় করোনা-দুর্যোগের মধ্যে এ বছর নারী নির্যাতনের হার আরও অনেক বেশি বেড়ে গেছে। ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বহু। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে শিশু নির্যাতনের বিষয়টিও। বাংলাদেশের মতো একটি দেশ, যেখানে নারীরা ক্রমাগত এগিয়ে যাচ্ছে, নিজ যোগ্যতার ভিত্তিতে দেশ-বিদেশে গুরুত্বপূর্ণ কাজে সফলতা অর্জন করছে সেখানে এখনও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, গণমাধ্যমে নারী নির্যাতনের অসংখ্য ছবি ভেসে বেড়াচ্ছে। যদিও যে খবরগুলি এখানে আসছে তা অনেক কম। ১০০ জন নারী নির্যাতিত হলে সামনে আসছে ১০ জনের খবর।
তবে এতসব মনে খারাপের খবরের মাঝেও স্বস্তিদায়ক খবর হচ্ছে, এ ঘটনায় জেলা প্রশাসন ও আদালতের তরফ থেকে দুটি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃত মা ও দুই মেয়েসহ তিনজনের জামিনের পাশাপাশি ঘটনার মূলহোতা চেয়ারম্যানসহ তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে রাজনৈতিক পরিচয়, ক্ষমতা বা অন্য কোন পরিচয়ের প্রভাবে বিচার যেন বাধাগ্রস্ত না হয় কিংবা অসহায় মা ও মেয়েকে যেন অন্যায়ভাবে চুরির মামলায় ফাঁসিয়ে না দেওয়া হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক: কবি, কলামিস্ট